চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ২৩ ঘন্টা বাংলাদেশ সফর করে গেলেন। এই সফর বিশ্ব মিডিয়ায় ঝড় তোলেছে বলতে হবে। ৩০ বছর পর বাংলাদেশে এলেন কোন চীনা রাষ্ট্রপতি। এই সফরকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছি আমরা সকলেই। নিঃসন্দেহে এটি বাংলাদেশের জন্য একটি মাইলফলক যা সৌভাগ্য হিসেবে এসেছে। আমরা এই সৌভাগ্যকে সম্মান জানাই।
এই সফরের ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিক দুটোই আছে। তবে নেতিবাচক দিকটা কম। নেতিবাচক দিক উল্লেখ করলে বলতে হয়, গরীবের মাঝে বেশী উল্লাস থাকতে নেই। বিশ্ব রাজনীতিতে চীন ও যুক্তরাষ্ট্র যখন প্রভাব প্রতিপত্তি নিয়ে প্রতিযোগিতা করছে ঠিক ওই সময় আমরা চীনকে স্বাগত জানিয়ে আমাদের সৌভাগ্যকে কুর্নিশ করলাম। যুক্তরাষ্ট্রের আগত নির্বাচনে হিলারী ক্লিন্টন যখন এগিয়ে যাচ্ছেন তখন আমরা চীনের কাছে চলে গেলাম। ভূ-রাজনীতি ও আঞ্চলিক রাজনীতে চীন ও ভারত যখন মান-অভিমান করছে তখন আমরা চীনের দ্বারস্থ হলাম। এতে আমাদের বন্ধুপ্রতীম ভারতের সঙ্গে কোন অবনতি হতে পারে কি না জানিনা তবে ভারতীয় গণমাধ্যম বাংলাদেশ-চীন সম্পর্কের এই নতুন সূচনাকে ভাল চোখে দেখছে না এটা ভারতীয় গণমাধ্যম ইতোমধ্যে বলে দিয়েছে।
এছাড়া ভারত-পাকিস্তান যখন মারমুখো অবস্থানে তখন চীন পাকিস্তানকে সরাসরি সমর্থন না করলেও কাউকে সমর্থন না করার বিষয়টিও স্পর্শকাতর। আবার পাকিস্তানে সমারিক মহড়া চালানো রাশিয়ার সঙ্গে চীনের একটি সম্পর্ক আছে যা ইতোমধ্যে প্রকাশও হয়েছে। তাহলে আমরা পাকিস্তানের কোন মিত্র চক্রকে সমর্থন করলাম কি না তাও প্রশ্নের দাবি রাখে।
ভারত-পাকিস্তান ইস্যুতে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান এক নয়। বিশ্বের শক্তিশালী এই দুটো রাষ্ট্র ভারত-পাকিস্তান প্রশ্নে কোন দিকে মোড় নিবে তাও বলা মুশকিল। এই অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রকে হাতছাড়া করে চীনকে অধিক কাছে টানা আমাদের মত গরীব দেশের জন্য মঙ্গল না অমঙ্গল তা সময় বলে দিবে। তবে যাই হউক, আমরা গরীব। আমরা গরীব থাকতে চাই না। স্বাবলম্বী হতে চাই। এই চাওয়ার জন্য চীন-বাংলাদেশের নতুন সম্পর্ক নির্ভেজাল থাকুক প্রত্যাশা চিরন্তন।
বাংলাদেশ-চীন সম্পর্কের নতুন দিগন্ত নিয়ে দ্য ইকনোমিষ্ট বলছে, ১৯৮৬ সালে সর্বশেষ যখন একজন চীনা প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশ সফর করেছিলেন, পরিস্থিতি বরং ভিন্ন ছিল। একটি কারণ হতে পারে যে, তিনি পকেটে করে ৪০ বিলিয়ন ডলার আনেননি। সরকারী সূত্রগুলো বলছে, ঠিক এ পরিমাণ অর্থই চীনের বর্তমান নেতা শি জিনপিং ১৪ই অক্টোবর একদিনের সফরে নিয়ে আসছেন। স্পষ্টত, উড়াল পথ, রেলপথ, সেতু ও বিদ্যুতকেন্দ্র সহ প্রায় ২১টি অবকাঠামো প্রকল্পের জন্য ঋণের রূপে আসবে এ অভাবনীয় অর্থ। কিন্তু স্বাগত জানানোর কায়দা আগের মতোই। ৩০ বছরে বাংলাদেশও পাল্টেছে অনেকখানি। যদিও ১৬ কোটি জনসংখ্যার বেশিরভাগ এখনও দরিদ্র্যই রয়ে গেছে, কিন্তু দেশটিকে আর ‘ভারতের বগলতল’ বলে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। বার্ষিক ৭ শতাংশ হারে বাড়ছে প্রবৃদ্ধি, ঠিক চীনের মতো। অনেক সামাজিক সূচকের দিক দিয়ে মহাকায় প্রতিবেশী ভারতকেও ছাড়িয়ে গেছে বাংলাদেশ। দেশটির উদীয়মান পোশাক শিল্প রপ্তানির দিক দিয়ে পিছিয়ে কেবল চীন থেকে। এ শিল্প ও প্রায় ১ কোটি প্রবাসী কর্মঠ শ্রমিকের পাঠানো টাকায় বাংলাদেশ গত ১০ বছরে একবার বাদে প্রতি বছর উদ্বৃত্ত ভোগ করেছে। এখন অন্যান্য পাণিপ্রার্থীও পেয়েছে বাংলাদেশ। সম্প্রতি চীনকে হটিয়ে নতুন একটি সমুদ্রবন্দর নির্মানের কাজ পেয়েছে জাপান। ৬৭০ কোটি ডলারের এ প্রকল্পে আছে একটি গ্যাস টার্মিনাল ও ৪টি কয়লা চালিত বিদ্যুতকেন্দ্র। জুলাইয়ে একজোড়া পারমাণবিক চুল্লি নির্মানে রাশিয়া ঋণ হিসেবে ১১৪০ কোটি ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এ বছরের গোড়ার দিকে, ভারত আরেকটি বড় কয়লা চালিত বিদ্যুতকেন্দ্রে ১৫০ কোটি ডলার অর্থায়নে সম্মত হয়েছে। পাশাপাশি দেশটি বাংলাদেশকে নিজ গ্রিড থেকেও বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে।
চীনের প্রভাশালী পত্রিকা দ্যা পিপলস বলছে,
বাংলাদেশে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং-এর রাষ্ট্রীয় সফর চীন-বাংলাদেশ স¤পর্কে মাইলফলক হয়ে থাকবে। ৩০ বছরে প্রথম কোন চীনা প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশ সফরকে সামনে রেখে বিশেষজ্ঞরা এমনটাই বলছেন।
চাইনিজ অ্যাকাডেমিক অব সোস্যাল সাইয়েন্সেস-এর সাউথ এশিয়া স্টাডিজের পরিচালক ইয়ে হাইলিন বলেন, সিল্ক রোড ইকোনমিক বেল্ট ও একুশ শতকের ম্যারিটাইম সিল্ক রোড গড়ে তুলতে বাংলাদেশ চীনের গুরুত্বপূর্ণ আংশীদার হতে পারে। ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ বলে পরিচিত এ প্রকল্পদ্বয় বাস্তবায়নে বঙ্গোপসাগরে পাশে অবস্থিত দক্ষিণ এশিয়ার এ দেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
তিনি ব্যাখ্যার সুরে বলেন, চীন ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ উদ্যোগের প্রস্তাব দেওয়ারও আগ থেকে চীন-বাংলাদেশ-ভারত-মায়ানমার সহযোগীতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে বাংলাদেশ। বঙ্গোপসাগর অঞ্চলে অবস্থিত দেশগুলোর মধ্যে সহযোগিতা জোরদার করতে এই মেকানিজম প্রস্তাব করেছিল চীন।
বঙ্গোপসাগরের তীরে বলেই নয়, দক্ষিণাঞ্চলীয় সিল্ক রোডে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান। গুরুত্বপূর্ণ ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে এ দেশটি হতে পারে দক্ষিণ এশিয়ার সঙ্গে চীনের অর্থনৈতিক সহযোগিতার অন্যতম শীর্ষ আংশীদার।
যে যাই বলুক। আমরা আশাবাদী মানুষ। আমরা স্বপ্ন দেখতে জানি। এই স্বপ্ন যেন বাস্তবায়ন হয়, এই প্রত্যাশার দৃঢ়তা আমাদের আছে।