টঙ্গী: আহাজারি। কান্না। মাতম। আরেকটি কারখানা দুর্ঘটনার সাক্ষী হলো বাংলাদেশ। ম্লান হাজারো পরিবারের ঈদের আনন্দ। বাতাসে লাশের গন্ধ।
টঙ্গীতে কারখানায় বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডে অন্তত ২৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন অর্ধশতাধিক। বিস্ফোরণে ধসে পড়েছে পুরো কারখানা ভবন। আগুনে পুড়ে গেছে পুরো ভবনটি। নিহত ২৪ জনের লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে রাখা হয়েছে। আহতদের ঢাকা মেডিকেল, টঙ্গী হাসপাতাল ও বিভিন্ন ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়েছে। দাহ্য পদার্থ থাকায় দিনভর চেষ্টা চালিয়েও আগুন পুরো নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি ফায়ার সার্ভিস। ফলে গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত ভবনে উদ্ধারকাজ শুরু করা যায়নি। দুর্ঘটনার পর বেশ কয়েকজন শ্রমিক নিখোঁজ বলে দাবি করেছেন তাদের স্বজনরা। নিহতের সংখ্যা আরো বাড়তে পারে বলে ধারণা তাদের।
টঙ্গীর বিসিক শিল্প এলাকার ট্যাম্পাকো ফয়েল প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং লিমিটেড নামের কারখানায় গতকাল ভোর ছয়টার দিকে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। বিস্ফোরণের পরপর ভেঙে পড়ে প্রতিষ্ঠানটির দ্বিতল ভবন। ভবনে দাহ্য ও রাসায়নিক পদার্থ থাকায় পাশের চারতলা ভবনেও দ্রুত আগুন ছড়িয়ে পড়ে। পরে তাও ধসে পড়ে। ঘটনার কিছুক্ষণের মধ্যে অগ্নিনির্বাপন ও উদ্ধারকাজে নামে দমকল বাহিনীর ২৫টি ইউনিট। শুরু থেকে দমকল কর্মীরা ভবনের ভেতরে পানি ছিটানোর কাজ চালিয়ে যায়। পাশাপাশি ভেতরে থেকে একে একে বের করে নিয়ে আসে নিহতের লাশ। বের করে আনা হয় আহত শ্রমিকদের। পুরো এলাকায় শোকের ছায়া নেমে আসে। পুরো এলাকায় গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেয়া হয়। এ ঘটনায় পৃথক তিনটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। ঘটনাস্থলে ছুটে যান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, শ্রম প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নুসহ স্থানীয় নেতৃবৃন্দ ও প্রশাসনের বিভিন্ন বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। একাধিক প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে নিহত ও আহতের এবং ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সহায়তায় অর্থবরাদ্দের ঘোষণা দেয়া হয়েছে। রাতে এ প্রতিবেদন লেখার সময় পর্যন্ত আগুন নিয়ন্ত্রণে আসেনি। সিলেটের সাবেক সংসদ সদস্য ড. সৈয়দ মকবুল হোসেনের মালিকাধীন কারখানাটিতে আড়াইশ’ শ্রমিক নিয়োজিত ছিলো। দমকল কর্মী ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ভোর থেকেই টঙ্গী বিসিক শিল্প এলাকা কর্মব্যস্ত হয়ে পড়ে। প্রতিদিনকার মতো একই চিত্র ছিল গতকালও। প্রতিষ্ঠানটিতে তিন শিফটে ২৫০ জনের মতো শ্রমিক কাজ করতো। ভোর ৬টায় রাত ও দিনের শিফট পরিবর্তন হয়। নিয়মিত পালাবদলের অংশ হিসেবে রাতের শিফটের শ্রমিকরা বের হচ্ছিল। বাইরে থেকে এসে কাজে যোগ দিচ্ছিলেন দিনের শিফটের শ্রমিকরা। এক দু’জন করে শ্রমিক বের হচ্ছিলেন ও ঢুকছিলেন। কাজের পালাবদলের এমন সময়ে কিছু বুঝে ওঠার আগেই নিচতলায় গ্যাসের বয়লারটি বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হয়। ছিটকে পড়ে এর বিভিন্ন অংশ। মুহূর্তেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে। বয়লারটি কারখানার নিচতলায় মূলফটকের পাশে ছিল। বিস্ফোরণের সঙ্গে সঙ্গে ওই ভবনটির একাংশ ধসে পড়ে। ভেঙে পড়ে ছাদ। রাস্তায় ভেঙে পড়ে সীমানা প্রাচীর। সীমানা প্রাচীরের নিচে চাপা পড়ে মারা যান এক রিকশাচালক ও দুই যাত্রী। এর মধ্যে নারী যাত্রীও ছিলেন। আগুন দ্রুত নিচতলার বারান্দা ও কক্ষে রাখা ট্যাবলেটের স্ট্রিপ্ট, পটেটো চিপস, সিগারেট ও বিস্কুটের ফয়েলপ্যাক তৈরির বিভিন্ন কাঁচামাল ও কেমিক্যালের ড্রামগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে। দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে পাশের চারতলাবিশিষ্ট ভবনেও। এ অবস্থায় হতভম্ব হয়ে পড়ে কারখানার ভেতরের শ্রমিকরা। হুড়াহুড়ি করে বের হতে গিয়ে অনেকে আহত হন। দমকল কর্মীরা উদ্ধার কাজে নামেন। অগ্নিদগ্ধ, আহত ও হুড়োহুড়িতে মারা যান কারখানার শিফট ইনচার্জ সুভাষ চন্দ্র দাস, ইদ্রিস আলী, আল মামুন, নিরাপত্তাকর্মী জাহাঙ্গীর আলম, দেলোয়ার হোসেন, আবদুল হান্নান, শ্রমিক জাহিদুল ইসলাম, আনোয়ার হোসেন, রফিকুল ইসলাম। এছাড়া দুই পথচারী ও মহিলাসহ নিহতের সংখ্যা সর্বশেষ ২৪ জনে দাঁড়িয়েছে। আহত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে আসিফ, রোকন, দিলীপ চন্দ্র রায়, ফেরদৌস আলম, আবু সাঈদ, আকবর আলী, শহিদুল ইসলাম, আব্দুর রাজ্জাক, লিটন, মাহবুব, কামরুল ইসলাম, জাকির হোসেন, মিজানুর রহমান, নিজামউদ্দিন, শহিদুল, মনোয়ার, শাহ আলমসহ অন্তত ৫০ জনকে। এদের মধ্যে আশংকাজনক অবস্থায় অন্তত ৩০ জনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজসহ বিভিন্ন হাসপাতালে নেয়া হয়।
প্রত্যক্ষদর্শী ট্যাম্পাকোর সামনের পাকিজা নিট কম্পোজিট লিমিটেডের নিরাপত্তা প্রহরী লস্কর আমানুল হক মানবজমিনকে বলেন, আমি গেইটে বসেছিলাম। এসময় পাশ থেকেই বিকট শব্দ শুনতে পাই। ফিরে দেখি ট্যাম্পাকোর ছাদ ভেঙে পড়ছে। প্রায় তখনই আমাদের ভবনও কেঁপে উঠে। জানালার কাচগুলো ভেঙে আমাদের গায়ের ওপর পড়তে থাকে। এসময় চাপা পড়তে দেখি পথচারীদের। আতঙ্কিত হয়ে পড়ি। আমাদের ভবনের জানালার কাচ ভেঙে পড়ে পা কেটে গেছে। ওই শব্দের পর থেকে বাম কানে ব্যথা হচ্ছে। ওই কানে কিছু শুনতে পাচ্ছি না।
গাজীপুরের জেলা প্রশাসক এসএম আলম মানবজমিনকে বলেন, বয়লারের সঙ্গে গ্যাসের সংযোগে ত্রুটির কারণে এই বিস্ফোরণ ঘটেছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিহতের স্বজন ও আহতদের মধ্যে অর্থ সহায়তা দেয়া হবে। তদন্তে একটি কমিটিও গঠন করা হয়েছে।
এদিকে ঘটনার পর পুরো এলাকায় মানুষের ঢল নামে। ট্যাম্পাকোর পাশের রেললাইন, আহসান উল্লাহ মাস্টার ফ্লাইওভারের উপর-নিচ, বিসিক মোড়, প্রধান সড়ক লোকে লোকারণ্য হয়ে পড়ে। কিন্তু ঘটনাস্থলের দিকে এগুতে পারছিলেন না স্থানীয়রা। দমকল বাহিনীও ঘটনাস্থলের আশপাশ থেকে প্রথমেই পথচারীদের সরিয়ে দেয়। ধোঁয়ার বিশাল কালো কুণ্ডলী যেন মিশে যাচ্ছিল মেঘের সঙ্গে। তা দেখা যাচ্ছিল বেশ কয়েক কিলোমিটার দূর থেকে। ঘনঘন দমকল বাহিনীর পানিবাহী গাড়ি প্রবেশ ও বের হচ্ছিল। ট্যাম্পাকো এলাকা খুব বেশি বড় না হওয়ায় একই সঙ্গে অংশ নিতে পারছিলেন না উপস্থিত ২৫ ইউনিটের ১৫০ কর্মী। সামনের দিক থেকে কয়েকটি পাইপে পানি ছিটানো হচ্ছিল। চতুর্থ তলায় পানি ছিটানোর জন্য ব্যবহার করা হয় ক্রেন। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত আগুন নিয়ন্ত্রণে অগ্রগতি চোখে পড়েনি। দুপুরের দিকে নামে বৃষ্টি। বৃষ্টিতে ভিজে আগুনের তাণ্ডবলীলা দেখছিলেন স্থানীয়রা। দমকা বৃষ্টির পানিও ভেতরে ঢুকছিল না। ফলে সন্ধ্যা পর্যন্ত টানা পানি ছিটিয়ে যাচ্ছিলেন দমকল কর্মীরা। ভেতরে দাহ্য ও রাসায়নিক পদার্থ থাকায় আগুনের লেলিহান শিখা কিছুক্ষণ পর পর বের হচ্ছিল। কিছুক্ষণ পর পর বের করা হচ্ছিল লাশ। আনা হচ্ছিল আহতদের। এরপর অ্যাম্বুলেন্সযোগে দ্রুত পাঠানো হচ্ছিল হাসপাতালে। টঙ্গী সরকারি হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক ডা. পারভেজ হোসেন বলেন, ওই কারখানার বিস্ফোরিত বয়লারের টুকরার আঘাতে ও আগুনে দগ্ধ অবস্থায় নিহত ও আহতদের আনা হচ্ছে। আহতদের চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। গুরুতরদেরকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে।
এদিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও শ্রম প্রতিমন্ত্রী ছাড়াও ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন স্থানীয় সংসদ সদস্য জাহিদ আহসান রাসেল, গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ভারপ্রাপ্ত মেয়র আসাদুর রহমান কিরণ, পুলিশের মহাপরিদর্শক একেএম শহীদুল হক, গাজীপুরের জেলা প্রশাসক এস এম আলম।
এ ঘটনা তদন্তে পৃথক তিনটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। সকালে গাজীপুর জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট রায়হানুল ইসলামকে প্রধান করে ৫ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটিতে জেলা ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশ, ফায়ার সার্ভিসের প্রতিনিধি রাখা হয়েছে। এ কমিটিকে ৭ দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন গাজীপুর জেলা প্রশাসক। এছাড়া, শ্রম মন্ত্রণালয় ও গাজীপুর সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে আরো দু’টি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
ঘটনাস্থলে উপস্থিত হওয়ার পর শ্রম প্রতিমন্ত্রী মজিবুল হক চুন্নু মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে নিহত শ্রমিকদের পরিবারকে দু’লাখ টাকা করে আর্থিক সহায়তার ঘোষণা দেন। এছাড়া, জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিহতদের পরিবারকে ২০ এবং আহতদের পরিবারকে ১০ হাজার টাকা করে আর্থিক সহায়তা প্রদানের ঘোষণা দেয়া হয়েছে।
ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের পরিচালক আনিস মাহমুদ বলেন, বয়লার বিস্ফোরণে কারখানায় এ ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়েছে। বয়লারটি কারখানার মূলফটকে থাকায় বিস্ফোরণে দেয়াল ধসে পড়ে। কালো ধোঁয়ার পুরো কারখানা আচ্ছন্ন হয়ে যাওয়ার কারণে শ্রমিকরা বের হতে পারেনি। দেয়াল চাপায়ও কয়েকজনের মৃত্যু হয়েছে। আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসলে হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতির বিস্তারিত তথ্য জানা যাবে।
কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে বেঁচে যান ইয়ামিন: মাত্র কয়েক সেকেন্ডের জন্য প্রাণে বেঁচে গেলেন কাছের ডেসকো বায়তুল মামুর জামে মসজিদের মুয়াজ্জিন ইয়ামিন সরকার। প্রতিদিনের মতো প্রাতঃভ্রমণের সময় কারখানাটির কাছে পৌঁছলেই বিস্ফোরণের শব্দ শুনেন। মুহূর্তেই উল্টো ফিরে দৌড় না দিলেই নির্ঘাত ভবনের ছাদ ও সীমানা প্রাচীর চাপায় মারা পড়তেন। তিনি বলেন, আমি ফজরের নামাজ শেষ করে ট্যাম্পাকোর দিকে হাঁটছিলাম। ট্যাম্পাকোর কাছে যেতেই বিকট শব্দে একটি দেওয়াল যেন আমার উপর ভেঙে পড়ছিলো। উল্টো দৌড়ে দ্রুত চলে আসি। এরপর পুরো ভবনে আগুন ছড়িয়ে পড়তে দেখি।
ট্যাম্পাকো ব্যবস্থাপক মনিরুজ্জামান মানবজমিনকে বলেন, আমার প্রতিষ্ঠানে ২৫০ জনের মতো শ্রমিক কাজ করতেন। তিন শিফটে কাজ চলতো। গতকাল রাতের শিফটে ৩০ জনের মতো শ্রমিক কাজে ছিলো। সকাল ৬টায় শিফট পরিবর্তন করার কথা। ৬টার ঠিক আগ মুহূর্তে এই বিস্ফোরণ ঘটেছে। বিস্ফোরণের আগে ঠিক কতজন শ্রমিক কারখানায় ঢুকেছে তা বলতে পারছি না। আগামীকাল (আজ) রোববার কারখানার শ্রমিকদের ঈদের ছুটিতে যাওয়ার কথা ছিল।
গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ: বিস্ফোরণের পর পর পুরো এলাকার গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেয়া হয়। এতে ওইদিন বিসিক শিল্প এলাকার কারখানায় উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে। বাসাবাড়িতে গ্যাস সংযোগ না থাকায় দুর্ভোগে পড়েন গৃহিণীরা। তবে দুপুরের দিকে বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক করা হয়। এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত দেয়া হয়নি গ্যাস সংযোগ। ১৪ বছর ধরে ট্যাম্পাকোতে কর্মরত বর্তমান ব্যবস্থাপক মনিরুজ্জামান বলেন, দেশি-বিদেশি খ্যাতিমান প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আমাদের ব্যবসা থাকায় আমরা যথেষ্ট শৃঙ্খলা ও সতর্কতার সঙ্গে কারখানা পরিচালনা করে আসছিলাম। একটি দুর্ঘটনা মুহূর্তেই সবকিছু শেষ করে দিলো।
বিস্ফোরণের শব্দে ঘুম ভাঙে স্থানীয়দের: স্থানীয়দের অনেকের ওই দিনের ঘুম ভাঙে বয়লার বিস্ফোরণের শব্দে। বিকট শব্দে ঘুমন্ত শিশুরা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে বড়দের মাঝেও। ঘরের বাইরে বের হয়ে দেখে এক স্থান থেকে ধোঁয়া উঠছে। ক্রমেই তা বাড়ছে। তা দেখে স্থানীয়রা ঘটনাস্থলের দিকে ছুটে যায়। কিন্তু আগুনের লেলিহান শিখা বাইরে বের হয়ে আসায় কেউ কাছে ভিড়তে পারেনি। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ওই কারখানা ঘিরে পুরো এলাকার কয়েক হাজার মানুষ দীর্ঘ সময় ধরে তা দেখে। ঘটনাস্থল থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে বিস্ফোরণের শব্দে ঘুম ভাঙে স্থানীয় সাজ্জাদ নাদিমের। তিনি বলেন, বিস্ফোরণে আমার ঘুম ভাঙে। বাসায় এক শিশু কান্না জুড়ে দেয়। ঘর থেকে বের হয়ে দেখি এই দুর্ঘটনা।
এক কিলোমিটার দূরে শব্দ ও কম্পন: স্থানীয়রা জানান, ঘটনাস্থল থেকে এক কিলোমিটার দূরে পর্যন্ত বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে। কম্পন অনুভূত হয়েছে। হাজী সাঈদ ল্যাবরেটরি স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা সৈয়দ আতিক বলেন, আমি ঘটনাস্থল থেকে এক কিলোমিটার দূরে বাসায় ছিলাম। হঠাৎ বিস্ফোরণের শব্দ শুনি। একই সঙ্গে কম্পনও অনুভব করি। বাড়ি থেকে বের হয়ে সূত্রের সন্ধান খুঁজতে গিয়ে বিসিক শিল্প এলাকার প্রবেশ পথে ধোঁয়া দেখি। ওই এলাকায় ছুটে গেলেও আগুনের লেলিহান শিখার কারণে কাছে ভিড়তে পারিনি।
পাশের কয়েকটি কারখানার কাঁচ ভেঙেছে, আহত হয়েছে কর্মচারীরা: ট্যাম্পাকোর বয়লার বিস্ফোরণের প্রচণ্ড শব্দে আশপাশের অন্তত অর্ধডজন প্রতিষ্ঠানের কাচ ভেঙে গেছে। তা গায়ের ওপর পড়ে আহত হয়েছেন বেশ কয়েকজন শ্রমিক ও পথচারী। ট্যাম্পাকোর পূর্ব পাশের একাধিক খালি প্লটের পরে স্টিচ গার্মেন্টসের জানালার কাচ ভেঙে টুকরোগুলো রাস্তায় এসে পড়ে। এই প্রতিষ্ঠানের দু’কর্মচারী আকবর (৩৫) ও রাজ্জাক (৩২) আহত হন। তাদেরকে হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। এছাড়া এর সামনের নিট কম্পোজিট লিমিটেডের দু’নিরাপত্তা প্রহরীও আহত হয়েছেন। এছাড়া, ওই সড়কের কয়েক গজ পর্যন্ত রাস্তায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ভেঙে পড়া কাচ।
অল্পের জন্য রক্ষা পেলো সোনালী ব্যাংক: ট্যাম্পাকোর দেয়াল ঘেঁষেই রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের টঙ্গী শাখা। ওই ভবনটির ছাদ ভেঙে রাস্তায় না পড়ে উত্তরদিকে পড়লে ক্ষতিগ্রস্ত হতো ব্যাংকটির ভবন। বাতাসের প্রবাহও ওই মুখী না হওয়ায় সেদিকে ছড়ায়নি আগুন। দমকল বাহিনী উদ্ধারকাজ শুরুর প্রথম থেকেই আগুন যাতে সেদিকে না ছড়ায় তার ব্যবস্থা নেয়।
খালেদার শোক: গাজীপুরের টঙ্গীর শিল্পনগরী এলাকায় ট্যাম্পাকো ফয়েলস প্যাকেজিং কারখানায় বয়লার বিস্ফোরণে মর্মান্তিকভাবে নিহতের ঘটনায় গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। গতকাল এক শোকবার্তায় তিনি বলেন, পবিত্র ঈদুল আযহার আগে এ ধরনের মর্মান্তিক ঘটনায় বহুসংখ্যক শ্রমজীবী মানুষ হতাহতের ঘটনায় নিহতদের পরিবারের সঙ্গে আমিও গভীরভাবে ব্যথিত ও শোকাহত। আমি শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি। আহতদের আশু-সুস্থতা কামনা ও তাদের সুচিকিৎসা ব্যবস্থা করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি জোর দাবি জানাচ্ছি। আলাদা শোকবার্তায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও শোক প্রকাশ করেন এবং আহতদের সুচিকিৎসার দাবি জানান।
টঙ্গীতে কারখানায় বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডে অন্তত ২৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন অর্ধশতাধিক। বিস্ফোরণে ধসে পড়েছে পুরো কারখানা ভবন। আগুনে পুড়ে গেছে পুরো ভবনটি। নিহত ২৪ জনের লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে রাখা হয়েছে। আহতদের ঢাকা মেডিকেল, টঙ্গী হাসপাতাল ও বিভিন্ন ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়েছে। দাহ্য পদার্থ থাকায় দিনভর চেষ্টা চালিয়েও আগুন পুরো নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি ফায়ার সার্ভিস। ফলে গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত ভবনে উদ্ধারকাজ শুরু করা যায়নি। দুর্ঘটনার পর বেশ কয়েকজন শ্রমিক নিখোঁজ বলে দাবি করেছেন তাদের স্বজনরা। নিহতের সংখ্যা আরো বাড়তে পারে বলে ধারণা তাদের।
টঙ্গীর বিসিক শিল্প এলাকার ট্যাম্পাকো ফয়েল প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিং লিমিটেড নামের কারখানায় গতকাল ভোর ছয়টার দিকে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। বিস্ফোরণের পরপর ভেঙে পড়ে প্রতিষ্ঠানটির দ্বিতল ভবন। ভবনে দাহ্য ও রাসায়নিক পদার্থ থাকায় পাশের চারতলা ভবনেও দ্রুত আগুন ছড়িয়ে পড়ে। পরে তাও ধসে পড়ে। ঘটনার কিছুক্ষণের মধ্যে অগ্নিনির্বাপন ও উদ্ধারকাজে নামে দমকল বাহিনীর ২৫টি ইউনিট। শুরু থেকে দমকল কর্মীরা ভবনের ভেতরে পানি ছিটানোর কাজ চালিয়ে যায়। পাশাপাশি ভেতরে থেকে একে একে বের করে নিয়ে আসে নিহতের লাশ। বের করে আনা হয় আহত শ্রমিকদের। পুরো এলাকায় শোকের ছায়া নেমে আসে। পুরো এলাকায় গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেয়া হয়। এ ঘটনায় পৃথক তিনটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। ঘটনাস্থলে ছুটে যান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, শ্রম প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নুসহ স্থানীয় নেতৃবৃন্দ ও প্রশাসনের বিভিন্ন বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। একাধিক প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে নিহত ও আহতের এবং ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সহায়তায় অর্থবরাদ্দের ঘোষণা দেয়া হয়েছে। রাতে এ প্রতিবেদন লেখার সময় পর্যন্ত আগুন নিয়ন্ত্রণে আসেনি। সিলেটের সাবেক সংসদ সদস্য ড. সৈয়দ মকবুল হোসেনের মালিকাধীন কারখানাটিতে আড়াইশ’ শ্রমিক নিয়োজিত ছিলো। দমকল কর্মী ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ভোর থেকেই টঙ্গী বিসিক শিল্প এলাকা কর্মব্যস্ত হয়ে পড়ে। প্রতিদিনকার মতো একই চিত্র ছিল গতকালও। প্রতিষ্ঠানটিতে তিন শিফটে ২৫০ জনের মতো শ্রমিক কাজ করতো। ভোর ৬টায় রাত ও দিনের শিফট পরিবর্তন হয়। নিয়মিত পালাবদলের অংশ হিসেবে রাতের শিফটের শ্রমিকরা বের হচ্ছিল। বাইরে থেকে এসে কাজে যোগ দিচ্ছিলেন দিনের শিফটের শ্রমিকরা। এক দু’জন করে শ্রমিক বের হচ্ছিলেন ও ঢুকছিলেন। কাজের পালাবদলের এমন সময়ে কিছু বুঝে ওঠার আগেই নিচতলায় গ্যাসের বয়লারটি বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হয়। ছিটকে পড়ে এর বিভিন্ন অংশ। মুহূর্তেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে। বয়লারটি কারখানার নিচতলায় মূলফটকের পাশে ছিল। বিস্ফোরণের সঙ্গে সঙ্গে ওই ভবনটির একাংশ ধসে পড়ে। ভেঙে পড়ে ছাদ। রাস্তায় ভেঙে পড়ে সীমানা প্রাচীর। সীমানা প্রাচীরের নিচে চাপা পড়ে মারা যান এক রিকশাচালক ও দুই যাত্রী। এর মধ্যে নারী যাত্রীও ছিলেন। আগুন দ্রুত নিচতলার বারান্দা ও কক্ষে রাখা ট্যাবলেটের স্ট্রিপ্ট, পটেটো চিপস, সিগারেট ও বিস্কুটের ফয়েলপ্যাক তৈরির বিভিন্ন কাঁচামাল ও কেমিক্যালের ড্রামগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে। দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে পাশের চারতলাবিশিষ্ট ভবনেও। এ অবস্থায় হতভম্ব হয়ে পড়ে কারখানার ভেতরের শ্রমিকরা। হুড়াহুড়ি করে বের হতে গিয়ে অনেকে আহত হন। দমকল কর্মীরা উদ্ধার কাজে নামেন। অগ্নিদগ্ধ, আহত ও হুড়োহুড়িতে মারা যান কারখানার শিফট ইনচার্জ সুভাষ চন্দ্র দাস, ইদ্রিস আলী, আল মামুন, নিরাপত্তাকর্মী জাহাঙ্গীর আলম, দেলোয়ার হোসেন, আবদুল হান্নান, শ্রমিক জাহিদুল ইসলাম, আনোয়ার হোসেন, রফিকুল ইসলাম। এছাড়া দুই পথচারী ও মহিলাসহ নিহতের সংখ্যা সর্বশেষ ২৪ জনে দাঁড়িয়েছে। আহত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে আসিফ, রোকন, দিলীপ চন্দ্র রায়, ফেরদৌস আলম, আবু সাঈদ, আকবর আলী, শহিদুল ইসলাম, আব্দুর রাজ্জাক, লিটন, মাহবুব, কামরুল ইসলাম, জাকির হোসেন, মিজানুর রহমান, নিজামউদ্দিন, শহিদুল, মনোয়ার, শাহ আলমসহ অন্তত ৫০ জনকে। এদের মধ্যে আশংকাজনক অবস্থায় অন্তত ৩০ জনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজসহ বিভিন্ন হাসপাতালে নেয়া হয়।
প্রত্যক্ষদর্শী ট্যাম্পাকোর সামনের পাকিজা নিট কম্পোজিট লিমিটেডের নিরাপত্তা প্রহরী লস্কর আমানুল হক মানবজমিনকে বলেন, আমি গেইটে বসেছিলাম। এসময় পাশ থেকেই বিকট শব্দ শুনতে পাই। ফিরে দেখি ট্যাম্পাকোর ছাদ ভেঙে পড়ছে। প্রায় তখনই আমাদের ভবনও কেঁপে উঠে। জানালার কাচগুলো ভেঙে আমাদের গায়ের ওপর পড়তে থাকে। এসময় চাপা পড়তে দেখি পথচারীদের। আতঙ্কিত হয়ে পড়ি। আমাদের ভবনের জানালার কাচ ভেঙে পড়ে পা কেটে গেছে। ওই শব্দের পর থেকে বাম কানে ব্যথা হচ্ছে। ওই কানে কিছু শুনতে পাচ্ছি না।
গাজীপুরের জেলা প্রশাসক এসএম আলম মানবজমিনকে বলেন, বয়লারের সঙ্গে গ্যাসের সংযোগে ত্রুটির কারণে এই বিস্ফোরণ ঘটেছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিহতের স্বজন ও আহতদের মধ্যে অর্থ সহায়তা দেয়া হবে। তদন্তে একটি কমিটিও গঠন করা হয়েছে।
এদিকে ঘটনার পর পুরো এলাকায় মানুষের ঢল নামে। ট্যাম্পাকোর পাশের রেললাইন, আহসান উল্লাহ মাস্টার ফ্লাইওভারের উপর-নিচ, বিসিক মোড়, প্রধান সড়ক লোকে লোকারণ্য হয়ে পড়ে। কিন্তু ঘটনাস্থলের দিকে এগুতে পারছিলেন না স্থানীয়রা। দমকল বাহিনীও ঘটনাস্থলের আশপাশ থেকে প্রথমেই পথচারীদের সরিয়ে দেয়। ধোঁয়ার বিশাল কালো কুণ্ডলী যেন মিশে যাচ্ছিল মেঘের সঙ্গে। তা দেখা যাচ্ছিল বেশ কয়েক কিলোমিটার দূর থেকে। ঘনঘন দমকল বাহিনীর পানিবাহী গাড়ি প্রবেশ ও বের হচ্ছিল। ট্যাম্পাকো এলাকা খুব বেশি বড় না হওয়ায় একই সঙ্গে অংশ নিতে পারছিলেন না উপস্থিত ২৫ ইউনিটের ১৫০ কর্মী। সামনের দিক থেকে কয়েকটি পাইপে পানি ছিটানো হচ্ছিল। চতুর্থ তলায় পানি ছিটানোর জন্য ব্যবহার করা হয় ক্রেন। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত আগুন নিয়ন্ত্রণে অগ্রগতি চোখে পড়েনি। দুপুরের দিকে নামে বৃষ্টি। বৃষ্টিতে ভিজে আগুনের তাণ্ডবলীলা দেখছিলেন স্থানীয়রা। দমকা বৃষ্টির পানিও ভেতরে ঢুকছিল না। ফলে সন্ধ্যা পর্যন্ত টানা পানি ছিটিয়ে যাচ্ছিলেন দমকল কর্মীরা। ভেতরে দাহ্য ও রাসায়নিক পদার্থ থাকায় আগুনের লেলিহান শিখা কিছুক্ষণ পর পর বের হচ্ছিল। কিছুক্ষণ পর পর বের করা হচ্ছিল লাশ। আনা হচ্ছিল আহতদের। এরপর অ্যাম্বুলেন্সযোগে দ্রুত পাঠানো হচ্ছিল হাসপাতালে। টঙ্গী সরকারি হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক ডা. পারভেজ হোসেন বলেন, ওই কারখানার বিস্ফোরিত বয়লারের টুকরার আঘাতে ও আগুনে দগ্ধ অবস্থায় নিহত ও আহতদের আনা হচ্ছে। আহতদের চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। গুরুতরদেরকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে।
এদিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও শ্রম প্রতিমন্ত্রী ছাড়াও ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন স্থানীয় সংসদ সদস্য জাহিদ আহসান রাসেল, গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ভারপ্রাপ্ত মেয়র আসাদুর রহমান কিরণ, পুলিশের মহাপরিদর্শক একেএম শহীদুল হক, গাজীপুরের জেলা প্রশাসক এস এম আলম।
এ ঘটনা তদন্তে পৃথক তিনটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। সকালে গাজীপুর জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট রায়হানুল ইসলামকে প্রধান করে ৫ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটিতে জেলা ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশ, ফায়ার সার্ভিসের প্রতিনিধি রাখা হয়েছে। এ কমিটিকে ৭ দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন গাজীপুর জেলা প্রশাসক। এছাড়া, শ্রম মন্ত্রণালয় ও গাজীপুর সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে আরো দু’টি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
ঘটনাস্থলে উপস্থিত হওয়ার পর শ্রম প্রতিমন্ত্রী মজিবুল হক চুন্নু মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে নিহত শ্রমিকদের পরিবারকে দু’লাখ টাকা করে আর্থিক সহায়তার ঘোষণা দেন। এছাড়া, জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিহতদের পরিবারকে ২০ এবং আহতদের পরিবারকে ১০ হাজার টাকা করে আর্থিক সহায়তা প্রদানের ঘোষণা দেয়া হয়েছে।
ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের পরিচালক আনিস মাহমুদ বলেন, বয়লার বিস্ফোরণে কারখানায় এ ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়েছে। বয়লারটি কারখানার মূলফটকে থাকায় বিস্ফোরণে দেয়াল ধসে পড়ে। কালো ধোঁয়ার পুরো কারখানা আচ্ছন্ন হয়ে যাওয়ার কারণে শ্রমিকরা বের হতে পারেনি। দেয়াল চাপায়ও কয়েকজনের মৃত্যু হয়েছে। আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসলে হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতির বিস্তারিত তথ্য জানা যাবে।
কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে বেঁচে যান ইয়ামিন: মাত্র কয়েক সেকেন্ডের জন্য প্রাণে বেঁচে গেলেন কাছের ডেসকো বায়তুল মামুর জামে মসজিদের মুয়াজ্জিন ইয়ামিন সরকার। প্রতিদিনের মতো প্রাতঃভ্রমণের সময় কারখানাটির কাছে পৌঁছলেই বিস্ফোরণের শব্দ শুনেন। মুহূর্তেই উল্টো ফিরে দৌড় না দিলেই নির্ঘাত ভবনের ছাদ ও সীমানা প্রাচীর চাপায় মারা পড়তেন। তিনি বলেন, আমি ফজরের নামাজ শেষ করে ট্যাম্পাকোর দিকে হাঁটছিলাম। ট্যাম্পাকোর কাছে যেতেই বিকট শব্দে একটি দেওয়াল যেন আমার উপর ভেঙে পড়ছিলো। উল্টো দৌড়ে দ্রুত চলে আসি। এরপর পুরো ভবনে আগুন ছড়িয়ে পড়তে দেখি।
ট্যাম্পাকো ব্যবস্থাপক মনিরুজ্জামান মানবজমিনকে বলেন, আমার প্রতিষ্ঠানে ২৫০ জনের মতো শ্রমিক কাজ করতেন। তিন শিফটে কাজ চলতো। গতকাল রাতের শিফটে ৩০ জনের মতো শ্রমিক কাজে ছিলো। সকাল ৬টায় শিফট পরিবর্তন করার কথা। ৬টার ঠিক আগ মুহূর্তে এই বিস্ফোরণ ঘটেছে। বিস্ফোরণের আগে ঠিক কতজন শ্রমিক কারখানায় ঢুকেছে তা বলতে পারছি না। আগামীকাল (আজ) রোববার কারখানার শ্রমিকদের ঈদের ছুটিতে যাওয়ার কথা ছিল।
গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ: বিস্ফোরণের পর পর পুরো এলাকার গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেয়া হয়। এতে ওইদিন বিসিক শিল্প এলাকার কারখানায় উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে। বাসাবাড়িতে গ্যাস সংযোগ না থাকায় দুর্ভোগে পড়েন গৃহিণীরা। তবে দুপুরের দিকে বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক করা হয়। এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত দেয়া হয়নি গ্যাস সংযোগ। ১৪ বছর ধরে ট্যাম্পাকোতে কর্মরত বর্তমান ব্যবস্থাপক মনিরুজ্জামান বলেন, দেশি-বিদেশি খ্যাতিমান প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আমাদের ব্যবসা থাকায় আমরা যথেষ্ট শৃঙ্খলা ও সতর্কতার সঙ্গে কারখানা পরিচালনা করে আসছিলাম। একটি দুর্ঘটনা মুহূর্তেই সবকিছু শেষ করে দিলো।
বিস্ফোরণের শব্দে ঘুম ভাঙে স্থানীয়দের: স্থানীয়দের অনেকের ওই দিনের ঘুম ভাঙে বয়লার বিস্ফোরণের শব্দে। বিকট শব্দে ঘুমন্ত শিশুরা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে বড়দের মাঝেও। ঘরের বাইরে বের হয়ে দেখে এক স্থান থেকে ধোঁয়া উঠছে। ক্রমেই তা বাড়ছে। তা দেখে স্থানীয়রা ঘটনাস্থলের দিকে ছুটে যায়। কিন্তু আগুনের লেলিহান শিখা বাইরে বের হয়ে আসায় কেউ কাছে ভিড়তে পারেনি। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ওই কারখানা ঘিরে পুরো এলাকার কয়েক হাজার মানুষ দীর্ঘ সময় ধরে তা দেখে। ঘটনাস্থল থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে বিস্ফোরণের শব্দে ঘুম ভাঙে স্থানীয় সাজ্জাদ নাদিমের। তিনি বলেন, বিস্ফোরণে আমার ঘুম ভাঙে। বাসায় এক শিশু কান্না জুড়ে দেয়। ঘর থেকে বের হয়ে দেখি এই দুর্ঘটনা।
এক কিলোমিটার দূরে শব্দ ও কম্পন: স্থানীয়রা জানান, ঘটনাস্থল থেকে এক কিলোমিটার দূরে পর্যন্ত বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে। কম্পন অনুভূত হয়েছে। হাজী সাঈদ ল্যাবরেটরি স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা সৈয়দ আতিক বলেন, আমি ঘটনাস্থল থেকে এক কিলোমিটার দূরে বাসায় ছিলাম। হঠাৎ বিস্ফোরণের শব্দ শুনি। একই সঙ্গে কম্পনও অনুভব করি। বাড়ি থেকে বের হয়ে সূত্রের সন্ধান খুঁজতে গিয়ে বিসিক শিল্প এলাকার প্রবেশ পথে ধোঁয়া দেখি। ওই এলাকায় ছুটে গেলেও আগুনের লেলিহান শিখার কারণে কাছে ভিড়তে পারিনি।
পাশের কয়েকটি কারখানার কাঁচ ভেঙেছে, আহত হয়েছে কর্মচারীরা: ট্যাম্পাকোর বয়লার বিস্ফোরণের প্রচণ্ড শব্দে আশপাশের অন্তত অর্ধডজন প্রতিষ্ঠানের কাচ ভেঙে গেছে। তা গায়ের ওপর পড়ে আহত হয়েছেন বেশ কয়েকজন শ্রমিক ও পথচারী। ট্যাম্পাকোর পূর্ব পাশের একাধিক খালি প্লটের পরে স্টিচ গার্মেন্টসের জানালার কাচ ভেঙে টুকরোগুলো রাস্তায় এসে পড়ে। এই প্রতিষ্ঠানের দু’কর্মচারী আকবর (৩৫) ও রাজ্জাক (৩২) আহত হন। তাদেরকে হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। এছাড়া এর সামনের নিট কম্পোজিট লিমিটেডের দু’নিরাপত্তা প্রহরীও আহত হয়েছেন। এছাড়া, ওই সড়কের কয়েক গজ পর্যন্ত রাস্তায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ভেঙে পড়া কাচ।
অল্পের জন্য রক্ষা পেলো সোনালী ব্যাংক: ট্যাম্পাকোর দেয়াল ঘেঁষেই রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের টঙ্গী শাখা। ওই ভবনটির ছাদ ভেঙে রাস্তায় না পড়ে উত্তরদিকে পড়লে ক্ষতিগ্রস্ত হতো ব্যাংকটির ভবন। বাতাসের প্রবাহও ওই মুখী না হওয়ায় সেদিকে ছড়ায়নি আগুন। দমকল বাহিনী উদ্ধারকাজ শুরুর প্রথম থেকেই আগুন যাতে সেদিকে না ছড়ায় তার ব্যবস্থা নেয়।
খালেদার শোক: গাজীপুরের টঙ্গীর শিল্পনগরী এলাকায় ট্যাম্পাকো ফয়েলস প্যাকেজিং কারখানায় বয়লার বিস্ফোরণে মর্মান্তিকভাবে নিহতের ঘটনায় গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। গতকাল এক শোকবার্তায় তিনি বলেন, পবিত্র ঈদুল আযহার আগে এ ধরনের মর্মান্তিক ঘটনায় বহুসংখ্যক শ্রমজীবী মানুষ হতাহতের ঘটনায় নিহতদের পরিবারের সঙ্গে আমিও গভীরভাবে ব্যথিত ও শোকাহত। আমি শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি। আহতদের আশু-সুস্থতা কামনা ও তাদের সুচিকিৎসা ব্যবস্থা করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি জোর দাবি জানাচ্ছি। আলাদা শোকবার্তায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও শোক প্রকাশ করেন এবং আহতদের সুচিকিৎসার দাবি জানান।