আমীন মোহাম্মদ
সৌদআরব করেসপন্ডেন্ট
গ্রাম বাংলা নিউজ২৪.কম
রিয়াদ থেকে: আজ পবিত্র হজ। হাজীদের ‘উকুফে আরাফা’ বা আরাফাতের ময়দানে অবস্থানের দিন। বিশ্ব
মুসলমানের মহাসম্মিলনের দিন। আজ বিশ্বের ১৬০টির বেশি দেশের ২০ লাখেরও বেশি হাজির কণ্ঠে উচ্চারিত ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লা-শারিকালাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হামদা ওয়ান্ নে’মাতা লাকা ওয়াল মুলক লাশারিকা লাক’ ধ্বনিতে মুখরিত হবে সেখানকার আকাশ বাতাস। এক স্বর্গীয় আবহ তৈরি হবে পুরো ময়দানে। সবার পরনে থাকবে সাদা দুই খণ্ড বস্ত্র। সবার দীন বেশ। দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ, রহমতপ্রাপ্তি ও নিজের গুনাহ মাফের জন্য আল্লাহ তায়ালার কাছে অশ্রুসিক্ত ফরিয়াদ জানাবেন সমবেত মুসলমানেরা। একে অপরের সাথে পরিচিত হবেন, কুশল বিনিময় করবেন। বিশ্ব ভ্রাতৃত্বের এক অনুপম দৃশ্যেরও অবতারণা হবে আজ সেই ময়দানে।
সৌদি আরবে আজ ৯ জিলহজ। আজ জোহরের নামাজের ওয়াক্তের আগেই বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে যাওয়া মুসলমানরা সমবেত হবেন মক্কা থেকে প্রায় ১৩ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ঐতিহাসিক আরাফাতের ময়দানে। আজ থেকে ১৪ শতাধিক বছর আগে এই ময়দানেই রাসূল সা: লাধিক সাহাবীকে সামনে রেখে ঐতিহাসিক বিদায়হজের ভাষণ দিয়েছিলেন। এই ময়দানেই ইসলামের পরিপূর্ণতার ঘোষণা দিয়ে কুরআনের আয়াত নাজিল হয়েছিল।
হাজিরা আজ আরাফাতের বিশাল প্রান্তরে অবস্থান করে মসজিদে নামিরাহ থেকে প্রদত্ত খুতবা শুনবেন এবং এক আজানে একসাথে জোহর ও আসরের নামাজ একই ইমামের পেছনে জোহরের ওয়াক্তে আদায় করবেন। সূর্যাস্তের পর ময়দান ত্যাগ করবেন।
টানা পাঁচ দিন ধরে হজের আরো অনেক করণীয় থাকলেও ৯ জিলহজ মক্কার অদূরে আরাফাতের ময়দানে অবস্থানের দিনকেই হজের দিন বলা হয়। হজের কার্যাদি আনুষ্ঠানিকভাবে পালন শুরু হয়েছে গতকাল বৃহস্পতিবার মিনার তাঁবুতে অবস্থানের মধ্য দিয়ে। ভিড় এড়াতে অনেক হাজি আগের দিন বুধবার রাত থেকেই মিনায় যাওয়া শুরু করেন। গতকাল বেশির ভাগ হাজীই মিনায় চলে যান। মিনায় গিয়ে তালবিয়া, জিকির, নফল নামাজ, হজের মাসলা-মাসায়েল শোনা ও সে অনুযায়ী আমলের মধ্য দিয়ে সময় অতিবাহিত করেন হাজীরা। আজ ফজরের নামাজের পর সূর্যোদয়ের পর থেকে আরাফাতের ময়দানের উদ্দেশে হাজিদের রওনা হওয়ার নিয়ম। তবে ভিড় এড়েোত অনেক হাজী গত রাতেই আরাফাতের ময়দানে গিয়ে অস্থায়ী তাঁবুতে অবস্থান নিয়েছেন। বাকিরা আজ সকালে মিনা থেকে সরাসরি আরাফার ময়দানে চলে যাবেন। সূর্য পশ্চিমাকাশে হেলে পড়ার পর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করা হজের অন্যতম ফরজ। কেউ এই সময়ের মধ্যে এই ময়দানে অবস্থান করতে না পারলে হজ আদায় হবে না।
এই ময়দানে জোহরের সময় এক আজানে একই ইমামের পেছনে একই সাথে জোহর ও আসরের নামাজ জামাতের সাথে আদায় করবেন হাজীরা। মুসাফির হওয়ার কারণে নামাজ কসর করবেন (চার রাকাতের স্থলে দুই রাকাত)। নামাজের আগেই সৌদি গ্র্যান্ড মুফতি মসজিদে নামিরাহ থেকে খুতবা দেবেন। এর আগে পরে হজযাত্রীদের কণ্ঠে উচ্চারিত ‘লাব্বাইক’ ধ্বনিতে মুখরিত হবে পুরো ময়দান। আমির-ফকির, ধনী-গরিব, সাদা-কালোর ভেদাভেদ থাকবে না সেখানে। সবার পরনে একই ধরনের সেলাইবিহীন কাপড়, আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্বের ঘোষণা, আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ এবং তারই কাছে গুনাহ মাফ ও রহমত প্রাপ্তির আকুতি।
সূর্যাস্তের সাথে সাথেই আবার মিনায় ফেরার পথে মুজদালিফা নামক স্থানে অবস্থান নেবেন হাজীরা। ওই স্থানে রাতে অবস্থান করবেন খোলা আকাশের নিচে। সেখানে যত রাতই হোক মাগরিব ও এশার নামাজ এক সাথে আদায় করবেন তারা।
মিনায় জামারাতে শয়তানের প্রতিকৃতিতে েিনেপর জন্য এখান থেকেই কঙ্কর সংগ্রহ করবেন। রাতে
সেখানে অবস্থানের পর কাল ১০ জিলহজ শনিবার ফজরের নামাজ শেষে মিনার দিকে রওনা হবেন। কাল সৌদি আরবে ঈদুল আজহা উদযাপিত হবে। মিনায় গিয়ে জামারাতে কঙ্কর নিপে এবং কোরবানি করবেন। মিনায় কোরবানি করার পর হাজিরা মাথা মুণ্ডন করে অথবা চুল ছোট করে ইহরাম ভেঙে ফেলবেন। এরপর তাওয়াফে জিয়ারাহ করার জন্য মক্কায় যাবেন। সেখানে হেরেম শরীফ সংলগ্ন সাফা-মারওয়া নামক পাহাড়দ্বয়ের মাঝে দৌড়াবেন (সায়ি করবেন)। জিলহজের ১১, ১২ তারিখ মিনার তাঁবুতে অবস্থান করেই জামারাতে কঙ্কর নিপে করার নিয়ম। ১২ জিলহজ হজের আনুষ্ঠানিক কার্যাদির সমাপ্তি ঘটবে। কেউ ১২ তারিখে মিনা ত্যাগ না করলে ১৩ তারিখেও তাকে কঙ্কর নিক্ষেপ করতে হবে। মিনার তাঁবুতে অবস্থান করেই পাঁচ দিনের হজের কার্যাদি সম্পন্ন করবেন হাজিরা। আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করা একজন হাজির জন্য পরম সৌভাগ্যের বিষয়। যদিও এই অবস্থান হজের অন্যতম ফরজ। হাজিরা এই দিনটিসহ পুরো হজকার্য সম্পাদনের জন্য আজীবন স্বপ্ন লালন করেন।
আরাফাতের ময়দান দোয়া কবুলের জায়গা। এখানেই আদি পিতা হজরত আদম ও হাওয়া আ:-এর পুনর্মিলন হয়েছিল এবং তাদের দোয়া কবুল হয়েছিল। এই ময়দান রাসূল সা:-এর বিদায় হজের ভাষণের স্মৃতিবিজড়িত। সূর্য হেলে পড়ার পর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত হাজীরা গ্রুপে এবং আলাদা আলাদাভাবে দোয়া করতে থাকেন। দুই হাত উঁচু করে অঝোর ধারায় কান্নাকাটি করেন হাজীরা। গুনাহ মাফের আকুতি ছাড়াও জীবনের সব চাওয়াই আল্লাহর দরবারে পেশ করেন। সূর্যাস্তের পর আরাফার ময়দান ত্যাগের সময় নিজেকে নির্ভার-নিষ্পাপ জ্ঞান করে মুজদালিফার দিকে এগোতে থাকেন আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য ছুটে যাওয়া মুসলমানরা।
হজরত আদম আ: কর্তৃক নির্মিত পৃথিবীর প্রথম ঘর কাবাকে কেন্দ্র করেই মূলত হজের কার্যাদি। আজ থেকে প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে মুসলিম মিল্লাতের পিতা হজরত ইবরাহিম আ: ও তাঁর ছেলে ইসমাঈল আ: এই কাবাঘর পুনর্র্নিমাণ করেন। হজের বেশির ভাগ কাজই হজরত ইবরাহিম আ:, তাঁর স্ত্রী হাজেরা এবং ছেলে ইসমাঈল আ:-এর সম্পাদিত কাজের সাথে সম্পর্কিত। মুসলমানদের পশু কোরবানি আল্লাহর নির্দেশ পালনার্থে ইবরাহিম আ: কর্তৃক স্বীয় শিশুপুত্র ইসমাঈলকে কোরবানি দেয়ার মহান ত্যাগের ঘটনার সাথে সম্পর্কিত।
হজ ইসলামের পঞ্চ স্তম্ভের অন্যতম এবং সামর্থ্যবান মুসলমানের ওপর জীবনে একবার হজ করা ফরজ। এ বছর ২০ লাখের বেশি মুসল্লি পবিত্র হজ পালন করছেন এবং বাংলাদেশী হজযাত্রীর সংখ্যা ৯৮ হাজার ৬০৫ জন।
সৌদি আরব থেকে সিরাজুল হক মানিক জানান, নির্বিঘেœ হাজিদের হজ পালনে ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে সৌদি সরকার। ইতোমধ্যে লক্ষাধিক হজকর্মকর্তা, সিভিল ডিফেন্স কর্মী, নিরাপত্তা কর্মী, ডাক্তার, নার্স, প্যারামেডিক এবং মিডিয়াকর্মীদের নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তদুপরি ১৮টি অত্যাধুনিক হেলিকপ্টারে করে প্রায় ৫০০ বিশেষজ্ঞ নিরাপত্তাকর্মী আকাশে টহল দিচ্ছেন বলে জানিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এ ছাড়াও পবিত্র কাবার আশপাশের সম্প্রসারিত জায়গাগুলো হাজীদের জন্য খুলে দেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে প্রায় ১৩ মিলিয়ন লিটার জমজমের পানি হাজিদের মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে। প্রতিদিন প্রায় ৫৬ হাজার বোতল জমজমের পানি তোলা হচ্ছে বলে জানিয়েছে সৌদি প্রেস এজেন্সি।