সাংসদের গুলিতে আহত শিশু শাহাদাত কাল পিএসসি পরীক্ষী দিচ্ছে

Slider নারী ও শিশু শিক্ষা
7fd71b1789fec3838209e1d6bbc50f2f-184_05

ঢাকা; ‘জোরে হাঁটলি ফির পাও বিশায় (ব্যথা করে)। তাই আগের মতন হাঁটতি পারি না।’ গতকাল বলছিল শাহাদাত হোসেন। আগের মতো দৌড়-ঝাঁপ ও খেলাধুলা করার সামর্থ্য আর নেই তার। এমনকি একটানা বেশিক্ষণ হাঁটলে বা দাঁড়িয়ে থাকলেও ব্যথায় টনটন করতে থাকে পা দুটি। তাই স্কুল টিফিনের সময় যখন তার সহপাঠীরা মাঠে গিয়ে ছোটাছুটিতে মেতে ওঠে, শাহাদাত তখন শ্রেণিকক্ষেই বসে থাকে মন খারাপ করে।
প্রায় ১৩ মাস আগে শাহাদাতের দুই পায়ে গুলি করেছিলেন গাইবান্ধা-১ (সুন্দরগঞ্জ) আসনের সাংসদ মনজুরুল ইসলাম ওরফে লিটন। এ ঘটনায় মামলা হয়। বিচারও শুরু হয়েছে। কিন্তু সাংসদের লোকজন সেই মামলা তুলে নিতে চাপ দিচ্ছেন। তার বাবাকে আটকে রেখে মীমাংসা করার নামে জোর করে স্ট্যাম্পে সইও করিয়ে নেওয়া হয়।

গুলির ঘটনাটি গত বছরের ২ অক্টোবরের। ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে শাহাদাত হাঁটতে বেরিয়েছিল চাচার সঙ্গে। সুন্দরগঞ্জ-বামনডাঙ্গা সড়ক দিয়ে তখন গাড়ি করে যাচ্ছিলেন সাংসদ। হঠাৎ গাড়ি থামিয়ে গুলি চালান জনপ্রতিনিধি। একটি গুলি শাহাদাতের বাঁ পায়ের হাঁটুর নিচে এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে যায়। ডান পায়ের হাড়ে আরেকটি গুলি লাগে। তাকে প্রথমে স্থানীয় হাসপাতালে এবং পরে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। রংপুরে নেওয়ার পথেও বিপত্তি ঘটে। সাংসদের লোকেরা বামনডাঙ্গায় অ্যাম্বুলেন্সে হামলা করে শাহাদাতকে ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন।

এলাকাবাসী সূত্রে জানা যায়, ঘটনার সময় সাংসদ মদ্যপ অবস্থায় ছিলেন। তবে ওই সময় তাঁর স্ত্রী বলেছিলেন, কিছু লোক তাঁর গাড়ি ঘিরে ফেলেছে। সাংসদ তাদের জামায়াত-শিবিরের লোক মনে করে গুলি করেন।

জোর করে স্ট্যাম্পে সই: শাহাদাতের বাবা সাজু মিয়া অভিযোগ করলেন, চলতি বছরের ১০ ফেব্রুয়ারি সাংসদের এক আত্মীয় ও তাঁর লোকজন মীমাংসা করার কথা বলে তাঁকে বাড়ি থেকে ডেকে মাইক্রোবাসে করে শহরে এক বাড়িতে নিয়ে যান। সেখানে সাংসদ ছিলেন না। ওই লোকজন কথাবার্তার একপর্যায়ে মামলা তুলে নিতে চাপ দেন। তিনি সম্মত না হওয়ায় জোর করে নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে সই করিয়ে নিয়ে ছেড়ে দেন। তবে তাঁকে কোনো নির্যাতন করা হয়নি বা পরে এ নিয়ে আর কোনো হুমকি-ধমকি দেওয়া হয়নি। এ ঘটনার পর তিনি বিষয়টি নিয়ে সুন্দরগঞ্জ থানায় অভিযোগ দায়ের করতে গেলে থানা থেকে অভিযোগ নেওয়া হয়নি। সেই লিখিত অভিযোগটিও দেখান তিনি।

এ বিষয়ে সুন্দরগঞ্জ থানায় যোগাযোগ করা হলে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আতিয়ার রহমান বলেন, এমন কোনো অভিযোগ তিনি পাননি।

সাংসদ মনজুরুল ইসলামের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা হয়েছে। জোর করে স্ট্যাম্পে সই নেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, এ বিষয়ে তিনি কিছু জানেন না। তাঁর কোনো লোক এ ধরনের কাজ করেননি।

বাবা সাজু মিয়া জানালেন, মামলার পরের তারিখ ৫ জানুয়ারি। তাঁর আইনজীবীর মাধ্যমে সেদিন সই নেওয়ার বিষয়টি আদালতে উপস্থাপন করবেন। এখন মামলা চালাতেও তাঁর টাকা খরচ হচ্ছে। শুনানির দিন গাইবান্ধায় যাতায়াত, খাওয়া, আইনজীবীর খরচ মিলিয়ে প্রায় হাজার টাকা খরচা। প্রতি তিন বা চার মাস পরপর শুনানি। এই খরচের টাকা তিনি প্রতিদিন একটু করে আলাদাভাবে জমা করে রাখেন।

ঘটনার দুই দিন পর শাহাদাতের বাবা অ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়ি-পাতিলের ফেরিওয়ালা সাজু মিয়া থানায় মামলা করেন। রংপুরে ২৪ দিন চিকিৎসার পর সুস্থ হয়ে ঘরে ফেরে শাহাদাত। গণমাধ্যমে এই সংবাদ প্রকাশের পর সারা দেশে তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি হয়। একপর্যায়ে গত বছরের ১৪ অক্টোবর ঢাকার উত্তরা থেকে গোয়েন্দা পুলিশ সাংসদ মনজুরুল ইসলামকে আটক করে। ১৫ অক্টোবর আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়। তিনি ২৪ দিন বন্দী থেকে ৮ নভেম্বর জামিনে বেরিয়ে আসেন। মামলা চলছে।

সাংসদের লোকজন মামলা তুলে নিতে চাপ দিচ্ছেন। তার বাবাকে আটকে রেখে মীমাংসা করার নামে জোর করে স্ট্যাম্পে সই করিয়ে নেওয়া হয়েছে

প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষার প্রস্তুতি: কেমন আছে শাহাদাত, জানতে গতকাল শুক্রবার তাদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছে সে। কাল রোববার থেকে তার পরীক্ষা। গাইবান্ধা শহর থেকে প্রায় ৪২ কিলোমিটার দূরে সুন্দরগঞ্জ উপজেলার গোপালচরণ গ্রামের বামনডাঙ্গা সড়কঘেঁষা তাদের বাড়ি। বাড়ি বলতে টিনের ছাউনি, টিনের বেড়ার ১৪ হাত লম্বা, ৬ হাত চওড়া একটি ঘর। তার ভেতরে এক পাশে বিছানা পাতা চৌকি, এক পাশে বড় একটি টিনের সিন্দুক। মাঝখানে থালাবাসন রাখার একটি আলমারি। একটি নিচু টুল। এই হলো আসবাব। শাহাদাত ও তার বড় ভাই শামিম মিয়া বিছানায় বসে পড়ে। বড় ভাই এবার জেএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে। বাড়ির পাশেই গোপাল চরণ সরকারি প্রাথমিক এবং গোপাল চরণ উচ্চবিদ্যালয়ের ছাত্র তারা। শাহাদাত জানাল, পরীক্ষার প্রস্তুতি ভালোই হয়েছে। পড়ালেখা চালিয়ে যাবে, একদিন প্রকৌশলী হওয়ার স্বপ্ন তার। ছোটাছুটি করতে না পারার দুঃখ মনে থাকলেও ইদানীং এক আনন্দের উপলক্ষ সৃষ্টি হয়েছে তাদের বাড়িতে। নতুন বোন এসেছে মায়ের কোলে। এই হাত-পা ছুড়ে কাঁদে তো, এই আবার মিটিমিটি হাসে। গতকাল ৪০ দিন হলো ওর বয়স। শাহাদাত বেশ আনন্দের সঙ্গেই ঘোষণা করল, বোন খুব ফরসা। তাই নাম রাখা হয়েছে সুবর্ণা আক্তার সুমাইয়া।

শাহাদাতের বাবা বললেন, অভাবের সংসার। কোনো জমিজমা নেই। তাঁর বাবার ৬ শতাংশ জমিতে এই বসতঘর। বাবা জীবিত। ছোট ভাই আছেন। তিন পরিবারের তিনটি টিনের ঘর নিয়ে এই বাড়ি। মাঝে এক চিলতে উঠানে চুলা। সেখানেই তিন পরিবারের রান্না। হাঁড়ি-পাতিল বিক্রি করে মাসে ৫-৬ হাজার টাকা আয় হয়। তাই দিয়ে সংসার চলে। শাহাদাতের চিকিৎসার জন্য সব মিলিয়ে ৯৮ হাজার টাকা খরচ হয়েছিল। তবে জেলা ও পুলিশ প্রশাসন, ব্র্যাকসহ আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান আর্থিক সাহায্য দিয়েছিল মোট ৬৫ হাজার টাকা। বাকি ঘাটতি মেটাতে এক বেসরকারি সংস্থা থেকে ৩০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিলেন। সপ্তাহে ৮০০ টাকার কিস্তিতে ৪৫ সপ্তাহে সেই ঋণ শোধ হয়েছে। তবে তাঁর দুঃখ, সাংসদের লোকেরা প্রচার করে বেড়াচ্ছে, অনেক টাকা নিয়ে তিনি নাকি মীমাংসা করে ফেলেছেন। ফেরি করতে গ্রামে বের হলে লোকমুখে এখন শুনতে হচ্ছে, সাংসদের কাছ থেকে নাকি ৩০-৩৫ লাখ টাকা পেয়েছেন।

সাজু মিয়ার সহজ-সরল প্রশ্ন, ‘হামি ছোটমোটো মানুষ। এমপির কি হামার সাতে এমন করা শোভা পায়, কন বাহে?’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *