ঢাকা; ‘‘মেয়েটির উপর কী ধরনের অত্যাচার হয়েছে তা না দেখলে বোঝা যাবে না৷মেয়েটির দিকে তাকাতে পারি না৷’’ কথাগুলো বলছিলেন দিনাজপুরের পাঁচ বছর বয়সি ধর্ষিতা শিশুর বাবা৷ তিনি জানালেন, ধর্ষককে মেয়েটি ‘বড় জ্যাঠা’ বা ‘বড় আব্বু’ বলে ডাকত৷পেশায় তিনি পিকআপ ভ্যানচালক৷ তিনি যে পিকআপটি চালান সেটির মালিক এনায়েত কবির পলাশও এ সময় তাঁর সঙ্গে ছিলেন৷ মেয়েকে নিয়ে হাসপাতালে দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে এমনই অবস্থা যে ঠিকমতো কথাই বলতে পারছেন না মেয়েটির বাবা৷ ঢাকা মেডিকেল কলেজে তাঁর পাশে বসেই ডয়চে ভেলেকে পুরো ঘটনা খুলে বললেন পলাশ৷ মাঝে মধ্যে শিশুটির বাবা শুধু প্রয়োজনীয় কিছু তথ্য যোগ করেছেন৷ দিশেহারা এই পিতা অনেকটাই ভেঙে পড়েছেন৷
পলাশ জানান, গত মঙ্গলবার শিশুটি নিখোঁজ হয়৷ অনেক খোঁজাখুজি করেও না পেয়ে মাইকিং, মসজিদে ঘোষণা দেওয়াসহ নানাভাবে শিশুটির খোঁজ করা হয়৷ তারপরও সেদিন আর শিশুটিকে পাওয়া যায়নি৷ পরের দিন ভোরে শিশুটিকে তার বাড়ির কাছে একটি হলুদখেতে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় পাওয়া যায়৷ প্রথমে স্থানীয় হাসপাতাল, তারপর রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল হয়ে শিশুটি পৌঁছে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসি)। এখন তাকে রাখা হয়েছে ঢাকা মেডিক্যালের পোষ্ট অপারেটিভ ওয়ার্ডে৷শিশুটির সঙ্গে তার বাবা, মা ছাড়াও আছেন দিদিমা (মায়ের মা)। আর আছেন পলাশ৷ সেই দিনাজপুর থেকেই পলাশ আছেন ৫ বছর বয়সি ধর্ষিতা মেয়েটি ও তার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে৷
ওসিসির সমন্বয়কারী ডা. বিলকিস বেগমের সঙ্গে কথা হলো৷ শিশুটির বর্তমান অবস্থা জানাতে গিয়ে তিনি বললেন, ‘‘শিশুটির প্রজনন অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে৷ মাথায় আঘাতের চিহ্ন৷ সারা শরীরে বিভিন্ন ক্ষতচিহ্ন৷ শিশুটি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে৷ শরীরে ধরলেই ব্যথা পাচ্ছে।”
তিনি আরো জানান, ‘‘ইতিমধ্যে তার একটি ছোট্ট অপারেশনও হয়েছে৷ বুধবার ৯ সদস্যের মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করা হয়েছে৷ সিনিয়র চিকিৎসকরা আছেন এই কমিটিতে৷ বৃহস্পতিবার সকালে মেডিক্যাল বোর্ড মিটিংয়ে বসবে৷ তখনই সিদ্ধান্ত হবে শিশুটির কী চিকিৎসা দরকার। তবে সে আশঙ্কামুক্ত এ কথা এখনো বলা যাচ্ছে না৷” ঢাকা মেডিক্যালের পোষ্ট অপারেটিভের সামনে কথা হয় শিশুটির বাবার সঙ্গে৷ তিনি জানান, যে ধর্ষণ করেছে, তাকে মেয়ে ‘বড় জ্যাঠা’ বা ‘বড় আব্বু’ বলে ডাকত৷ আর তিনি নিজেও তাকে বড় ভাইয়ের মতোই দেখতেন৷ কোনো দ্বন্দ্ব বা শত্রুতা ছিল না৷ মেয়েটিই তাদের একমাত্র সন্তান৷
এনায়েত কবির পলাশ বলেন, ‘‘শিশুটির যখন জ্ঞান ফেরে, তখন সে শুধু জানায়, তাকে রাস্তা থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে৷ কে তাকে ব্যথা দিয়েছে, জানতে চাইলে চুপ করে থাকে৷ পরিবারের পরিচিত ৩৮ বছর বয়সী সাইফুল ইসলামের নাম বলতেই মাথা নেড়ে ‘হ্যাঁ’ বলে৷” পুলিশ সাইফুলকে গ্রেফতার করেছে৷ শিশুটির বাবা নারী নির্যাতন আইনে মামলা করেছেন।
চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, শিশুটির প্রজনন অঙ্গের ক্ষত হাড় পর্যন্ত পৌঁছেছে৷ এর ফলে ওই অঙ্গে সংক্রমণ দেখা দিয়েছে৷ তাই এই সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণই এখন গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন চিকিৎসকেরা৷
হাসপাতালের শিশু সার্জারি বিভাগের প্রধান আশরাফ-উল হক বুধবার সাংবাদিকদের বলেন, ‘ধারালো অস্ত্র দিয়ে শিশুটির প্রজনন অঙ্গ ক্ষতবিক্ষত করা হয়েছে৷ শিশুটির শরীরে অস্ত্রোপচারের জন্য আমাদের এক থেকে দুই মাস অপক্ষা করতে হবে৷”চিকিৎসার ব্যয়ভার কে বহন করছেন জানতে চাইলে এনায়েত কবির পলাশ, ‘‘মেয়েটির বাবা গরীব, তাই ওর চিকিৎসার জন্য ফেসবুকে আমরা একটা বিকাশ নম্বর দিয়েছিলাম৷ তখন ৫০-১০০ টাকা করে অনেকেই দিয়েছেন৷ কিন্তু ঢাকা মেডিক্যালে এসে প্রধানমন্ত্রী বিশেষ সহকারী শাকিল ভাই যখন ওর চিকিৎসার দায়িত্ব নিলেন, তখন আমরা ওই নম্বরটি বন্ধ করে দিয়েছি৷ ফেসবুকে লিখে দিয়েছি, আমাদের আর সাহায্যের দরকার নেই৷ আমরা এখন শুধু শিশুটির দ্রুত চিকিৎসা ও রোগমুক্তি চাই৷”
দুপুরে পোষ্ট অপারেটিভে শিশুটির পাশে বসে থাকতে দেখা গেল তার দিদিমাকে৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘আমরা গরীব কিন্তু সাহায্যের দরকার নেই৷ আমরা চাই শুধু ভালো চিকিৎসা৷ অনেকেই এসে আমাদের গরু কিনে দিতে চাচ্ছেন, এটা-ওটা দিতে চাচ্ছেন৷ কিন্তু কেউ কিছু দিলে যেন আমাদের সরাসরি দেন৷ এ হাত-ও হাত হয়ে কেউ ১০ টাকা দিলে আমাদের কাছে দুই টাকা আসছে৷ এটা আমাদের দরকার নেই৷”
বৃহস্পতিবার সকালে মেডিক্যাল বোর্ড শিশুটির চিকিৎসার পরবর্তী করণীয় স্থির করবেন৷ তবে লম্বা সময় ধরে যে তার চিকিৎসা লাগবে সেটা আপাতত নিশ্চিত করেই বলে দিয়েছেন চিকিৎসকরা৷