ঢাকা; রীতিমতো বিস্ময় তৈরি করেছে গবেষণাটি। বলা হয়েছে, এ চিত্র ঢাকার। দেশের অন্যান্য অঞ্চলের চিত্রও আলাদা নয়। এ এক অন্যরকম সময়। হাতে হাতে স্মার্টফোন। মানুষের আঙুল চলছে। মুখ বন্ধ। পৃথিবীটা যেন হাতের মুঠোয়। বৈপ্লবিক পরিবর্তন। বেশির ভাগই ইতিবাচক। তবে কিছু দিক ভয়ঙ্কর।
বাবা-মায়েরা ব্যস্ত। সন্তানকে হয়তো সময় দিতে পারেন না আগের মতো। যৌথ পরিবার ব্যবস্থা বিলুপ্তপ্রায়। নেই খেলার মাঠ। স্কুলপড়ুয়া ছেলেমেয়েদের কাছে স্মার্টফোন-কম্পিউটার-ল্যাপটপ। ইন্টারনেট হাজির দরজায়। বিস্ময়কর। কিন্তু ঘটনা সত্য। আইনে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ হলেও বাংলাদেশে প্রতিনিয়ত ইন্টারনেটে আপলোড হচ্ছে পর্নোগ্রাফি। এক মোবাইল ফোন থেকে আরেক মোবাইল ফোনেও ছড়িয়ে পড়ছে তা। এসব পর্নোগ্রাফিতে দেখা যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন নামকরা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছেলেমেয়েদের। দেখা যায় স্কুলপড়ুয়া শিশুদেরও। রয়েছেন গৃহবধূ, টিভি তারকারাও। অন্যদিকে এসব পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত হয়ে পড়ছে উঠতি বয়সী কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণীরা। এমনকি স্কুলগামী শিশুদের একটি বড় অংশ নিয়মিত এই পর্নোগ্রাফি দেখছে। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন নামে একটি সংস্থার গবেষণায় দেখা যায়, ঢাকায় স্কুলগামী শিক্ষার্থীদের শতকরা ৭৭ ভাগ নিয়মিত পর্নোগ্রাফি দেখছে। সংস্থাটি বলছে, সারা দেশেই এই চিত্র ভয়াবহ। তাদের মতে, অভিভাবকদের অসচেতনতা ও শিশুর জীবনদক্ষতার অভাবে পর্নোগ্রাফির এই ঝুঁকি বাড়ছে। এক্ষেত্রে শিশুরা জড়িয়ে পড়ছে। ফলে একটি বিকৃত যৌন শিক্ষার মধ্যে দিয়ে তারা বেড়ে উঠছে। পর্নোগ্রাফির সঙ্গে শিশুরা যুক্ত হয়ে সমাজে বিভিন্ন ধরনের যৌন সহিংসতা তৈরি করছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই এ পর্নোগ্রাফিতে যাদের দেখানো যাচ্ছে তাদের বেশির ভাগের বয়সই ১৮ বছরের নিচে। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী। সংস্থাটি বলছে, সামাজিকভাবে হেয় এবং ব্ল্যাকমেইল করতে এ ভিডিওগুলো তৈরি করা হয়। সমাজে মেয়েটি অথবা ছেলেটির পরিবারকে খাটো করতে, অর্থলোভে অথবা নানা ধরনের যৌন শোষণে বা বারবার শারীরিক সম্পর্ক করতে বাধ্য করার জন্যও যৌন মিলনের ভিডিও ধারণ করা হয়।
জানা গেছে, ২০০০ সালের আগে বাংলাদেশে পর্নোগ্রাফির প্রাদুর্ভাব খুব বেশি ছিল না। বাংলাদেশি ছেলেমেয়েদেরও পর্নোভিডিও ছিল না বললেই চলে। ২০০০ সালের দিকে সুমন নামে এক যুবক বিদেশ থেকে দেশে ফিরে একটি মেয়ের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করে তা হ্যান্ডি ক্যামেরায় ধারণ করে। পরে তা ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেয়। তখনও প্রযুক্তির সহজলভ্যতা না থাকায় খুব বেশি আলোচনায় আসেনি। কিন্তু প্রযুক্তির উৎকর্ষতার সঙ্গে সঙ্গে এই বিষয়টির ভয়াবহ প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। এখন এসব ভিডিও মুহূর্তেই ছড়িয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন মাধ্যমে। ২০১২ সালের বাংলাদেশ পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইনে পর্নোগ্রাফি বলতে যে অশ্ল্লীলতাকে বোঝায় তা মূলত তিন ধরনের- ভিডিও, অডিও এবং লিখিতরূপে বা ছবি আকারে। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন বলছে, বর্তমানে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যপকতা, বিশেষ করে মোবাইল ফোনে ভিডিও রেকর্ডিং সুবিধা ও ইন্টারনেটের মাধ্যমে তা সহজে ছড়িয়ে দেয়ার সুযোগ থাকায় প্রচুর পরিমাণে ভিডিও তৈরি হচ্ছে। গবেষণায় বলা হয়, বাংলাদেশে কমার্শিয়াল পর্নোগ্রাফির চেয়ে অ্যামেচার পর্নোগ্রাফি বেশি জনপ্রিয়। বিশ্বের বহু দেশেই লাইসেন্সকৃতভাবে পর্নোগ্রাফি নির্মাণ ও প্রদর্শনের ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের পর্নোগ্রাফি আইনে তা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এখানে পর্নো ভিডিও তৈরি হয় ভিন্ন কারণে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, পর্নো ভিডিওটি তৈরির ব্যাপারে নারীটি জানেন না। তার অগোচরেই ধারণ করা হয় তা। অনেক সময় সম্পর্কের বিশেষ পর্যায়ে ভিডিও ধারণ করা হয়। পরে কোনো কারণে সম্পর্ক ভেঙে গেলে তা ছড়িয়ে দেয়া হয়। আবার অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় নারী-পুরুষ কেউই জানেন না। এক্ষেত্রে তৃতীয় একটি পক্ষ লুকিয়ে ভিডিওটি তৈরি করছে। তথ্যমতে, রাজধানীতে এমনও বাড়ি রয়েছে প্রতারকচক্র যেটি শুধুমাত্র এই কাজের জন্যই ব্যবহার করে। তবে যেভাবেই তৈরি হোক এক সময় তা ছড়িয়ে পড়ছে ইন্টারনেটে। ইন্টারনেটে ভিডিও, অডিও বা ছবিগুলো আপলোড করতে কোন গেটপাস দরকার হয় না। কারণ এ সম্পর্কিত অধিকাংশ সাইটগুলো দেশের বাইরে বিশেষ করে পশ্চিমা দেশগুলো থেকে পরিচালনা করা হয়। সেখানে কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। ফলে যে কেউ আপলোড করতে পারে। এভাবে একবার কোনো পর্নো সাইটে আপলোড হলে ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন সাইটে। ফলে তা আর রোধ করা সম্ভব হয় না। পরিণতিতে অনেকেই আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছে। অনেকেই সামাজিকভাবে কোনঠাসা হয়ে পড়ছে। বন্ধুমহলেও বিরুপ আচরণের শিকার হচ্ছেন।
পর্নো আসক্তি শিশুদের মনোজগতের ওপর বিরাট প্রভাব বিস্তার করে। তাদের করে তোলে সহিংস। প্রখ্যাত মনোবিজ্ঞানী মোহিত কামাল এ প্রসঙ্গে মানবজমিনকে বলেন, পর্নো দেখে শিশুরা অল্প বয়সেই যৌনতার প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে। এতে শিশুর মনোজগতে বিরূপ প্রভাব পড়ছে। যেখানে ১১-১২ বছর বয়সে যৌনতার ধারণা আসার কথা সেখানে আরো আগেই এ বিষয়ে তাদের চিন্তা জগত আক্রান্ত হচ্ছে। তাদের মধ্যে ভোগবাদী সত্তা তৈরি হচ্ছে। ফলে তারা নানা ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। তাদের মধ্যে অস্তিত্বহীনতা, নৈতিকতার অভাব দেখা দিচ্ছে। মমত্ববোধ হারিয়ে যাচ্ছে। শিশুদের মধ্যে নৈতিক অনুশাসন থাকছে না। পর্নো ভিডিওতে আসক্তির কারণে পারিবারিক এবং দাম্পত্য কলহ তৈরি হচ্ছে। এই অবস্থাটি সমাজের জন্য অত্যন্ত ভীতিকর উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমাদের এমন একটি উপায় বের করা উচিত, যাতে এই সাইটগুলো বন্ধ করা যায়।
শিশুদের পর্নো আসক্তির ব্যাপারে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের শিশু সুরক্ষা কর্মসূচির সমন্বয়ক আবদুল্লাহ আল মামুন মনে করেন, এক্ষেত্রে বাবা-মায়ের অসচেতনার চেয়ে অজ্ঞানতা বেশি দায়ী। তারা শিশুদের হাতে যে ডিভাইসগুলো তুলে দিচ্ছে তাতে ভালো কিছু সার্চ দিতে গিয়েও পর্নো সাইটে চলে যাচ্ছে। এভাবে না চাইলেও শিশুরা পর্নো জগতের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছে। যথেষ্ট জ্ঞান না থাকার কারণে বাবা-মায়েরা দামি মোবাইল, ট্যাবসহ ইন্টারনেট শিশুর হাতে তুলে দিচ্ছেন। কিন্তু এ ব্যাপারে কোনো নির্দেশ প্রদান করতে পারছেন না। পাশাপাশি কিছু সেলিব্রেটি, জনপ্রিয় মিডিয়া ব্যক্তিত্বদের পর্নো ভিডিও বাজারে ছাড়া হচ্ছে। এতে শিশুরা আগ্রহী হচ্ছে। তিনি বলেন, আইনত ১৮ বছরের কম কারো নামে মোবাইল সিম রেজিস্ট্রেশন করা যায় না। তাহলে তারা যে মোবাইলগুলো ব্যবহার করে তা তাদের বাবা-মা বা স্বজনদের নামে রেজিস্ট্রেশন করা। এক্ষেত্রে তাদেরও দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেয়া উচিত। আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, শিক্ষার্থীদের জন্য যদি নির্দিষ্ট ইন্টারনেট প্যাকেজ দেয়া হয় যেখানে কিছু শব্দ ব্লক করা থাকবে। তাহলে তারা অশ্লীল সাইটে প্রবেশ করতে পারবে না। টেলিফোন অপারেটর কোম্পানিগুলো এই উদ্যোগ নিতে পারে। অনেক দেশেই এই ব্যবস্থা আছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন অ্যান্ড রেগুলেটরি কমিশনের (বিটিআরসি) একটা ভূমিকা রয়েছে। তারা চাইলে এই কাজগুলো করতে পারে। প্রথমে কে আপলোড করেছে তার আইডিও বের করতে পারে। শাস্তি নিশ্চিত হলে এগুলো কমে যাবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের অধ্যাপক জিয়া রহমান বলেন, আমরা এখন একটা পরিবর্তনের ট্রানজিশনাল স্টেজে আছি। মর্ডান হচ্ছি, উন্নয়ন হচ্ছে, প্রযুক্তিতে উন্নত হচ্ছি। এই অবস্থায় যেকোন সমাজের ক্রিমিনাল অ্যাক্টিভিটিজ ঘটে। মানুষের অধিকার, স্বাধীনতা বেড়ে যায়। এই অবস্থায় মানুষ সমাজের সঙ্গে পুরোপুরি খাপ খাওয়াতে পারে না। উন্নয়নের মাধ্যমগুলো ব্যবহার করতে নিয়ম-কানুন দরকার হয় সেটা বুঝতে পারে না। একটা জিনিস কতটুকু ব্যবহার করতে পারবো তার একটা সীমানা থাকা দরকার হয় কিন্তু সেগুলো তাৎক্ষণিকভাবে বুঝতে পারে না। পুঁজিবাদী সমাজে মোবাইল কোম্পানিও নানাভাবে বিজ্ঞাপন দিয়ে আকৃষ্ট করে। অনেক সময় নেগেটিভ বিষয়ও চলে আসে। সর্বোপরি সামগ্রিক পরিবর্তনের ফলে তরুণ সমাজের ওপর একটা নেগেটিভ বিষয় গ্রহণ করার প্রবণতা তৈরি হয়। ট্রানজিশনাল স্টেজে এগুলো সব সমাজেই হয়েছে। তিনি আশা প্রকাশ করেন, ধীরে ধীরে অভিভাবকদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি হবে, আমরা কথা বলবো এই নিয়ে, লেখালেখিও হবে। তরুণ সমাজও এক সময় পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ-খাইয়ে এসব বিকৃত বিষয় পরিত্যাগ করবে। তিনি বলেন, আমেরিকান সোসাইটি, কানাডিয়ান সোসাইটির কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলে পর্নো সাইটগগুলোতেও ঢুকা যাবে না। সেখানে পর্নোসাইটের সার্ভারগুলো ব্লক করে দেয়া আছে। আমাদের সমাজেও এমনটা হবে। এবং সেটা নির্ভর করবে রেগুলেটরি এজেন্সি কতটুকু রেগুলেট করবে তার ওপর।
পর্নোগ্রাফি যে শুধু মানুষের মনোজগত ওলট-পালট করে দেয় তা-ই নয়। বাংলাদেশে পর্নোগ্রাফির শিকার হয় অনেককে প্রাণও দিতে হয়েছে। ১৩ বছরের শাহানারা খাতুন। সাতক্ষীরার একটি গার্লস স্কুলের ৮ম শ্রেণির এই ছাত্রী গত বছরের ১২ই ডিসেম্বর আত্মহত্যা করে। তার এই আত্মহত্যার কারণ ছিল ফটোশপে তৈরি করা তার একটি অশ্লীল ছবি। ছবিটি ইন্টারনেটের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছিল স্কুল-কলেজের উঠতি বয়সী শিক্ষার্থী ও এলাকার বখাটেদের হাতে হাতে। এরপর এলাকার পরিবেশ তার জন্য হয়ে ওঠে নরকযন্ত্রণা। পরিণতিতে আত্মহননের পথ বেছে নেয় সে। শুধু শাহানারা নয়, ওই বছর অশ্লীল ভিডিও বা পর্নোগ্রাফির শিকার হয়ে আত্মহনন করে অন্তত ৫ জন। প্রতি বছরই এমন ঘটনা ঘটছে।
বাবা-মায়েরা ব্যস্ত। সন্তানকে হয়তো সময় দিতে পারেন না আগের মতো। যৌথ পরিবার ব্যবস্থা বিলুপ্তপ্রায়। নেই খেলার মাঠ। স্কুলপড়ুয়া ছেলেমেয়েদের কাছে স্মার্টফোন-কম্পিউটার-ল্যাপটপ। ইন্টারনেট হাজির দরজায়। বিস্ময়কর। কিন্তু ঘটনা সত্য। আইনে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ হলেও বাংলাদেশে প্রতিনিয়ত ইন্টারনেটে আপলোড হচ্ছে পর্নোগ্রাফি। এক মোবাইল ফোন থেকে আরেক মোবাইল ফোনেও ছড়িয়ে পড়ছে তা। এসব পর্নোগ্রাফিতে দেখা যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন নামকরা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছেলেমেয়েদের। দেখা যায় স্কুলপড়ুয়া শিশুদেরও। রয়েছেন গৃহবধূ, টিভি তারকারাও। অন্যদিকে এসব পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত হয়ে পড়ছে উঠতি বয়সী কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণীরা। এমনকি স্কুলগামী শিশুদের একটি বড় অংশ নিয়মিত এই পর্নোগ্রাফি দেখছে। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন নামে একটি সংস্থার গবেষণায় দেখা যায়, ঢাকায় স্কুলগামী শিক্ষার্থীদের শতকরা ৭৭ ভাগ নিয়মিত পর্নোগ্রাফি দেখছে। সংস্থাটি বলছে, সারা দেশেই এই চিত্র ভয়াবহ। তাদের মতে, অভিভাবকদের অসচেতনতা ও শিশুর জীবনদক্ষতার অভাবে পর্নোগ্রাফির এই ঝুঁকি বাড়ছে। এক্ষেত্রে শিশুরা জড়িয়ে পড়ছে। ফলে একটি বিকৃত যৌন শিক্ষার মধ্যে দিয়ে তারা বেড়ে উঠছে। পর্নোগ্রাফির সঙ্গে শিশুরা যুক্ত হয়ে সমাজে বিভিন্ন ধরনের যৌন সহিংসতা তৈরি করছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই এ পর্নোগ্রাফিতে যাদের দেখানো যাচ্ছে তাদের বেশির ভাগের বয়সই ১৮ বছরের নিচে। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী। সংস্থাটি বলছে, সামাজিকভাবে হেয় এবং ব্ল্যাকমেইল করতে এ ভিডিওগুলো তৈরি করা হয়। সমাজে মেয়েটি অথবা ছেলেটির পরিবারকে খাটো করতে, অর্থলোভে অথবা নানা ধরনের যৌন শোষণে বা বারবার শারীরিক সম্পর্ক করতে বাধ্য করার জন্যও যৌন মিলনের ভিডিও ধারণ করা হয়।
জানা গেছে, ২০০০ সালের আগে বাংলাদেশে পর্নোগ্রাফির প্রাদুর্ভাব খুব বেশি ছিল না। বাংলাদেশি ছেলেমেয়েদেরও পর্নোভিডিও ছিল না বললেই চলে। ২০০০ সালের দিকে সুমন নামে এক যুবক বিদেশ থেকে দেশে ফিরে একটি মেয়ের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করে তা হ্যান্ডি ক্যামেরায় ধারণ করে। পরে তা ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেয়। তখনও প্রযুক্তির সহজলভ্যতা না থাকায় খুব বেশি আলোচনায় আসেনি। কিন্তু প্রযুক্তির উৎকর্ষতার সঙ্গে সঙ্গে এই বিষয়টির ভয়াবহ প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। এখন এসব ভিডিও মুহূর্তেই ছড়িয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন মাধ্যমে। ২০১২ সালের বাংলাদেশ পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইনে পর্নোগ্রাফি বলতে যে অশ্ল্লীলতাকে বোঝায় তা মূলত তিন ধরনের- ভিডিও, অডিও এবং লিখিতরূপে বা ছবি আকারে। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন বলছে, বর্তমানে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যপকতা, বিশেষ করে মোবাইল ফোনে ভিডিও রেকর্ডিং সুবিধা ও ইন্টারনেটের মাধ্যমে তা সহজে ছড়িয়ে দেয়ার সুযোগ থাকায় প্রচুর পরিমাণে ভিডিও তৈরি হচ্ছে। গবেষণায় বলা হয়, বাংলাদেশে কমার্শিয়াল পর্নোগ্রাফির চেয়ে অ্যামেচার পর্নোগ্রাফি বেশি জনপ্রিয়। বিশ্বের বহু দেশেই লাইসেন্সকৃতভাবে পর্নোগ্রাফি নির্মাণ ও প্রদর্শনের ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের পর্নোগ্রাফি আইনে তা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এখানে পর্নো ভিডিও তৈরি হয় ভিন্ন কারণে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, পর্নো ভিডিওটি তৈরির ব্যাপারে নারীটি জানেন না। তার অগোচরেই ধারণ করা হয় তা। অনেক সময় সম্পর্কের বিশেষ পর্যায়ে ভিডিও ধারণ করা হয়। পরে কোনো কারণে সম্পর্ক ভেঙে গেলে তা ছড়িয়ে দেয়া হয়। আবার অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় নারী-পুরুষ কেউই জানেন না। এক্ষেত্রে তৃতীয় একটি পক্ষ লুকিয়ে ভিডিওটি তৈরি করছে। তথ্যমতে, রাজধানীতে এমনও বাড়ি রয়েছে প্রতারকচক্র যেটি শুধুমাত্র এই কাজের জন্যই ব্যবহার করে। তবে যেভাবেই তৈরি হোক এক সময় তা ছড়িয়ে পড়ছে ইন্টারনেটে। ইন্টারনেটে ভিডিও, অডিও বা ছবিগুলো আপলোড করতে কোন গেটপাস দরকার হয় না। কারণ এ সম্পর্কিত অধিকাংশ সাইটগুলো দেশের বাইরে বিশেষ করে পশ্চিমা দেশগুলো থেকে পরিচালনা করা হয়। সেখানে কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। ফলে যে কেউ আপলোড করতে পারে। এভাবে একবার কোনো পর্নো সাইটে আপলোড হলে ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন সাইটে। ফলে তা আর রোধ করা সম্ভব হয় না। পরিণতিতে অনেকেই আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছে। অনেকেই সামাজিকভাবে কোনঠাসা হয়ে পড়ছে। বন্ধুমহলেও বিরুপ আচরণের শিকার হচ্ছেন।
পর্নো আসক্তি শিশুদের মনোজগতের ওপর বিরাট প্রভাব বিস্তার করে। তাদের করে তোলে সহিংস। প্রখ্যাত মনোবিজ্ঞানী মোহিত কামাল এ প্রসঙ্গে মানবজমিনকে বলেন, পর্নো দেখে শিশুরা অল্প বয়সেই যৌনতার প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে। এতে শিশুর মনোজগতে বিরূপ প্রভাব পড়ছে। যেখানে ১১-১২ বছর বয়সে যৌনতার ধারণা আসার কথা সেখানে আরো আগেই এ বিষয়ে তাদের চিন্তা জগত আক্রান্ত হচ্ছে। তাদের মধ্যে ভোগবাদী সত্তা তৈরি হচ্ছে। ফলে তারা নানা ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। তাদের মধ্যে অস্তিত্বহীনতা, নৈতিকতার অভাব দেখা দিচ্ছে। মমত্ববোধ হারিয়ে যাচ্ছে। শিশুদের মধ্যে নৈতিক অনুশাসন থাকছে না। পর্নো ভিডিওতে আসক্তির কারণে পারিবারিক এবং দাম্পত্য কলহ তৈরি হচ্ছে। এই অবস্থাটি সমাজের জন্য অত্যন্ত ভীতিকর উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমাদের এমন একটি উপায় বের করা উচিত, যাতে এই সাইটগুলো বন্ধ করা যায়।
শিশুদের পর্নো আসক্তির ব্যাপারে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের শিশু সুরক্ষা কর্মসূচির সমন্বয়ক আবদুল্লাহ আল মামুন মনে করেন, এক্ষেত্রে বাবা-মায়ের অসচেতনার চেয়ে অজ্ঞানতা বেশি দায়ী। তারা শিশুদের হাতে যে ডিভাইসগুলো তুলে দিচ্ছে তাতে ভালো কিছু সার্চ দিতে গিয়েও পর্নো সাইটে চলে যাচ্ছে। এভাবে না চাইলেও শিশুরা পর্নো জগতের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছে। যথেষ্ট জ্ঞান না থাকার কারণে বাবা-মায়েরা দামি মোবাইল, ট্যাবসহ ইন্টারনেট শিশুর হাতে তুলে দিচ্ছেন। কিন্তু এ ব্যাপারে কোনো নির্দেশ প্রদান করতে পারছেন না। পাশাপাশি কিছু সেলিব্রেটি, জনপ্রিয় মিডিয়া ব্যক্তিত্বদের পর্নো ভিডিও বাজারে ছাড়া হচ্ছে। এতে শিশুরা আগ্রহী হচ্ছে। তিনি বলেন, আইনত ১৮ বছরের কম কারো নামে মোবাইল সিম রেজিস্ট্রেশন করা যায় না। তাহলে তারা যে মোবাইলগুলো ব্যবহার করে তা তাদের বাবা-মা বা স্বজনদের নামে রেজিস্ট্রেশন করা। এক্ষেত্রে তাদেরও দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেয়া উচিত। আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, শিক্ষার্থীদের জন্য যদি নির্দিষ্ট ইন্টারনেট প্যাকেজ দেয়া হয় যেখানে কিছু শব্দ ব্লক করা থাকবে। তাহলে তারা অশ্লীল সাইটে প্রবেশ করতে পারবে না। টেলিফোন অপারেটর কোম্পানিগুলো এই উদ্যোগ নিতে পারে। অনেক দেশেই এই ব্যবস্থা আছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন অ্যান্ড রেগুলেটরি কমিশনের (বিটিআরসি) একটা ভূমিকা রয়েছে। তারা চাইলে এই কাজগুলো করতে পারে। প্রথমে কে আপলোড করেছে তার আইডিও বের করতে পারে। শাস্তি নিশ্চিত হলে এগুলো কমে যাবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের অধ্যাপক জিয়া রহমান বলেন, আমরা এখন একটা পরিবর্তনের ট্রানজিশনাল স্টেজে আছি। মর্ডান হচ্ছি, উন্নয়ন হচ্ছে, প্রযুক্তিতে উন্নত হচ্ছি। এই অবস্থায় যেকোন সমাজের ক্রিমিনাল অ্যাক্টিভিটিজ ঘটে। মানুষের অধিকার, স্বাধীনতা বেড়ে যায়। এই অবস্থায় মানুষ সমাজের সঙ্গে পুরোপুরি খাপ খাওয়াতে পারে না। উন্নয়নের মাধ্যমগুলো ব্যবহার করতে নিয়ম-কানুন দরকার হয় সেটা বুঝতে পারে না। একটা জিনিস কতটুকু ব্যবহার করতে পারবো তার একটা সীমানা থাকা দরকার হয় কিন্তু সেগুলো তাৎক্ষণিকভাবে বুঝতে পারে না। পুঁজিবাদী সমাজে মোবাইল কোম্পানিও নানাভাবে বিজ্ঞাপন দিয়ে আকৃষ্ট করে। অনেক সময় নেগেটিভ বিষয়ও চলে আসে। সর্বোপরি সামগ্রিক পরিবর্তনের ফলে তরুণ সমাজের ওপর একটা নেগেটিভ বিষয় গ্রহণ করার প্রবণতা তৈরি হয়। ট্রানজিশনাল স্টেজে এগুলো সব সমাজেই হয়েছে। তিনি আশা প্রকাশ করেন, ধীরে ধীরে অভিভাবকদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি হবে, আমরা কথা বলবো এই নিয়ে, লেখালেখিও হবে। তরুণ সমাজও এক সময় পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ-খাইয়ে এসব বিকৃত বিষয় পরিত্যাগ করবে। তিনি বলেন, আমেরিকান সোসাইটি, কানাডিয়ান সোসাইটির কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলে পর্নো সাইটগগুলোতেও ঢুকা যাবে না। সেখানে পর্নোসাইটের সার্ভারগুলো ব্লক করে দেয়া আছে। আমাদের সমাজেও এমনটা হবে। এবং সেটা নির্ভর করবে রেগুলেটরি এজেন্সি কতটুকু রেগুলেট করবে তার ওপর।
পর্নোগ্রাফি যে শুধু মানুষের মনোজগত ওলট-পালট করে দেয় তা-ই নয়। বাংলাদেশে পর্নোগ্রাফির শিকার হয় অনেককে প্রাণও দিতে হয়েছে। ১৩ বছরের শাহানারা খাতুন। সাতক্ষীরার একটি গার্লস স্কুলের ৮ম শ্রেণির এই ছাত্রী গত বছরের ১২ই ডিসেম্বর আত্মহত্যা করে। তার এই আত্মহত্যার কারণ ছিল ফটোশপে তৈরি করা তার একটি অশ্লীল ছবি। ছবিটি ইন্টারনেটের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছিল স্কুল-কলেজের উঠতি বয়সী শিক্ষার্থী ও এলাকার বখাটেদের হাতে হাতে। এরপর এলাকার পরিবেশ তার জন্য হয়ে ওঠে নরকযন্ত্রণা। পরিণতিতে আত্মহননের পথ বেছে নেয় সে। শুধু শাহানারা নয়, ওই বছর অশ্লীল ভিডিও বা পর্নোগ্রাফির শিকার হয়ে আত্মহনন করে অন্তত ৫ জন। প্রতি বছরই এমন ঘটনা ঘটছে।