রাস্তা দিয়ে যাচ্ছেন, বেড়াতে বা কোনো কাজে, হুট করে একটা মধুর আহ্বান আপনাকে থমকে দিতে পারে—‘ইলিশ নেবেন, স্যার! পদ্মার ইলিশ!’
সারা দেশে ইলিশের জোয়ার বইছে এখন। নদী আর সাগরের মোহনায় দেদার ধরা পড়ছে ছোট-বড় ইলিশ। মাছের আড়ত আর কাঁচাবাজার তো বটেই, ইলিশ ঘুরছে মহল্লা আর পাড়ায় পাড়ায়।
অনেকেই কিন্তু মাছবিক্রেতার এই মিষ্টি আহ্বানে সাড়া না দিয়ে পারেন না। বিশেষ করে কাজের চাপে যাঁদের বাজারটা করা হয়নি, পকেটেও মোটামুটি অর্থ আছে, সস্তায় দাঁও মারার লোভ সামলাতে পারেন না তাঁরা। বিক্রেতা একেবারে পথের ওপরই ঠকাশ করে ঢাউস পাতিলটা রেখে সুন্দর করে সাজানো বরফঢাকা ইলিশ উদোম করেন। তারপর থালার ওপর তিন-চারটা সাজিয়ে ইলিশের তেলতেলে পেটের গোলাপি আভা দেখিয়ে বলেন, ‘নেন, স্যার। খাঁটি পদ্মার ইলিশ!’
কখনো কোনো বিক্রেতাকে বলতে শুনিনি যে এটা মেঘনা বা কর্ণফুলীর ইলিশ। সবারই এক কথা—এটা পদ্মার ইলিশ! তা বেশ। কিন্তু মাছওয়ালা নিশ্চিত হলেন কী করে যে ওটা পদ্মারই ইলিশ, যমুনা বা বলেশ্বরের ইলিশ নয়? তিনি তো আর সরাসরি পদ্মা থেকে ধরে আনেননি। কিনেছেন ওই ঘাট বা আড়ত থেকে। যেখানে ইলিশের ঠিকুজি উদ্ধারের কোনো সুযোগ নেই। নিলামের মালের মতো ডাক দিয়ে যাচাই-বাছাই ছাড়াই লট ধরে কিনতে হয়।
কোনো কৌতূহলী ক্রেতা যদি ইলিশের আসল ঠিকানা উদ্ধারে বাৎচিত করেন, তখন ইলিশওয়ালা পদ্মার ইলিশের চেহারা-সুরত নিয়ে গালভরা একটা লেকচার দিয়ে ফেলেন। কিন্তু তাঁর কথার সত্যতা যাচাই করবে কে? আর ইলিশবিক্রেতার মিঠে কথায় থাকে এমন পলিশ, ক্রেতা পা হড়কাতে বাধ্য। তখন ইলিশ কিনে নিতে দরদাম শুরু করে দেন। ক্রেতাদের মধ্যে কিছু আছেন, যাঁরা আবার ইলিশের ঠাঁই-ঠিকানা নিয়ে অত মাথা ঘামান না। আরে, ইলিশ তো ইলিশই! একটু তেল থাকলেই হলো। ইলিশ বাংলার ইতিহাস-ঐতিহ্যে সুবাস ছড়ালেও এটা যে মূলত লম্বা সফর দেওয়া সাগরের মাছ, এ কথা ছেলেবুড়ো অনেকেরই জানা। আর এই সফরে এসে ইলিশ ঝাঁক বেঁধে সদা সন্তরণে থাকে। তখন একটি ইলিশ কত নদী সফর করে, তার খোঁজ কি আর আমরা জানি?
ইলিশের দাম নিয়েও রয়েছে নানা তেলেসমাতি। সেদিন ঢাকার একটি বিপণিকেন্দ্রে কেনাকাটায় গেছি। মাছ-মাংস বিক্রি করে, এমন একটি অভিজাত দোকান থেকে ইলিশ কেনার প্রস্তাব এল। কিন্তু শোকেসে কোনো ইলিশ নেই। কৌতূহলী হতেই দোকানি তর্জনী তুলে বললেন, ‘ওই বাক্সে আছে ইলিশ।’দেখি, পরপর কয়েটা তাপরোধী বরফের সাদা বাক্স। ডালা তুলে ধরতেই যা দেখলাম, তাতে আমার চোখ জুড়িয়ে গেল। একেকটা ইলিশের ওজন দুই থেকে আড়াই কেজি। কিন্তু দাম শুনে ফটাশ করে চুপসে গেলাম। তিন হাজার টাকা কেজি! অর্থাৎ, দুই কেজি ইলিশের দাম বেশি নয়, মাত্র ছয় হাজার টাকা। দোকানি জোর গলায় বললেন, ‘কমই তো চাইছি। একেবারে সস্তা!’ তাঁর দাবি, ইলিশ দেদার ধরা না পড়লে দাম আরও বেশি হতো।
হ্যাঁ, এটা ঠিক যে অন্যান্য মৌসুমের চেয়ে এখন ইলিশের দাম অনেক কম। ছোট আর বড় ইলিশের দামে রয়েছে গোলকধাঁধা। ৬০০ থেকে ৭০০ গ্রাম ওজনের একটা ইলিশ যেখানে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা, ওজনটা কিলোগ্রাম পার হলেই ধাঁ করে তা হাজারে গিয়ে ঠেকে। সোয়া কেজি থেকে দেড় কেজি ওজনের ইলিশ এখানো দেড় থেকে দুই হাজার টাকা হাঁকে।
জানা গেছে, যাঁরা নদীর বুকে ছোট ছোট নৌকা নিয়ে মাছ ধরেন, তাঁরা কিন্তু এই ওজন নিয়ে এত মাথা ঘামান না। ছোট-বড় মিলিয়ে কয়েকটা একসঙ্গে মোটামুটি দাম পেলেই দিয়ে দেন। আর নদীতে গিয়ে যেসব শৌখিন ক্রেতা এসব ইলিশ কেনেন, তাঁদের কাছে দামটা সহনীয়ই থাকে। এই ইলিশ যেই না ডাঙায় আসে, তখন ইলিশ থাকে নিস্তেজ, লাফাতে থাকে তার দাম। বড় ইলিশের দাম বেশি হবে, ঠিক আছে। কিন্তু এত বেশি কেন? নদীর ইলিশ কি গরু-ছাগল আর হাঁস-মুরগির মতো লালন-পালন করতে হয় যে এর সঙ্গে এই খয়খরচার অঙ্কটাও জুড়ে দিতে হবে!
ইলিশ বিক্রিতেও চলে একধরনের সূক্ষ্ম চালবাজি। সচেতন না হলে প্রতারণা নিশ্চিত। বিক্রেতা কোনো বাসায় পাতিলে করে ইলিশ নিয়ে গেল। সেখানে থাকবে তিন চারটে থালা। প্রথমে চার-পাঁচটা ওপরের থালায় তুলে ক্রেতার সঙ্গে দরদাম করবে। বনিবনা হলে তো হলোই, নইলে ওই মাছ নিয়ে সে ফিরে যাবে। খানিক পর ফিরে এসে বলবে, ‘আপনে অনেক দিনের পরিচিত কাস্টমার, নেন ওই দামেই দিলাম।’
হ্যাঁ, সে দিল ঠিকই, তবে যা দেখিয়েছে, তা নয়। আরেক সাইজ ছোট, যা ছিল নিচের থালায়। কাজেই এ ব্যাপারে সাবধান!