আমি আমার ছোটবেলার নারায়ণগঞ্জকে চাই

Slider ঢাকা ফুলজান বিবির বাংলা

30672_ivy

 

নারায়ণগঞ্জে: রাজনীতির জন্য ত্যাগ করেছেন পেশা। সংসারেও মন দিতে পারেননি নিজের মতো। তার স্বপ্নে শুধুই নারায়ণগঞ্জ। দীর্ঘ একযুগ ধরে নারায়ণগঞ্জের জনপ্রতিনিধি। পৌরসভার চেয়ারম্যান থেকে সিটি কর্পোরেশনের মেয়র। তিনি ডাক্তার সেলিনা হায়াৎ আইভী।
দীর্ঘ এ পথচলা তার মসৃণ ছিল না। প্রতিপক্ষের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয়েছে রাজপথে। কথার যুদ্ধ, কৌশলের যুদ্ধ, উন্নয়নের যুদ্ধ। তারপরও এগিয়ে যাচ্ছেন সামনের দিকে। সিটি কর্পোরেশনের নিজ দপ্তরে বসে নগরবাসীর একের পর এক সমস্যার কথা শুনছেন। সমাধানে পদক্ষেপ নিচ্ছেন। স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়া, জমি দখল, রাস্তা নিয়ে বিরোধ, কবরস্থান দখলের নালিশ শুনছেন অনবরত। অ্যাকশনও সঙ্গে সঙ্গেই। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে ডেকে তার সমাধানের পথও বাতলে দিচ্ছেন। কখনও নিজেই ফোন করছেন কাউন্সিলরকে। অমুকের বাড়ি কেন দখল করা হচ্ছে? ডাক্তারকে ফোন- এত নাম্বার ওয়ার্ডে স্বামীর নির্যাতনে আহত স্ত্রীর সকল সুযোগ সুবিধা আমি দেব। তার চিকিৎসায় যেন অবহেলা না হয়। এত কিছুর পরও আইভী অতৃপ্ত। ক্ষোভও আছে। আগামী বছর জানুয়ারিতে তার পাঁচ বছর মেয়াদ শেষ হবে। নিয়ম অনুযায়ী তিন মাস আগে তাকে পদত্যাগ করতে হবে। এরপর নির্বাচন। সে হিসেবে অক্টোবরে তিনি পদত্যাগ করবেন। এরই মধ্যে প্রতিপক্ষের পক্ষ থেকে ঘোষণা দেয়া হয়েছে আগামী নির্বাচনে সিটি কর্পোরেশনের দলীয় প্রার্থী ঘোষণা করবেন। এ অবস্থায় মানসিক একটা চাপে রয়েছেন মেয়র আইভী। তাতে কি? দমবার পাত্র নন তিনি। এগিয়ে যেতে চান। ব্যাটিং করে ছক্কা মারাই তার নেশা। খেলার মাঠে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার মন্ত্র তার জানা। তাইতো তিনি বুক ফুলিয়ে বলেন, অনেক কিছুই করতে পারিনি। মনের মাধুরি মিশিয়ে আমার নগরকে সাজাতে চাই। যে নগরে খেলতে খেলতে বড় হয়েছি। যে নগরের স্বপ্ন দেখে নারায়ণগঞ্জবাসী। পড়ন্ত বিকালে এসে বলতে চাই, আমি আমার ছোটবেলার নারায়ণগঞ্জকে দেখতে চাই। শীতলক্ষ্যার সেই টলটলে পানি দেখতে চাই। নারায়ণগঞ্জের সকল খাল উন্মুক্ত দেখতে চাই। যেখান দিয়ে চলবে ডিঙ্গি নৌকা। আফসোস সেটা করতে পারিনি এখনও।
দিনটি ছিল মঙ্গলবার। দুপুর ১২টায় সময় দিয়েছিলেন নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী। যথাসময়ে তার দপ্তরে গিয়ে দেখা যায়- অভিযোগের ঢালি নিয়ে হাজির জনতা। পুরো এক ঘণ্টা পর বেলা একটায় মেয়র নির্দেশ দিলেন এখন দরজা বন্ধ। আগের এপয়নমেন্ট করা। আগে এ কাজ শেষ করি। রাজনীতি, দ্বন্দ্ব, সংঘাত, উন্নয়ন, সমস্যা, সমাধান ও তার পরিকল্পনা নিয়ে কথা বলেন খোলামেলা। বলেন, মাথা নিচু করে নিজের আত্মসম্মান বিকিয়ে কারও দাসত্ব করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ও শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ করি। তাইতো ২০০১ সালের ১লা অক্টোবরের পরে যখন এ শহরে কেউ ছিল না। আমি সেদিন এসে আওয়ামী লীগের হাল ধরেছিলাম। তিনি বলেন, আমি আমার সম্মানীর ১০ লাখ টাকা দিয়ে আওয়ামী লীগ অফিস করেছি। তখন আমার সহকর্মীরা, ভাই ব্রাদাররা কম-বেশি সহযোগিতা করে এ বিল্ডিং দাঁড় করিয়েছে। তিনি বলেন, আমার বাবাও কোন দিন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে, শেখ হাসিনার সঙ্গে বেঈমানি করেননি। আলী আহাম্মদ চুনকা সবচাইতে দুঃসময়ে পঁচাত্তরের পর ১৯৮৪ সালে মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত আওয়ামী লীগকে ধরে রেখেছিলেন। তারই রক্তের আমি। আমি আমার জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত নৌকা বলবো, বঙ্গবন্ধু বলবো।
কে কি বললো নারায়ণগঞ্জ শহরে সেটাতে আমার কিছু যায় আসে না। আমি শেখ হাসিনার একজন ক্ষুদ্র কর্মী হিসেবে কাজ করতে চাই। এই শহরের আমি নেতাও হতে চাই না। নেতৃত্বও দিতে চাই না। যারা চাচ্ছে তারাই দিক। আমি সাধারণ মানুষের পাশে থেকে সাধারণ মানুষের সেবা করতে চাই। আশা করি সেই সুযোগ আমার দল আমাকে করে দেবে। মেয়র আইভী বলেন, নারায়ণগঞ্জের সকল ঘটনা প্রধানমন্ত্রী ভালো করেই জানেন। জেনে শুনেই তিনি তার সিদ্ধান্ত নেন।
মেয়র আইভী বলেন, নগরবাসীর সঙ্গে আমার যে কমিটমেন্ট। আমি সেটা পূরণ করার চেষ্টা করে যাচ্ছি। মেয়রের শেষ দিন পর্যন্ত কাজ করে যাবো। আগামী সিটি নির্বাচন প্রসঙ্গে বলেন, প্রার্থী হওয়ার অধিকার তো সকলেরই আছে। সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন হবে। সেখানে দল থেকে ২/৪/৫ জন প্রার্থী হতে চাইবে না, এটা কি করে হয়? নমিনেশন চাওয়ার রাইট তো সবার আছে। কিন্তু বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভানেত্রী যাকে ঘোষণা করবেন বা নমিনেশন দেবেন তিনিই হবেন দলীয় প্রার্থী।
নমিনেশন চাইবেন? নমিনেশন তো অবশ্যই চাইবো। আমি মনে করি দল আমাকে নমিনেশন দেবে। আমি চেষ্টা করেছি সাধারণ মানুষের যে দাবি-দাওয়া তা পূরণ করার। প্রধানমন্ত্রী যে টেকসই উন্নয়নের কথা বলছেন, উনি যে ডিজিটাল বাংলাদেশের রূপকার, তিনি যেভাবে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। আমি তো তার বাইরে নই। আমি তো তাকেই অনুসরণ করে এ নারায়ণগঞ্জের উন্নয়ন করে যাচ্ছি। না হলে গত ৪ বছরে সাড়ে ৪০০ কোটি টাকার উন্নয়ন কাজ করানো সম্ভব হতো না। ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, এডিবি, জাইকা ছাড়াও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতা না থাকলে আমি এত কাজ করতে পারতাম না।
আইভী বলেন, মেধাবী ছাত্র তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী হত্যার ৩ বছর অতিবাহিত হলো। এ হত্যাকাণ্ড নিয়ে ব্যাপক আন্দোলন হয়েছে, হচ্ছে। ইদানীং সারা দেশে শিশুহত্যা বেড়ে গেছে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, যারা শিশুহত্যা করে তারা ঘৃণ্য জীব। তাই আমি মনে করি নারায়ণগঞ্জে মেধাবী ছাত্র ত্বকীকে যারা নৃসংশভাবে হত্যা করেছে তারাও ওই ঘৃণ্য জীবের মধ্যে পড়ে। এখনও এ হত্যাকাণ্ডের তদন্ত প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখছে না, এটা দুঃখজনক। এ হত্যাকাণ্ডের বিচার দ্রুত হওয়া দরকার। অন্য শিশুহত্যার যেভাবে দ্রুত বিচার হয়েছে সেভাবে যেন ত্বকী হত্যারও বিচার হয়। এটাই আমরা রাষ্ট্রের কাছে দাবি করি।
অভিযোগ রয়েছে, সাংবাদিকদের হাত করতে দোকান ফ্ল্যাট দিয়েছেন? আইভীর পাল্টা প্রশ্ন? সাংবাদিকদের হাত করার জন্য কেন দেবো? আমি বলতে চাই, সরকার কোটা নির্ধারণ করে রেখেছে। সাধারণ মানুষের জন্য, মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য, জাতীয় পর্যায়ে যাদের অবদান আছে- সাংবাদিক, সাহিত্যিকসহ নানা পেশার গুণীদের জন্য। তাছাড়া ঢাকায় তো অনেক সাংবাদিক রাজউক থেকে প্লট নিয়েছেন। তাহলে নারায়ণগঞ্জের ক্ষেত্রে এমন প্রশ্ন তোলা হবে কেন? আর এ আইনটা তো নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন করেনি। এটা স্থানীয় সরকার করেছে। দোকান নীতিমালার যে আইন সেটা মন্ত্রণালয় থেকে হয়েছে। সবগুলো সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার জন্য একই আইন। ১৫% রিজার্ভেশন আছে। সে রিজার্ভেশন থেকেই যে টাকা দিয়ে নিতে পেরেছে সে নিয়েছে। তাছাড়া এখানে তো বিনামূল্যে কোন সাংবাদিককে দোকান দেয়া হয়নি। যেখানে মুক্তিযোদ্ধারা পেলেন, সাংস্কৃতিককর্মী ও শিক্ষকরা পেলেন, সেখানে শুধু সাংবাদিকদের কথা কেন উঠছে? তাহলে এটা কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে অপপ্রচার করছে?
মেয়র আইভী বলেন, আমার ২৭টি ওয়ার্ড এখন বলা চলে মুখস্থ। প্রত্যেকটি ওয়ার্ডে অনেকবার করে গিয়েছি। কোন ওয়ার্ডে কোন রাস্তা, কোন মানুষটা, সবই আমার মাথায় চলে এসেছে। সিটি কর্পোরেশন হওয়ার পর সাড়ে ৪০০ কোটি টাকার কাজ হচ্ছে। আরও কাজ হবে। দরপত্র আহ্বান করা হবে। বলা চলে চলতি বছরে ৫০০ কোটি টাকার কাজে গিয়ে ঠেকবে।
তবে উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে ড্রেন ও রাস্তা। কারণ নারায়ণগঞ্জে বেশি সমস্যা জলাবদ্ধতাই ছিল। পৌরসভা যখন ছিল তখন শহরে অনেক ড্রেনেজের কাজ হয়েছে। সিদ্ধিরগঞ্জ ও নদীর ওই পাড় কদমরসুল ছিল একেবারে অনুন্নত এলাকা। এখানে ড্রেন ও রাস্তার ব্যবস্থা খুবই নাজুক ছিল। সিদ্ধিরগঞ্জের একটি বড় অংশ ডিএনডি বাঁধের ভেতর। ডিএনডিতে প্রতিবছরই ভয়াবহ জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে। সিদ্ধিরগঞ্জ ও কদমরসুলে জলাবদ্ধতার জন্য প্রচুর ড্রেনের কাজ করতে হয়েছে। ফলে আমার উন্নয়নের বেশিরভাগ টাকাই মাটির নিচে। যা দেখা যায় না। কিন্তু এর সুবিধাটা মানুষ পেয়ে যাচ্ছে।
উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে যদি বলি সেটা হলো কিছুদিন আগে নগরভবনের টেন্ডার দিয়েছি। ২৫শে ফেব্রুয়ারি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ভিত্তিপ্রস্তুর স্থাপন করেছেন। এটা আমার জীবনে একটা বড় পাওয়া। সত্যিকার অর্থে মনে করি আমি সৌভাগ্যবান। কারণ, আমি নগরভবনের কাজ শুরু করতে পারলাম।
এছাড়া নদীর পূর্বপাড়ে ১০০ ফুটের একটি রাস্তা করেছি। যার দৈর্ঘ প্রায় ৫ কিলোমিটার। রাস্তা ছাড়াও শীতলক্ষ্যার পাড়ে আমরা প্রচুর ঘাটলা করেছি মানুষের জন্য। একটি পার্ক করেছি প্রাইভেট পার্টনারশিপে। যদিও পৌরসভার সময় আমরা চুক্তিবদ্ধ করেছিলাম। সিটি কর্পোরেশনে এসে কাজ শেষ হয়েছে। এ পার্কটি প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন করেছেন।
নগরবাসীর জন্য কী করতে পারেননি?
আইভী বলেন, পারিনি তো অনেক কিছু। মনের মাধুরী মিশিয়ে নগরকে সাজাতে চাই। রাস্তা-ঘাট-ড্রেন এগুলো তো গতানুগতিক কাজ। এই গতানুগতিক কাজ যে কেউ করবে। কিন্তু নারায়ণগঞ্জ শহরকে যেভাবে সাজানো, আমি আমার ছোটবেলার নারায়ণগঞ্জকে চাই, জানিনা সেটা সম্ভব কিনা। ছোটবেলার নারায়ণগঞ্জ বলতে আমি বুঝাচ্ছি, আমি শীতলক্ষ্যার সেই টলটলে পানি দেখতে চাই। নারায়ণগঞ্জের সকল খাল উন্মুক্ত দেখতে চাই। যেখান দিয়ে ডিঙ্গি নৌকা চলবে। নারায়ণগঞ্জ শহর তার আগের অবস্থায় ফিরে আসবে। সেটা তো করতে পারিনি এখনও। তাহলে আমি কাজটা করলাম কই? আমি যেই নগরের স্বপ্ন দেখি তা হলো নারায়ণগঞ্জ শহর থেকে ধলেশ্বরী পর্যন্ত আমাদের সকল খাল উন্মুক্ত থাকতে হবে। এবং সেটা দিয়ে নৌকা আসতে হবে। ইতিমধ্যে আমরা কাজে হাত দিয়েছি। আমরা শিগগিরই টেন্ডার দিতে যাচ্ছি। এটা যখন শুরু হবে তখন শহরের উপর দিয়ে নদী প্রবাহিত হবে। নৌকা চলবে। তখন বলতে পারবো আমি আমার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে পারলাম।
নগরবাসীর জন্য আপনার বক্তব্য কি?
২০১১ সালের ৩০শে অক্টোবর জনগণ আমকে যে রায় দিয়েছিল আমি তাদের সঙ্গে বেঈমানি করিনি। আমার জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত করবো না। মেয়র আইভী বলেন, প্রতিদিনই নগরবভনে লোকজন আসে নানা সমস্যা নিয়ে। শত ব্যস্ততার মাঝেও চেষ্টা করি এখানে বসেই সমাধান করে দিতে। এটা করতে করতে আমি অভ্যস্থ হয়ে গেছি। তাছাড়া সমস্যা জিইয়ে রাখার পক্ষে আমি নই। ১০-১৫ মিনিট সময় দিয়ে যদি সমাধান করে দিতে পারি তাহলে শুধু ভুক্তভোগীদের কষ্ট দিবো কেন? কখনও আবার সংশ্লিষ্ট এলাকার কাউন্সিলরকে দায়িত্ব দিয়ে দিই।
সাধারণ মানুষের কাছাকাছি যেতে খুব পছন্দ করি। ওয়ার্ডগুলোতে যখন যাই তখন সাধারণমানুষগুলো কাছে এসে সমস্যার কথা বলে, তখন ওইখানে দাঁড়িয়ে যখন সমাধা করি তখন সেটাই সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে। মোট কথা সারা দিন কাজের মধ্যে থাকতেই ভালো লাগে। মানুষের সমস্যা সমাধান করে দিতে পারলে একটা আত্মতৃপ্তি আসে। তখন যত অপবাদই দেয়া হোক না কেন মুহূর্তের মধ্যে তা ভুলে যাই। আমি শুধু নগরবাসীকে বলতে চাই তাদের পাশে থেকে তাদের সেবা করতে চাই। সেই সুযোগটা যাতে তারা আমাকে দেয়। সকল ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে আমি নারায়ণগঞ্জবাসীর পাশেই থাকবো ইনশাল্লাহ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *