ঢাকা; রামপাল প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ে কোনো কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। জাতিসংঘের বিজ্ঞান, শিক্ষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য–বিষয়ক সংস্থা ইউনেসকোর জন্য তৈরি করা জবাবে এ সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়েছে।
গত আগস্টে বাংলাদেশ সরকারকে দেওয়া ইউনেসকোর প্রতিবেদনে বলা হয়, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম পর্যায়ের জন্য পশুর নদ থেকে বিপুল পরিমাণ পানি উত্তোলন করার কারণে সুন্দরবনের প্রতিবেশ ব্যবস্থার ক্ষতি হবে। সরকার যদি দ্বিতীয় পর্যায়ে আরেকটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প করে, তাহলে সেই ক্ষতি আরও বাড়বে। এসব আশঙ্কা প্রকাশ করে রামপাল প্রকল্প বাতিল করার সুপারিশ করে ইউনেসকো।
ইউনেসকোর ৩০ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনের জবাব তৈরি করেছে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়। ২৭ পৃষ্ঠার এই জবাবে ইউনেসকোর বেশির ভাগ আশঙ্কাই সঠিক নয় উল্লেখ করে বলা হয়েছে, উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করায় রামপাল প্রকল্পের কারণে সুন্দরবনের ক্ষতি হবে না।
ইউনেসকোর উদ্বেগের জবাবে বলা হয়েছে, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে জানা গেছে, রামপাল প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায় ইতিমধ্যে বাতিল করা হয়েছে। ফলে পশুর নদ থেকে অতিরিক্ত পানি উত্তোলনের প্রশ্নই আসে না।
জানতে চাইলে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, ‘রামপাল প্রকল্পের প্রথম পর্যায় সুষ্ঠুভাবে করা নিয়ে আমরা কাজ করছি। দ্বিতীয় পর্যায়ে কয়লা বাদে অন্য কোনো উৎস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায় কি না, তা আমরা যাচাই-বাছাই করে দেখছি।’
আগস্টে বাংলাদেশ-ভারত জ্বালানি–বিষয়ক ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে রামপাল প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র না করে অন্য কোনো উৎসের মাধ্যমে বিদ্যুৎকেন্দ্র করার সুপারিশ করা হয়। ওই বৈঠকে রামপাল প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ের জন্য অধিগ্রহণ করা জমিতে সৌরবিদ্যুৎ করা যায় কি না, তা খতিয়ে দেখার বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়।
তেল-গ্যাস–খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্যসচিব অধ্যাপক আনু মুহাম্মদপ্রথম আলোকে বলেন, ‘রামপাল প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র না করার সিদ্ধান্ত দেখে মনে হচ্ছে এ ব্যাপারে সরকারের সিদ্ধান্ত ইতিবাচক দিকে এগোচ্ছে। এই ধারা অব্যাহত রেখে রামপালসহ ওই এলাকায় যে ১৫০টি শিল্পকারখানা করার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে, তার সবগুলো বাতিল করে সুন্দরবনকে তার নিজের মতো থাকতে দেওয়া উচিত।’
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ইতিমধ্যে রামপাল প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ের জন্য অধিগ্রহণ করা জমিতে কোন ধরনের বিদ্যুৎ প্রকল্প করা যায়, তা যাচাই করতে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি করা হয়েছে। এই কমিটি সৌরবিদ্যুৎ, বায়ুবিদ্যুৎ থেকে শুরু করে বায়োগ্যাস প্ল্যান্টসহ বিদ্যুৎ উৎপাদনের সবগুলো উৎসের সম্ভাব্যতা যাচাই করে দেখছে।
২০১০ সালে রামপাল প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ের জন্য ৯১৫ এবং পরে ২০১৫ সালে দ্বিতীয় পর্যায়ের জন্য আরও ৯১৫ একর ভূমি অধিগ্রহণ করা হয়। দুই পর্যায়ে ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট করে দুটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের ঘোষণা দেওয়া হয়।
গত বছরের জুলাই মাসে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় দ্বিতীয় পর্যায়ের ভূমি উন্নয়ন, সীমানাপ্রাচীর নির্মাণসহ অন্যান্য কাজের জন্য ৪৫৪ কোটি টাকার একটি প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়। ওই প্রকল্পের আওতায় ১ কোটি ২৭ লাখ ১৩ হাজার ঘনমিটার মাটি ভরাট ও ১৪ হাজার মিটার সীমানাপ্রাচীর নির্মাণ করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়।
বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সরকারের পক্ষ থেকে প্রাথমিকভাবে রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ের দায়িত্ব বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী পাওয়ার কোম্পানিকে দেওয়ার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। এ ব্যাপারে মৈত্রী পাওয়ার কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক উজ্জ্বল কান্তি ভট্টাচার্য প্রথম আলোকে বলেন, ‘রামপাল প্রকল্পের সম্প্রসারণের কোনো পরিকল্পনা আমাদের নেই। সরকারের পক্ষ থেকে রামপালের দ্বিতীয় পর্যায়ের জন্য অধিগ্রহণ করা জমিতে সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের কোনো প্রস্তাব আমাদের দেওয়া হয়নি। তবে আমরা শুনেছি, সরকার সেখানে সৌরবিদ্যুৎ করার চিন্তা করছে।’
সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক সুলতানা কামাল বলেন, ‘সুন্দরবনের জন্য ক্ষতি হয় এমন কোনো কিছু আমরা চাই না। সুন্দরবনের পাশে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প করলে ক্ষতি হবে, এটা নিশ্চিত হয়েই আমরা এর বিরোধিতা করছি। এখন রামপালের দ্বিতীয় পর্যায়ে যদি কয়লা বাদ দিয়ে অন্য কোনো উৎস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা সরকার নেয়, তাহলে তা আনুষ্ঠানিকভাবে দেশবাসীসহ আমাদের জানাতে হবে। তাদের পরিকল্পনা সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ তথ্য–উপাত্ত পেয়েই আমরা আমাদের অবস্থান জানাব।’