ঢাকা; প্রায় ২২ ঘণ্টার সফর শেষে ঢাকা ছেড়ে গেছেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। সময়ের হিসেবে সফরটি ‘সংক্ষিপ্ত’ হলেও এটি ছিল নানা কারণে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। হাই প্রোফাইল ওই সফর নিয়ে আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক মিডিয়ায় চুলচেরা বিশ্লেষণ চলছে। বিশেষ করে ঢাকা, বেইজিং ও দিল্লির সংবাদ মাধ্যমে। দেশের রাজনৈতিক এবং কূটনৈতিক অঙ্গনেও আছে বিস্তর আলোচনা। ৩০ বছর চীনের কোনো প্রেসিডেন্টের এটিই ছিল প্রথম সফর। এ সফরে কি পেলো ঢাকা? বিশ্বের দ্বিতীয় অর্থনৈতিক শক্তিধর চীনের প্রেসিডেন্টই এ সফরের মধ্য দিয়ে কি অর্জন করলেন? এমন নানা প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা চলছে। দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষক ও বিশ্লেষকরা বলছেন, সফরকালে সরকারি-বেসরকারি মিলে অর্ধশত চুক্তি, ঋণ চুক্তি এবং সমঝোতা স্মারক সই হওয়ার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ ও চীনের সম্পর্ক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। সফরে মোট ২৪ বিলিয়ন বা ২ হাজার ৪০০ কোটি ডলারের ঋণ চুক্তি সই হয়েছে। যাকে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় ঋণের ‘রেকর্ড’ হিসাবে দেখা হচ্ছে। ওই ঋণের বেশির ভাগই অবকাঠামো খাতে ব্যয় হবে। সফরে দুই দেশের নেতৃত্ব ঢাকা-বেইজিং বিদ্যমান সম্পর্ককে ‘কৌশলগত অংশীদারিত্বে’ নিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার করেছে। জয়েন্ট স্টেটমেন্ট বা যৌথ ঘোষণায়ও এর প্রতিফলন দেখা গেছে। ওই ঘোষণার সূচনাতেই সফরটিকে ‘দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের জন্য তাৎপর্যপূর্ণ ও ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ’ বলে উল্লেখ করা হয়। সেগুনবাগিচার কর্মকর্তারা বলছেন, চীন-ই প্রথম দেশ যার সঙ্গে বাংলাদেশ তার বিদ্যমান সহযোগিতামূলক সম্পর্কে ‘কৌশলগত অংশীদারিত্বে’ নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে সম্মত হয়েছে। অবশ্য চীন এ অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র- যেমন ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার সঙ্গে অনেক আগেই এমন সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করেছে। প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের বিদায়ের আগেই দুই দেশের মধ্যে এ সংক্রান্ত রূপরেখা সই হয়। ‘এসটাবলিশিং স্ট্যাটেজিক পার্টনারশিপ অন কো-অপারেশন বা সহযোগিতায় কৌলশগত অংশীদারিত্ব প্রতিষ্ঠা’ সংক্রান্ত ২৩ দফার ওই যৌথ ঘোষণায় আগামী দিনে বিভিন্ন ক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযোগিতা এবং আরও ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার বিষয়ে মতৈক্যে পৌঁছেছেন বাংলাদেশ ও চীনের শীর্ষ নেতৃত্ব। ওই ঘোষণায় সামরিক সহযোগিতা বজায় রাখতেও ঢাকা- বেইজিং একমত হয়েছে বলে স্পষ্ট করা হয়। বিশ্লেষকরা চীনা প্রেসিডেন্টের সফরকে কেন্দ্র করে দু’দেশের সম্পর্ক নিয়ে প্রকাশিত উচ্ছ্বাসকে ‘অভূতপূর্ব’ বলে বর্ণনা করছেন। তবে তারা এ সফরের অর্জনকে ধরে রাখতে বাংলাদেশের কর্মকর্তাদের আরও দক্ষতা, কৌশলী এবং পেশাদারিত্বের পরিচয় দেয়ার পরামর্শ দিয়েছে। সফরকালে চীনা প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠক করেছেন। তার সম্মানে দেয়া প্রেসিডেন্টের স্টেট ব্যাঙ্কুয়েট বা রাষ্ট্রীয় ভোজে অংশ নিয়েছেন এবং বাঙালি সংস্কৃতির মনোমুগ্ধকর পরিবেশেনা উপভোগ করেছে। বিদায়ের আগে সাভারস্থ জাতীয় স্মৃতি সৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন করে গেছেন। সফরকালে চীনা প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন জাতীয় সংসদের স্পিকার ও বিএনপি চেয়ারপারসন। রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ওই অতিথির সঙ্গে সংসদের বিরোধী নেত্রীর কোন সাক্ষাৎ হয়নি। সফর প্রস্তুতির সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তারা এজন্য ‘সময়ের তাড়া’র বিষয়টি সামনে আনলেও তারাই বলছেন- প্রেসিডেন্ট শি এ দেশের বীর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে সাভার যাওয়ার করণে ভারতের গোয়ায় ব্রিকস সামিটে তার একটি সূচিতে পরিবর্তন আনতে হয়েছে। চীনা প্রেসিডেন্টের সফরকালে সংঘটিত রাজনৈতিক বৈঠকগুলোরও ‘তাৎপর্য’ খোঁজার চেষ্টা করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। সেখানে ভূ-রাজনৈতিক এবং আঞ্চলিক রাজনীতির বিষয়টিও বিবেচনায় আসছে। চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতায় দিল্লি, টোকিও এবং ওয়াশিংটনের প্রতিক্রিয়া কি হয়, প্রধানমন্ত্রী ও তার কূটনৈতিক উপদেষ্টারা সেটাকে কিভাবে মোকাবিলা করছেন বা করবেন-সেদিকেও নজর রাখছেন অনেকে। সঙ্গত কারণেই অর্থনীতিবিদরা বাংলাদেশকে দেয়া চীনের ঋণ সুবিধা এবং দেশটির অর্থায়নে বস্তবায়নের অপেক্ষায় থাকা মেগা প্রকল্পগুলোর হিসাব-নিকাশ মেলাচ্ছেন। ভারতের এনডিটিভি’র এক প্রতিবেদনে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সফরে সম্পাদিত ২৪ বিলিয়ন ডলারের ঋণ চুক্তিকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশের পাওয়া সর্বোচ্চ বিদেশি ঋণ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে চীনের দেয়া ঋণের সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরকালে দেয়া সহজ শর্তে ২ বিলিয়ন ডলার ঋণ চুক্তির তুলনাও করা হয়েছে। বলা হয়েছে, সেই তুলনায় চীন বাংলাদেশকে ভারতের চেয়েও বেশি ঋণ দিচ্ছে। সাংহাই ইনস্টিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনালের সাউথ এশিয়া স্ট্যাডিজের পরিচালক জাও গানচেং বলেন, ‘ভারত ও চীন উভয় দেশই বাংলাদেশের উন্নয়ন চায়, যা অন্য কেউ চায় বা না চায়। এ নিয়ে দেশ দু’টির মধ্যেকার কোনো প্রতিযোগিতা থাকার কথাও মানতে নারাজ ওই বিশ্লেষক। তার মতে, বাংলাদেশ চীন ও ভারতের বিনিয়োগকে সব সময় স্বাগত জানায়। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামও গতকাল বলেছেন, বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য চীনকে যেমন লাগবে ভারতকেও লাগবে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী সফরের আগেই এ বিষয়ে কথা বলেছেন। তার মতে, চীনের সফরে দিল্লি তো নয়ই অন্য কোনো দেশের সম্পর্কে কোনো প্রভাব পড়বে না। অর্থ প্রতিমন্ত্রী এমএ মান্নান চীনের ঋণে বাস্তবায়িত মেগা প্রকল্পের বিষয়ে গণমাধ্যমকে বলেছেন- চীন বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রকল্পে অর্থায়ন করতে চায়। যার মধ্যে এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্র ও গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে তাদের আগ্রহ বেশি। এমএ মান্নান রয়টার্সকে বলেছেন, ‘কম সুদে রেকর্ড পরিমাণ (২৪ বিলিয়ন ডলার) ঋণ চুক্তি সই করায় শি জিনপিংয়ের সফর একটি মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হবে। চীনের প্রস্তাবিত প্রকল্পগুলোর মধ্যে সড়ক অবকাঠামো নির্মাণ এবং তথ্য প্রযুক্তির উন্নয়ন অন্যতম। অর্থ প্রতিমন্ত্রী বলেন, আমাদের দেশের অবকাঠামো সমপ্রসারণ করা প্রয়োজন। এজন্য আমাদের সহজ শর্তে অনেক ঋণ দরকার। চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ক নিয়ে গণমাধ্যমে প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেণকরা। এটাকে ‘অসম’ বলেই মনে করেন তারা। প্রেসিডেন্টের সফরে চীনের বাজারে কোটা ফ্রি এবং ডিউটি ফ্রি রপ্তানির সুবিধা চেয়েছেন বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা। চীনে বাংলাদেশ এক বিলিয়ন ডলারের নিচে রপ্তানি করে। আর বিপরীতে চীন করে প্রায় ১২ বিলিয়ন ডলার। অর্থনীতিবিদ ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বিবিসি বাংলাকে বলেন, চীনের সঙ্গে বাণিজ্য বিষয়ে সমতা আনতে হলে শুধু রপ্তানি বাড়ালেই হবে না। চীন যেসব শিল্প বন্ধ করে দিচ্ছে তা বাংলাদেশে আনা যায় কি-না তা নিয়ে ভাবতে হবে। ওই অর্থনীতিবিদ মনে করেন প্রেসিডেন্ট শি’র সফরের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক গুরুত্বের বিষয়টি বিশ্ব দরবারে আরেকবার উপস্থাপিত হলো। তবে চীনের বিনিয়োগ প্রকল্পগুলো বাংলাদেশের প্রয়োজন বিবেচনায় নেয়া হয়েছে কি-না তা খতিয়ে দেখার তাগিদ দেন তিনি।
যৌথ ঘোষণায় যা আছে: চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সফর উপলক্ষে সই হওয়া ২৩ দফা যৌথ বিবৃতিতে দুই দেশের সম্পর্ককে কৌশলগত পর্যায়ে উন্নীত করার ভবিষ্যৎ রূপরেখা দেয়া হয়। ওয়ান বেল্ট ও ওয়ান রোড উদ্যোগ, দ্বিপক্ষীয় সফর, ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধি, বাণিজ্য বৈষম্য হ্রাস, বাস্তব সহযোগিতার ক্ষেত্র চিহ্নিতকরণ, উৎপাদন সক্ষমতা বৃদ্ধি, প্রকল্প অর্থায়ন, মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল গঠন, সমুদ্র সহযোগিতা, সন্ত্রাসবাদ, দক্ষিণ-দক্ষিণ সহযোগিতা কাঠামোর বিষয়ে বিবৃতিতে স্বতস্ত্র ধারা রয়েছে। এছাড়া জলবায়ু পরিবর্তন, মানবসম্পদ উন্নয়ন, প্রশিক্ষণ, শিক্ষা সহযোগিতা ও স্কলারশিপ, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, আঞ্চলিক সহযোগিতা, সংস্কৃতি, মানুষে মানুষে যোগাযোগসহ দ্বিপক্ষীয় সব বিষয়ে ভবিষ্যৎ সম্পর্কের বিষয়টিও স্পষ্ট উল্লেখ করা হয়েছে। বিবৃতিতে বলা হয়- বিদ্যুৎ, তথ্য-প্রযুক্তি, নদী ব্যবস্থাপনা, অবকাঠামো এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে ২২টি প্রকল্পে চীনের সহায়তা চেয়েছে বাংলাদেশ। একই সঙ্গে বেইজিং তাদের এন্টারপ্রাইজদের এ প্রকল্পগুলোতে সহযোগিতা করার জন্য উৎসাহিত করার বিষয়ে সম্মত হয়েছে। বৃহৎ প্রকল্পে চীনের আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থায়নকেও স্বাগত জানিয়েছে দুইপক্ষ। বিবৃতিতে বলা হয়, চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগকে স্বাগত জানায় বাংলাদেশ। কারণ, ঢাকা বিশ্বাস করে এ উদ্যোগ ২০২১ সালে মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালে উচ্চ আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ এনে দেবে। বিসিআইএম অর্থনৈতিক করিডোর প্রতিষ্ঠার জন্য তাগিদ দেয়ার বিষয়েও উভয়পক্ষ একমত হয়। দুইপক্ষই তাদের উন্নয়ন কৌশলের মধ্যে সমন্বয়ের মাত্রা বাড়াবে, সহযোগিতার যে ক্ষেত্রগুলো আছে তার সম্ভাব্যতাকে বাস্তবে রূপ দেবে, বেল্ট ও রোড উদ্যোগে কাজ করবে যাতে করে টেকসই উন্নয়ন এবং দুইদেশের আপামর সবার সমৃদ্ধি হয়। এছাড়া বাংলাদেশ ও চীন একমত হয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার প্রচুর সম্ভাবনা আছে এবং একটি শান্তিপূর্ণ, স্থিতিশীল, উন্মুক্ত, উন্নয়নশীল ও সমৃদ্ধ দক্ষিণ এশিয়ার জন্য পুনরায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছে। সার্ক এবং অন্যান্য আঞ্চলিক সহযোগিতার মধ্যে সমন্বয় ও সহযোগিতা বৃদ্ধির জন্য দুইপক্ষ সম্মত হয়েছে। মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল গঠনের বিষয়ে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য একটি স্টাডি করার বিষয়ে উভয়পক্ষ একমত হয়েছে। এছাড়া চীন তার ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশে বিনিয়োগ করার জন্য উৎসাহিত করবে এবং বাংলাদেশ চীনা প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যবসা করার জন্য সহায়তা দেবে। চীন বাংলাদেশের ব্লু অর্থনীতি উন্নয়নে সহায়তা করার আগ্রহ প্রকাশ করেছে এবং বাংলাদেশ সেটিকে স্বাগত জানিয়েছে। এছাড়া সামুদ্রিক সহযোগিতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে দুইদেশ একমত হয়েছে এবং এজন্য একটি সংলাপের আয়োজন করার বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছেছে।
বিবৃতিতে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য দুইদেশ সম্মত হয়েছে। অবকাঠামো, শিল্প সক্ষমতা সহযোগিতা, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ, পরিবহন, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি, কৃষিক্ষেত্রকে চিহ্নিত করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রগুলোর সঙ্গে জড়িত দু’দশের সরকারের বিভিন্ন বিভাগগুলো দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা, বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও মানবসম্পদ উন্নয়নের জন্য একে-অপরের সঙ্গে পরিকল্পনা ও পথপ্রদর্শন করবে। দুইপক্ষ যে কোনো ধরনের সন্ত্রাসবাদকে নিন্দা জানায় এবং সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের যুদ্ধ, স্থিতিশীলতা রক্ষা ও জাতীয় নিরাপত্তা বজায় রাখার উদ্যোগকে সমর্থন জানায় চীন। পাশাপাশি, ১৩২০ মেগাওয়াট পায়রা থার্মাল বিদ্যুৎ প্রকল্প, কর্ণফুলী নদীর নিচে টানেল, দাসেরকান্দি সুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্রকল্প, ছয়টি জাহাজ ক্রয়, পদ্মা ব্রিজ, চতুর্থ স্তর জাতীয় ডাটা সেন্টারসহ বিভিন্ন প্রকল্পের সন্তোষজনক বাস্তবায়নে সন্তুষ্টি প্রকাশ করা হয়। এছাড়াও, উভয়পক্ষ সামরিক সহযোগিতা বজায় রাখা এবং প্রশিক্ষণ, যন্ত্রপাতি, প্রযুক্তি ও জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে সহযোগিতা গভীর করার বিষয়ে একমত হয়।
যৌথ ঘোষণায় যা আছে: চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সফর উপলক্ষে সই হওয়া ২৩ দফা যৌথ বিবৃতিতে দুই দেশের সম্পর্ককে কৌশলগত পর্যায়ে উন্নীত করার ভবিষ্যৎ রূপরেখা দেয়া হয়। ওয়ান বেল্ট ও ওয়ান রোড উদ্যোগ, দ্বিপক্ষীয় সফর, ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধি, বাণিজ্য বৈষম্য হ্রাস, বাস্তব সহযোগিতার ক্ষেত্র চিহ্নিতকরণ, উৎপাদন সক্ষমতা বৃদ্ধি, প্রকল্প অর্থায়ন, মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল গঠন, সমুদ্র সহযোগিতা, সন্ত্রাসবাদ, দক্ষিণ-দক্ষিণ সহযোগিতা কাঠামোর বিষয়ে বিবৃতিতে স্বতস্ত্র ধারা রয়েছে। এছাড়া জলবায়ু পরিবর্তন, মানবসম্পদ উন্নয়ন, প্রশিক্ষণ, শিক্ষা সহযোগিতা ও স্কলারশিপ, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, আঞ্চলিক সহযোগিতা, সংস্কৃতি, মানুষে মানুষে যোগাযোগসহ দ্বিপক্ষীয় সব বিষয়ে ভবিষ্যৎ সম্পর্কের বিষয়টিও স্পষ্ট উল্লেখ করা হয়েছে। বিবৃতিতে বলা হয়- বিদ্যুৎ, তথ্য-প্রযুক্তি, নদী ব্যবস্থাপনা, অবকাঠামো এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে ২২টি প্রকল্পে চীনের সহায়তা চেয়েছে বাংলাদেশ। একই সঙ্গে বেইজিং তাদের এন্টারপ্রাইজদের এ প্রকল্পগুলোতে সহযোগিতা করার জন্য উৎসাহিত করার বিষয়ে সম্মত হয়েছে। বৃহৎ প্রকল্পে চীনের আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থায়নকেও স্বাগত জানিয়েছে দুইপক্ষ। বিবৃতিতে বলা হয়, চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগকে স্বাগত জানায় বাংলাদেশ। কারণ, ঢাকা বিশ্বাস করে এ উদ্যোগ ২০২১ সালে মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালে উচ্চ আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ এনে দেবে। বিসিআইএম অর্থনৈতিক করিডোর প্রতিষ্ঠার জন্য তাগিদ দেয়ার বিষয়েও উভয়পক্ষ একমত হয়। দুইপক্ষই তাদের উন্নয়ন কৌশলের মধ্যে সমন্বয়ের মাত্রা বাড়াবে, সহযোগিতার যে ক্ষেত্রগুলো আছে তার সম্ভাব্যতাকে বাস্তবে রূপ দেবে, বেল্ট ও রোড উদ্যোগে কাজ করবে যাতে করে টেকসই উন্নয়ন এবং দুইদেশের আপামর সবার সমৃদ্ধি হয়। এছাড়া বাংলাদেশ ও চীন একমত হয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার প্রচুর সম্ভাবনা আছে এবং একটি শান্তিপূর্ণ, স্থিতিশীল, উন্মুক্ত, উন্নয়নশীল ও সমৃদ্ধ দক্ষিণ এশিয়ার জন্য পুনরায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছে। সার্ক এবং অন্যান্য আঞ্চলিক সহযোগিতার মধ্যে সমন্বয় ও সহযোগিতা বৃদ্ধির জন্য দুইপক্ষ সম্মত হয়েছে। মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল গঠনের বিষয়ে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য একটি স্টাডি করার বিষয়ে উভয়পক্ষ একমত হয়েছে। এছাড়া চীন তার ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশে বিনিয়োগ করার জন্য উৎসাহিত করবে এবং বাংলাদেশ চীনা প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যবসা করার জন্য সহায়তা দেবে। চীন বাংলাদেশের ব্লু অর্থনীতি উন্নয়নে সহায়তা করার আগ্রহ প্রকাশ করেছে এবং বাংলাদেশ সেটিকে স্বাগত জানিয়েছে। এছাড়া সামুদ্রিক সহযোগিতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে দুইদেশ একমত হয়েছে এবং এজন্য একটি সংলাপের আয়োজন করার বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছেছে।
বিবৃতিতে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য দুইদেশ সম্মত হয়েছে। অবকাঠামো, শিল্প সক্ষমতা সহযোগিতা, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ, পরিবহন, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি, কৃষিক্ষেত্রকে চিহ্নিত করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রগুলোর সঙ্গে জড়িত দু’দশের সরকারের বিভিন্ন বিভাগগুলো দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা, বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও মানবসম্পদ উন্নয়নের জন্য একে-অপরের সঙ্গে পরিকল্পনা ও পথপ্রদর্শন করবে। দুইপক্ষ যে কোনো ধরনের সন্ত্রাসবাদকে নিন্দা জানায় এবং সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের যুদ্ধ, স্থিতিশীলতা রক্ষা ও জাতীয় নিরাপত্তা বজায় রাখার উদ্যোগকে সমর্থন জানায় চীন। পাশাপাশি, ১৩২০ মেগাওয়াট পায়রা থার্মাল বিদ্যুৎ প্রকল্প, কর্ণফুলী নদীর নিচে টানেল, দাসেরকান্দি সুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্রকল্প, ছয়টি জাহাজ ক্রয়, পদ্মা ব্রিজ, চতুর্থ স্তর জাতীয় ডাটা সেন্টারসহ বিভিন্ন প্রকল্পের সন্তোষজনক বাস্তবায়নে সন্তুষ্টি প্রকাশ করা হয়। এছাড়াও, উভয়পক্ষ সামরিক সহযোগিতা বজায় রাখা এবং প্রশিক্ষণ, যন্ত্রপাতি, প্রযুক্তি ও জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে সহযোগিতা গভীর করার বিষয়ে একমত হয়।