ঢাকা; উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে শিশু ধর্ষণ ও নির্যাতনের ঘটনা। ঘরে কিংবা বাইরে, শহরে কিংবা গ্রামে। সবখানেই ঘটছে এ ধরনের ঘটনা। দিন দিন এ চিত্র ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। শিশু ধর্ষণ, গণধর্ষণ কিংবা ধর্ষণের পর হত্যা। অপরাধ বিজ্ঞানী ও সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করছেন, এ অবস্থা সমাজের চরম অবক্ষয়ের বহিঃপ্রকাশ। মানুষ নৈতিকতার শূন্যের কোঠায় পৌঁছলেই
কেবল এমন ঘটনা ঘটাতে পারে। বিচারহীনতাও কোনো কোনো ক্ষেত্রে এ ধরসের ঘটনাকে উৎসাহিত করে বলে মত তাদের। তাদের মতে, এমন বর্বরতার শাস্তি না হওয়ায় ধর্ষণের ঘটনা ও মামলার সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বাড়ছে।
এ বছরের শুরু থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত গত ৯ মাসে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৩২৫ শিশু। মাসওয়ারি পরিসংখ্যানে দেখা যায়, জানুয়ারি মাসে ৩৩, ফেব্রুয়ারি মাসে ৩৪, মার্চে ২৯, এপ্রিলে ৪২, মে মাসে ৪৪, জুনে ৩৯, জুলাইয়ে ৩৩, আগস্টে ৩৭ এবং সেপ্টেম্বরে ৩৪ জন শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। অর্থাৎ প্রতিমাসে গড়ে ৩৭টি শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এদের মধ্যে গণধর্ষণের শিকার হয়েছে ৪৮টি শিশু, ৩১টি প্রতিবন্ধী বা বিশেষ শিশু ধর্ষিত হয়েছে আর ৫টি শিশু গৃহকর্মীর কর্মস্থলে ধর্ষিত হয়েছে। এই সময়ে মধ্যে ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হয়েছে ১৫টি শিশু। অর্থাৎ প্রতি দুই মাসে একজন শিশু ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হয়েছে। শিশু অধিকার ফোরামের প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, এই সময়ের মধ্যে ৫৪ জন শিশুকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে। এছাড়া ইভটিজিং, শ্লীলতাহানী, যৌন হয়রানি, মারধর ও লাঞ্ছনার শিকার হয়েছে আরো ৭৮ শিশু। শিশুদের অধিকার নিয়ে কাজ করা ‘বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম’ এসব তথ্য দিয়েছে।
ধর্ষণের ঘটনাগুলো পর্যালোচনা করে তারা বলছে, ৫ বছরের শিশু থেকে ১৮ বছরের শিশু কেউই ঝুঁকিমুক্ত নয়। ধর্ষিত শিশুদের অধিকাংশের বয়সই ৫-১২ এর মধ্যে। এদের নানা কৌশলে ধর্ষণ করা হচ্ছে। ৫-১২ বছরের শিশুদের ধর্ষণ করা হচ্ছে চকলেট, খেলনা বা কোনো শৌখিন জিনিস দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে এবং কোনো নির্জন স্থানে বা বাড়িতে একা পেয়ে। ১৩-১৮ বছরের শিশুদের ধর্ষণ করা হয়েছে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে, জোরপূর্বক তুলে নিয়ে গিয়ে এবং কোনো নির্জন স্থানে বা বাড়িতে একা পেয়ে।
এর আগের বছর ২০১৫ সালে শিশু ধর্ষণের ঘটনা ঘটে ৫২১টি। যাদের মধ্যে ৯৯টি শিশু গণধর্ষিত হয়েছে, ৩০টি শিশুকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে এবং ৪টি শিশু ধর্ষণের অপমান সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেছে। ২০১৪ সালে এ সংখ্যা ছিল ১৯৯টি। যাদের মধ্যে ২২টি শিশু গণধর্ষিত হয়েছে, ২১টি শিশুকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে এবং ২৩টি শিশু ধর্ষণের অপমান সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেছে। ২০১৩ এবং ২০১২ সালে যথাক্রমে ১৭০ এবং ৮৬টি শিশু ধর্ষিত হয়েছিল বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের গবেষণা অনুযায়ী এ বছর সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ইভটিজিং-এর শিকার হয়েছে ৩৭টি মেয়ে শিশু, বখাটেদের দ্বারা শ্রীলতাহানি এবং যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে ১৮টি মেয়ে শিশু এবং বখাটেদের প্রেম-বিয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান এবং প্রতিবাদ করায় হামলা, মারধর ও লাঞ্ছনার শিকার হয়েছে ২৩টি মেয়ে শিশু। যাদের মধ্যে অনেকেই হুমকিতে বিদ্যালয়ে গমন সাময়িক বন্ধ করতে বাধ্য হয়। ২০১৫ সালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাতায়াতকালে ৬১টি মেয়ে শিশু বখাটেদের উৎপাত ইভটিজিংয়ের শিকার হয়েছিল, বখাটেদের দ্বারা লাঞ্ছিত হয়েছিল অন্তত ৮টি মেয়ে শিশু এবং বখাটেদের প্রতিহত করতে গিয়ে হামলায় আহত হয় ১০ জন অভিভাবক।
এদিকে শিশু ধর্ষণের ঘটনা ক্রমাগত বৃদ্ধির কারণ অনুসন্ধানে বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম বেশকিছু বিষয় তুলে ধরেছে। তারা বলছে, প্রথমত, নির্যাতন করার পরও অপরাধীকে আইনের আওতায় না আনা। এ সম্পর্কিত আইন থাকলেও তা উপেক্ষিত হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, মামলা হলে যে চার্জশিট দেয়া হয় তাতে আইনের ফাঁক-ফোকর থাকে। নির্যাতিত শিশু দরিদ্র, সুবিধাবঞ্চিত আর অপরাধীরা ক্ষমতাবান প্রভাবশালী ফলে মামলা গতি হারায়। শিশুর পক্ষে সাক্ষী পাওয়া যায় না। দরিদ্র অভিভাবক অনেক সময় অল্প টাকায় আসামির সঙ্গে আপস করে মামলা তুলে নেয়া। আবার অনেক সময় ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটলে গরিব হওয়া সত্ত্বেও সম্মান খোয়ানোর ভয়ে নির্যাতিত শিশুর অভিভাবক মামলা করেন না। আবার মামলা করলেও আসামিপক্ষের আইনজীবীর নোংরা জেরা এবং দীর্ঘ সময় ধরে মামলা চলায় তাদের পক্ষে মামলা চালিয়ে নেয়াও সম্ভব হয় না। ফলে সমাজে শিশু ধর্ষণের ঘটনা বেড়ে চলেছে। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম মনে করে, অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিয়ে রায় দ্রুতগতিতে কার্যকর করলে এ অপরাধ কমে যাবে। যেসব নির্যাতিত দরিদ্র শিশুর পিতামাতার মামলা করার বা মামলা চালানোর সামর্থ্য নেই তাদের সরকারি সহায়তা নিশ্চিত করারও দাবি জানায় সংস্থাটি।
এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের অধ্যাপক জিয়া রহমান বলেন, আমাদের সমাজ একটি ট্রানজিশনের মধ্যে আছে। আমরা মডার্ন সোসাইটির দিকে যাচ্ছি। নানা রকমের এফেক্ট আমাদের মনোস্তত্ত্বে এসে পড়ছে। যৌন বিষয়টি আমাদের সমাজে এক সময় হিডেন ছিল, কিন্তু এখন এমন সব উপাদান আসছে যে, আমাদের ট্রেডিশনাল সোসাইটিতে বিকৃতভাবে কাজ করছে। আগে একটা ট্রেডিশনাল সমাজ ছিল, ট্রেডিশনাল চেকআপ ছিল, পরিবারের একটা ভূমিকা ছিল, ছেলে-মেয়েরা খেলাধুলায় মগ্ন থাকতো। এসব এখন শেষের পথে। প্রযুক্তির উন্নতিতে মানুষ এখন ‘সো কলড’ বিনোদন খুঁজে। কার সঙ্গে কী আচরণ করতে হবে সেটা ভুলে যাচ্ছে। আগে ছেলে-মেয়েরা প্রেম করলেও তাদের মধ্যে দৈহিক সম্পর্কের চিন্তা আসতো না, কিন্তু এখন এটা কমন হয়ে গেছে। যৌন বিষয়টি যে কেউ চাইলেই অবদমন করতে পারে, কিন্তু তা না করে অসহায়ের ওপর আক্রমণ করে। শিশু যেহেতু অসহায় তাই তারা তাদেরকেই বেছে নেয়। এই অপরাধ বিজ্ঞানী বলেন, এই অবস্থা থেকে উত্তরণে সমাজের মধ্যে নৈতিক শিক্ষাটা খুব জরুরি। এছাড়া যারা ঘটনার সঙ্গে জড়িত তাদের দ্রুত বিচার করলে এবং শাস্তি নিশ্চিত করলে এই ধরনের অপরাধ কমে আসবে। সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক মাসুদা এম. রশিদ চৌধুরী বলেন, শিশু ধর্ষণের অন্যতম কারণ- অপরাধীরা ধরা পড়ছে না, ধরা পড়লেও বিচার হচ্ছে না, আবার বিচার হলেও তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হচ্ছে না। তিনি বলেন, যারা এই ধরনের অপরাধ করছে তারা ইচ্ছাকৃতভাবেই করছে। ফলে তাদের শাস্তি নিশ্চিত করতে পারলেই অন্যরা সতর্ক হবে। এই সমাজবিজ্ঞানী আরো বলেন, সমাজে এ ধরনের যে ঘটনা ঘটছে, দু-একদিন তা ফলাও করে প্রকাশও করা হচ্ছে। কিন্তু পরবর্তীকালে এ নিয়ে আর কোনো ফলোআপ দেখা যাচ্ছে না। ফলে নিমিষেই নৃশংস এই ঘটনাগুলো আড়ালে চলে যাচ্ছে। শিশুর সুরক্ষায় পিতামাতাকে সন্তানদের প্রতি সচেতনতা বাড়ানোর এবং চোখে চোখে রাখারও পরামর্শ দেন তিনি।
এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের অধ্যাপক জিয়া রহমান বলেন, আমাদের সমাজ একটি ট্রানজিশনের মধ্যে আছে। আমরা মডার্ন সোসাইটির দিকে যাচ্ছি। নানা রকমের এফেক্ট আমাদের মনোস্তত্ত্বে এসে পড়ছে। যৌন বিষয়টি আমাদের সমাজে এক সময় হিডেন ছিল, কিন্তু এখন এমন সব উপাদান আসছে যে, আমাদের ট্রেডিশনাল সোসাইটিতে বিকৃতভাবে কাজ করছে। আগে একটা ট্রেডিশনাল সমাজ ছিল, ট্রেডিশনাল চেকআপ ছিল, পরিবারের একটা ভূমিকা ছিল, ছেলে-মেয়েরা খেলাধুলায় মগ্ন থাকতো। এসব এখন শেষের পথে। প্রযুক্তির উন্নতিতে মানুষ এখন ‘সো কলড’ বিনোদন খুঁজে। কার সঙ্গে কী আচরণ করতে হবে সেটা ভুলে যাচ্ছে। আগে ছেলে-মেয়েরা প্রেম করলেও তাদের মধ্যে দৈহিক সম্পর্কের চিন্তা আসতো না, কিন্তু এখন এটা কমন হয়ে গেছে। যৌন বিষয়টি যে কেউ চাইলেই অবদমন করতে পারে, কিন্তু তা না করে অসহায়ের ওপর আক্রমণ করে। শিশু যেহেতু অসহায় তাই তারা তাদেরকেই বেছে নেয়। এই অপরাধ বিজ্ঞানী বলেন, এই অবস্থা থেকে উত্তরণে সমাজের মধ্যে নৈতিক শিক্ষাটা খুব জরুরি। এছাড়া যারা ঘটনার সঙ্গে জড়িত তাদের দ্রুত বিচার করলে এবং শাস্তি নিশ্চিত করলে এই ধরনের অপরাধ কমে আসবে। সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক মাসুদা এম. রশিদ চৌধুরী বলেন, শিশু ধর্ষণের অন্যতম কারণ- অপরাধীরা ধরা পড়ছে না, ধরা পড়লেও বিচার হচ্ছে না, আবার বিচার হলেও তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হচ্ছে না। তিনি বলেন, যারা এই ধরনের অপরাধ করছে তারা ইচ্ছাকৃতভাবেই করছে। ফলে তাদের শাস্তি নিশ্চিত করতে পারলেই অন্যরা সতর্ক হবে। এই সমাজবিজ্ঞানী আরো বলেন, সমাজে এ ধরনের যে ঘটনা ঘটছে, দু-একদিন তা ফলাও করে প্রকাশও করা হচ্ছে। কিন্তু পরবর্তীকালে এ নিয়ে আর কোনো ফলোআপ দেখা যাচ্ছে না। ফলে নিমিষেই নৃশংস এই ঘটনাগুলো আড়ালে চলে যাচ্ছে। শিশুর সুরক্ষায় পিতামাতাকে সন্তানদের প্রতি সচেতনতা বাড়ানোর এবং চোখে চোখে রাখারও পরামর্শ দেন তিনি।