ডেস্ক রিপোর্ট; বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের আশায় মিয়ানমারের শত শত রোহিঙ্গা নাগরিক টেকনাফ ও উখিয়াসংলগ্ন নাফ নদীতে নৌকা নিয়ে ভাসছে। দিনের বেলায় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও কোস্টগার্ড বাহিনীর সদস্যদের উপস্থিতিতে অনুপ্রবেশ সম্ভব হচ্ছে না। তাই রাতের আঁধারে নজরদারি এড়িয়ে তারা ঢুকে পড়ার চেষ্টা করছে।
ইতিমধ্যে টেকনাফ ও উখিয়া উপজেলার বিভিন্ন সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে কিছু রোহিঙ্গা নাগরিক বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে। তারা এই দুই উপজেলার পাহাড়-জঙ্গলসহ বিভিন্ন স্থানে আগে থেকেই বসবাসরত রোহিঙ্গা পরিবারের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। কিন্তু এ পর্যন্ত কতজন এভাবে প্রবেশ করেছে, নিশ্চিতভাবে কেউ বলতে পারছে না।
বিজিবি ও কোস্টগার্ড সূত্রমতে, সোমবার রাত নয়টা থেকে গতকাল মঙ্গলবার সকাল ছয়টা পর্যন্ত নাফ নদী অতিক্রম করে টেকনাফে অনুপ্রবেশের সময় রোহিঙ্গা নাগরিকবোঝাই ২০টি নৌকাকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হয়েছে। একই সময় উখিয়া সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের সময় বিজিবি ৩৫টি শিশু, ২২ নারীসহ ৬৬ রোহিঙ্গাকে আটক করে আবার মিয়ানমারে ফেরত পাঠিয়েছে। এর আগের কয়েক দিনে উখিয়া-টেকনাফ থেকে আরও ৩৪৫ রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠায় বিজিবি।
এ প্রসঙ্গে টেকনাফ ২ ও কক্সবাজার ৩৪ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল আবুজার আল জাহিদ ও ইমরান উল্লাহ সরকার বলেন, নাফ নদীর প্রায় ৬৩ কিলোমিটার জলপথ সীমান্তজুড়ে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে বিজিবি টহল রয়েছে। তবে দুর্গম কিছু পয়েন্টে বিজিবির সার্বক্ষণিক টহল থাকে না, রাতের বেলায় এসব পয়েন্ট দিয়ে কিছু রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ ঘটছে। অনুপ্রবেশকারী এসব রোহিঙ্গার ব্যাপারে খোঁজ নেওয়া হচ্ছে।
গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে নাফ নদীর শাহপরীর দ্বীপ অংশে গিয়ে দেখা গেছে, লোকবোঝাই চারটি নৌকা মাঝ নদী বরাবর ভাসছে। কিছু দূরে অবস্থান নেওয়া কোস্টগার্ড বাহিনীর একটি স্পিডবোট সেদিকে নজরদারি করছে।
স্থানীয় জেলে আমির হোসেন ও কালা মিয়া বলেন, নাফ নদীতে নৌকা নিয়ে যারা ভাসছে, তারা রোহিঙ্গা। বিজিবি ও কোস্টগার্ড সদস্যদের জন্য তারা ঢুকতে পারছে না। তবে রাতের বেলায় তারা শাহপরীর দ্বীপসহ বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে অনুপ্রবেশ করবে।
*রাতের অন্ধকারে অনুপ্রবেশ করছে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা
নাফ নদীর জেলে সব্বির আহমদ (৪৫) বলেন, গতকাল মঙ্গলবার সকাল ছয়টার দিকে সাতটি নৌকায় করে দেড় শতাধিক রোহিঙ্গা টেকনাফ সীমান্তে চলে আসে। কিন্তু কোস্টগার্ডের টহল দেখে নৌকাগুলো পুনরায় মিয়ানমার সীমান্তে ফিরে গেছে। বিকেল পর্যন্ত তারা নাফ নদীতে ভাসমান অবস্থায় থেকে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করছে। নৌকার বেশির ভাগ নারী ও শিশু।
টেকনাফের সাবরাং, জালিয়াপাড়া, নাইট্যপাড়া, দমদমিয়া ও জাদিমুরা সীমান্ত বরাবর নাফ নদীতে রোহিঙ্গাবোঝাই অন্তত ৩০টি নৌকা ভাসতে দেখা গেছে। একেকটি নৌকায় ১২ থেকে ২০ জন করে অবস্থান করছেন। এপারে নাফ নদীর বেড়িবাঁধে দাঁড়িয়ে বিজিবি সদস্যরা নজরদারি করছেন রোহিঙ্গাদের।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বিজিবি সদস্য বলেন, অনুপ্রবেশে ব্যর্থ হয়ে রোহিঙ্গাবোঝাই নৌকাগুলো নাফ নদীর মিয়ানমার সীমান্তে অবস্থান নিয়েছে। তারা নিজ দেশে ফিরে গেলে হামলার শিকার হয়। সেই ভয়ে বারবার বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টা চালাচ্ছে।
কোস্টগার্ড টেকনাফ স্টেশনের কমান্ডার লেফটেন্যান্ট নাফিউর রহমান বলেন, ‘নাফ নদীর মিয়ানমার সীমান্তে রোহিঙ্গাবোঝাই কয়েকটি নৌকা ভাসছে বলে খবর পেয়েছি। তাদের গতিবিধি নজরে রাখা হচ্ছে। রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ করতে দেওয়া হবে না।’
স্থানীয় লোকজন জানান, গত সোমবার গভীর রাতে নাফ নদী অতিক্রম করে শাহপরীর দ্বীপে ওঠে মিয়ানমারের ১৮ জন রোহিঙ্গা। বিজিবি ও পুলিশের হাতে ধরা পড়ার ভয়ে তারা আশ্রয় নেয় মিস্ত্রিপাড়ার একটি ঝুপড়িঘরে। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে সেখানে কথা হয় রোহিঙ্গা গৃহবধূ দিলদার বেগমের সঙ্গে। দিলদারের বাড়ি রাখাইন রাজ্যের মংডু শহরের ফাদংচা এলাকায়।
দিলদার বেগম (৩৫) বলেন, রাখাইন রাজ্যে সেনাবাহিনী ও পুলিশ অভিযানের নামে মুসলিম রোহিঙ্গাদের বাড়িঘর আগুনে পুড়িয়ে দিচ্ছে। অবিবাহিত মেয়েদের ধরে ধর্ষণ করছে। পুরুষ ও যুবকদের ধরে নিয়ে নির্যাতন চালাচ্ছে। এর মধ্যে তাঁর স্বামী বশির উল্লাহকেও রোববার রাতে ধরে নিয়ে গেছে। তিনি বেঁচে আছেন কি না জানা নেই। তাই দুই মেয়েকে নিয়ে শাহপরীর দ্বীপে পালিয়ে আসেন।
আরেক রোহিঙ্গা নারী বলেন, এখানে পুলিশ কিংবা বিজিবির হাতে ধরা পড়লে তারা মিয়ানমারে ফেরত পাঠাবে। তখন রাখাইন সেনারা তাদের গুলি করে মারবে। তার চেয়ে বাংলাদেশে মরলে অন্তত জানাজা পাওয়া যাবে।
অনুপ্রবেশকারী কয়েকজন রোহিঙ্গা জানায়, বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের জন্য নাফ নদীতে শত শত রোহিঙ্গা অবস্থান করছে। রোহিঙ্গাদের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ ধারালো অস্ত্রের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত। প্রচণ্ড শীতে নৌকায় নারী ও শিশুরা কাতরাচ্ছে। তাদের খাবারও নেই। গত সোমবার নাফ নদীতে একটি নৌকাডুবির ঘটনায় ১০ জন রোহিঙ্গা নিখোঁজ। এর মধ্যে একজনের লাশ পাওয়া গেছে বলে শোনা গেছে।
এ প্রসঙ্গে টেকনাফ মডেল থানার ওসি আবদুল মজিদ বলেন, নাফ নদীর নয়াপাড়া এলাকায় ভাসমান অবস্থায় এক ব্যক্তির লাশ পাওয়া গেছে। লাশ বিকৃত হওয়ায় পরিচয় শনাক্ত করা যাচ্ছে না।
স্থানীয় লোকজনের ভাষ্য, রোববার রাত সাড়ে ১১টার দিকে টেকনাফের উনছিপ্রু, ওয়াব্রাং, লেদা, জাদিমুরা ও উখিয়ার বালুখালী ও তমব্রু সীমান্তবর্তী পয়েন্ট দিয়ে কয়েকজন রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করে। এরপর তারা টেকনাফের লেদা ও উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা শিবিরে ঢুকে পড়ে।
লেদা এলাকায় পালিয়ে আসা রাখাইন রাজ্যের মংডু এলাকার রোহিঙ্গা নুর কামাল (৪০) বলেন, তাঁদের গ্রামে হামলার সময় সেনা, পুলিশ ও রাখাইনরা বেপরোয়া গুলিবর্ষণ ও ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ করছে। এ সময় তাঁর বাড়িটিও পুড়ে যায়। এতে অনেকে হতাহত হয়েছে। ইতিমধ্যে মংডুতে ১৫ হাজারের মতো রোহিঙ্গাকে ভিটাছাড়া করা হয়েছে। রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে অনুপ্রবেশে বাধ্য করা হচ্ছে।
উখিয়া ও টেকনাফের মধ্যবর্তী মিয়ানমার সীমান্ত এলাকার উলবনিয়া গ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা হারুন সিকদার বলেন, মিয়ানমারের অশান্ত পরিস্থিতিতে উখিয়া ও টেকনাফের দুই হাজার জেলে নাফ নদীতে মাছ শিকারে নামছে না। নাফ নদীতে রোহিঙ্গাবোঝাই নৌকাগুলো বাংলাদেশের দিকে অগ্রসর হলেই এদিক থেকে টের পাওয়া যায়।
নীলা ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য মোহাম্মদ আলী বলেন, সীমান্তে বিজিবি টহল জোরদার থাকলেও গভীর রাতে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটছে। করুণ অবস্থা দেখে স্থানীয় লোকজন রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশে বাধা দিচ্ছেন না।
গতকাল উখিয়ার রোহিঙ্গা শিবির ঘুরে এসে বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন কক্সবাজার জেলা শাখার সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ক্যাম্পে তিনি অনুপ্রবেশকারী অসংখ্য রোহিঙ্গা নাগরিক দেখেছেন। এর মধ্যে অনেকের হাত-পা-বুকসহ শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে কাটাছেঁড়ার দাগ। জরুরি ভিত্তিতে তাদের চিকিৎসা প্রয়োজন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ১৯৯১ সালে মিয়ানমারের সামরিক জান্তার আমলে নির্যাতনে প্রায় আড়াই লাখ রোহিঙ্গা কক্সবাজারের টেকনাফ, উখিয়া ও বান্দরবারের নাইক্ষ্যংছড়িতে আশ্রয় নেয়। বর্তমানে টেকনাফ ও উখিয়ার দুটি শিবিরে নিবন্ধিত ৩০ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী বসবাস করলেও এর বাইরে আরও কয়েক লাখ অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গা এসব এলাকায় বসবাস করছে বলে অসমর্থিত বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়।