মানুষের জীবন থেকে আদর-ভালোবাসা-স্নেহ কি ফুরিয়ে যাচ্ছে? আমরা কি চিরন্তন গভীর মমতা থেকে দূরে সরে যাচ্ছি? আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা পড়ছি জড় চাওয়া-পাওয়ার জটিল জটাজালে?
সন্তানের দেওয়া আগুনে পুড়ে বাবার মৃত্যুর খবরে এসব প্রশ্ন যেন মগজ ফুঁড়ে উঠল। নতুন মডেলের মোটরসাইকেল না পেয়ে গত বৃহস্পতিবার বিকেলে ফরিদপুর শহরে নিজের মা-বাবার শরীরে আগুন দেয় এক কিশোর। কিশোরের বাবা রফিকুল হুদা গুরুতর দগ্ধ হন। মা সামান্য আহত হন। ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন রফিকুল আজ বুধবার সকালে মারা গেছেন।
শুরুতে যে প্রশ্নগুলো তুলেছি, এগুলো আসলে কয়েক দিন ধরেই ঘুরপাক খাচ্ছে মনে। মাত্র সেদিনই তো এমন দুটি ঘটনা ঘটল। একটি হচ্ছে বঁটির কোপে এক নারী খুন হওয়ার ঘটনা। অভিযোগ উঠেছে ছোট ছেলের বিরুদ্ধে। আরেকটি এক শিশু খুন হওয়ার ঘটনা। অভিযোগ মায়ের বিরুদ্ধে।
চট্টগ্রামে সুমিত নামের এক তরুণের বিরুদ্ধে মাকে খুন করা অভিযোগ উঠেছে। গত শনিবার এ ঘটনা ঘটে। বড় ভাই সোমনাথের দাবি, এইচএসসি পরীক্ষায় খারাপ করায় সুমিতকে বকাঝকা করা হয়। তাই তিনি মাকে বঁটি দিয়ে কুপিয়ে মেরে নিজেও আত্মহত্যা করা চেষ্টা করেন। একই দিন রাজশাহীতে কাব্য নামের সাত বছরের এক শিশু খুন হয়েছে। তাকে কুপিয়ে হত্যা করার অভিযোগ উঠেছে মায়ের বিরুদ্ধে। ওই মাও নাকি পরে আত্মহত্যা করতে যাচ্ছিলেন। স্থানীয় লোকজনের বরাত দিয়ে পুলিশ বলছে, তাঁর মানসিক সমস্যা আছে।
এ ধরনের ঘটনা সারা দেশেই কিন্তু ঘটছে। রাজধানীতে দুই শিশুসন্তানকে খুন করার অভিযোগে এক মা এখনো কারাগারে বিচারের অপেক্ষায় রয়েছেন। বাবা-মাকে খুন করে মাদকসেবী ঐশী সর্বোচ্চ সাজা পেয়েছেন।
একজন মা নয় মাসের বেশি সময় নিজ গর্ভে সন্তানকে ধারণ করেন। তাঁর নিবিড় মমতা আর সযত্ন পরিচর্যায় সন্তান একটি নিভৃত–নিরাপদ কোটরে বড় হয়। এ সময় অনাগত সন্তানের কল্যাণে নিজের সব সুখ জলাঞ্জলি দিয়ে মা অবর্ণনীয় কষ্ট পোহান। মায়ের সঙ্গে সন্তান বাঁধা পড়ে নাড়ির বন্ধনে। ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর চিকিৎসক বা ধাই এই নাড়ি কেটে সন্তানকে পৃথিবীর আলো-বাতাসে বেড়ে ওঠার সুযোগ করে দেন। মা ও সন্তানের অন্তরের নাড়ি কিন্তু কাটে না। সে নাড়িতে দুনিয়ার সব রশির শক্তি। সারা পৃথিবীর মানুষ মিলে টানলেও তা ছিঁড়বে না।
কিন্তু একটি তরুণ সামান্য একটি বঁটি দিয়ে এই কঠিন বন্ধন কেটে দেবে, এটা কেমন কথা! একজন মা-ই বা এ বাঁধন ছিঁড়লেন কী করে! ভাবলে মনে হয়, দুনিয়ায় আদর-ভালোবাসা সব ফুরিয়ে যাচ্ছে!
কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর ‘মাগো, ওরা বলে’ কবিতায় সন্তানের ফিরে আসার প্রতীক্ষায় থাকা মায়ের যে আকুতি, তা সর্বজনীন। কুমড়ো ফুলে নুয়ে পড়েছে লতা, শজনে ডাঁটায় ভরে গেছে গাছটা, ডালের বড়িও শুকিয়ে রাখা হয়েছে। শুধু খোকা ফিরে আসার অপেক্ষা। কবিতার এই চরণে চিরচেনা বাংলা মাকে খুঁজে পাওয়া যায়। তাঁর করাল-বদনী রূপ কখনো কারও কাম্য নয়। কিন্তু রাজশাহীর সেই ঘাতক মায়ের কথা ভাবলে কবিতার পাতাগুলো রক্তে ঝাপসা হয়ে আসে।
আবার মাকে আগলে রাখার মানসিকতা নিয়েই একটি শিশু বড় হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বীরপুরুষ’ কবিতায় পালকিতে সওয়ার মাকে দুর্বৃত্তদের কবল থেকে রক্ষা করতে একটি খোকার মনের যে কাল্পনিক চিত্র তুলে ধরা হয়েছে, বাস্তবে মাকে নিয়ে সব ছেলের মধ্যেই থাকে এই সংকল্প। পার্থিব জগতে মাকে মাথার ওপরে রেখেই একটি সন্তান বড় হয়। একটি জাতির কাছে দেশের চেয়ে বড় কিছু নেই। সেই দেশটাকেই মায়ের জায়গায় স্থান দেয় সব মানুষ। সগর্বে আমরা বলি ‘মাতৃভূমি’। সেখানে চট্টগ্রামের সেই সুমিতের বঁটি সব এলোমেলো করে দেয়। ফরিদপুরের সেই কিশোরের আগুন সব পুড়িয়ে ছারখার করে দেয়। কেন এমন হয়?
কারণে খুঁজতে গেলে থই পাওয়া যায় না। দিন যত যাচ্ছে, জীবনের রেলগাড়িটার ছোটার গতি বাড়ছে। এ গতির সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে হিমশিম কাছে আবেগীয় অনুভূতি। সুস্থির চিন্তার চেয়ে দ্রুত সিদ্ধান্তের বেগ বেশি। এতে ঘটে যাচ্ছে নানা অঘটন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে যা হয়, কেউ স্রেফ জেদের বশে অভাবনীয় কাণ্ড করে পরে আফসোস করে, যখন তা একেবারেই মূল্যহীন। আবার তাৎক্ষণিকভাবে এমন অঘটন ঘটে, যা এক মিনিট আগেও ছিল অঘটন ঘটানো ব্যক্তির চিন্তার বাইরে।
মায়া–মমতা, নৈতিকতা বা মানবতার বিচারে ছাড় না দিয়ে তুচ্ছ অনেক বিষয় এখন জটিল করে ফেলা হচ্ছে। ছাড়ের চেয়ে, দেওয়ার চেয়ে, চাহিদার পাল্লা ভারী হয়ে যাচ্ছে। সন্তান মানুষ হলে বা নিজের পায়ে দাঁড়ালেই শান্তি, কেবল এটুকু প্রত্যাশার মধ্যেই আর থাকতে চান না কেউ কেউ। এখন অনেক মা–বাবা সন্তানের কাছে কিছু প্রাপ্তি আশা করেন। বিদেশ গিয়ে প্রতারিত হয়ে সন্তান ফিরে এলে বিনিয়োগে ভরাডুবি বলে মনে করেন অনেকে। এ ধরনের ঘটনায় সন্তানের সঙ্গে শুরু হয় সম্পর্কের টানাপোড়েন। সন্তানের অপ্রত্যাশিত ফল, তা পরীক্ষায়ই হোক বা কর্মক্ষেত্রে, সেটাও বাঁকা চোখে দেখা হয়। ভাবা হয়, নাহ্, এ সন্তান দিয়ে কিছু হবে না। এখানেও চলে ভয়ানক টানাপোড়েন। আবার মা-বাবার সাধ্যে কুলোবে কি না, তা বিবেচনা না করেই অসম্ভব কিছু চেয়ে বসে সন্তান। চাহিদা পূরণে অক্ষম হলেই বাধে বিপত্তি। মা-বাবা বুড়ো হলে অনেকে ভাবে, নাহ্, এ তো সংসারের বোঝা। সে ক্ষেত্রে গ্রামের বাড়ি থাকলে তো রক্ষা। নইলে এখানে এক দিন, ওখানে দুদিন করে করে ভাসমান জীবন, নয় তো ঠাঁই হবে প্রবীণনিবাসে, যা বেশ খরচার বিষয়। এই সম্পর্কের টানাপোড়েন দিন দিন বাড়ছে। দুনিয়া হয়ে উঠেছে প্রতিযোগিতার। কারও দিকে কারও তাকানোর সময় যেন নেই। শুধু ছোটো, সামনে যাও।
আমরা আপনজনের সঙ্গে এই জোড়াতালি দেওয়া সম্পর্ক চাই না। আমরা চাই, মা-বাবার সঙ্গে সন্তানের সম্পর্ক হবে ফুলের গভীরে থাকা মধুর মতো। এ সম্পর্ক হবে শোলাকিয়ায় গত ৭ জুলাই গুলিতে নিহত মা ঝর্ণা রানী ভৌমিকের সঙ্গে তাঁর ছেলে বাসুদেব ভৌমিকের মতো। এই অসাম্প্রদায়িক মা ঈদের দিন গুলি খাওয়ার আগে ছেলের জন্য লুচি ও সেমাই রান্না করছিলেন। বাসুদেব প্রথম আলোর ছুটির দিনের পাতায় (১০ সেপ্টেম্বর সংখ্যা) লিখেছেন, আমি ঢাকায় চলে আসার পর মা সব সময় আমার খোঁজখবর নিতেন। হঠাৎ যদি ফোন বন্ধ থাকত, মা অস্থির হয়ে যেতেন আমার খোঁজখবর নেওয়ার জন্য। এখন কেউ আমাকে ‘বাবু’ বলে ডাকে না। খোঁজখবর নেয় না। বলে না, বাবু তুমি খেয়েছ? কোথায়? কী খেয়েছ? সাবধানে থেকো…
আমরা চাই, একটি সন্তান সব সময় বাবা বা মায়ের কাছে ফিরবে এক মুঠো ভালোবাসা নিয়ে। যে ভালোবাসায় সুবাস অনন্ত, পরিধি দিগন্ত। আর মা-বাবা যখন সন্তানের পিঠে হাত রাখবেন, তা হবে পৃথিবীর সবচেয়ে শান্তিময় পরশ!