স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, কাশিমপুর কারা ফটক থেকে; একাত্তর সনের মানবতা বিরোধী মামলায় মৃত্যুদন্ড প্রাপ্ত জামায়াত নেতা মীর কাসেম আলীর ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে।
ঢাকা কেন্দ্রিয় করাগার কাশিমপুর পার্ট-২ এর একটু আগে এই ফাঁসি কার্যকর করা হয়। এখন তার লাশ নিয়ে যাওয়া হবে কাসেম আলীর গ্রামের বাড়ি মানিকগঞ্জ জেলার হরিরামপুর উপজেলার চালা গ্রামে।
বিস্তারিত–
একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মীর কাসেম আলীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। শনিবার দিবাগত রাত ১০ টা ৩৫ মিনিটে জামায়াতের শীর্ষস্থানীয় এই নেতার মৃত্যুদণ্ড গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারে কার্যকর করা হয় বলে জানিয়েছেন আইজিপি একেএম শহীদুল হক।
এর মধ্য দিয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের শাস্তি দিয়ে কলঙ্কমোচনের পথে এগিয়ে গেল দেশ। একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে এটি ফাঁসি কার্যকরের ষষ্ঠ ঘটনা।
এর আগে মানবতাবিরোধী অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হওয়া একাত্তরের ভয়ংকর খুনে বাহিনী আলবদর নেতা মতিউর রহমান নিজামী, জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ, দুই সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ও আবদুল কাদের মোল্লা এবং বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীর ফাঁসির রায় কার্যকর হয়েছে।
গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার-২-এর ৪০ নম্বর কনডেমড সেলে ছিলেন মীর কাসেম। মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে এই প্রথম কাশিমপুর কারাগারে প্রথম কোনো মানবতাবিরোধী অপরাধে দোষী ব্যক্তির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হলো।
মীর কাসেম আলীর ফাঁসি কার্যকরের নির্বাহী আদেশ কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানোর পরই ফাঁসি কার্যকরের সব প্রস্তুতি নেয় কারা কর্তৃপক্ষ। সকাল থেকে কাশিমপুর কারাগারের চারপাশে বাড়তি নিরাপত্তাব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। পোশাকে ও সাদাপোশাকে কাজ করছেন গোয়েন্দারা। নিরাপত্তার স্বার্থে ঢাকা ও গাজীপুরে ১০ প্লাটুন বিজিবি সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে।
এর আগে সন্ধ্যায় মীর কাসেমের সঙ্গে কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে শেষ দেখা করেন তাঁর পরিবারের সদস্যরা। সাক্ষাৎ শেষে বেরিয়ে তাঁর স্ত্রী খন্দকার আয়েশা খাতুন বলেন, ‘তিনি (মীর কাসেম) আমাকে বলেছেন, তাঁকে ফাঁসির কথা জানানো হয়েছে। মানিকগঞ্জে তাঁকে দাফন করা হবে।’
মীর কাসেম শেষ ইচ্ছার কথা জানিয়েছেন কি না, জানতে চাইলে আয়েশা খাতুন বলেন, শেষ মুহূর্তেও ছেলের সঙ্গে দেখা না হওয়ায় আক্ষেপ করেছেন তিনি।
মীর কাসেম আলীর ফাঁসির রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন গত মঙ্গলবার খারিজ করে দেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত। সকালে এই রায় ঘোষণার পর বিকেলেই পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। এর মধ্য দিয়ে আইনি লড়াইয়ের শেষ ধাপের ইতি ঘটে। রিভিউ খারিজের মধ্য দিয়ে জামায়াতে ইসলামীর এই কেন্দ্রীয় নেতার দণ্ড কার্যকরের প্রক্রিয়া শুরু হয়। এরপর তিনি রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা না চাওয়ায় তাঁর ফাঁসি কার্যকর হয়।
যেভাবে উত্থান
মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী দল জামায়াতের শীর্ষস্থানীয় নেতা মীর কাসেম একাত্তরে ছিলেন দলটির ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘের চট্টগ্রাম শহর শাখার সভাপতি। ট্রাইব্যুনালের রায় অনুসারে, একই সঙ্গে তিনি একাত্তরের কুখ্যাত গুপ্তঘাতক আলবদর বাহিনীর চট্টগ্রাম অঞ্চলের প্রধান ছিলেন। তাঁর নেতৃত্ব ও দিকনির্দেশনায় মুক্তিযুদ্ধকালে চট্টগ্রাম শহরের আন্দরকিল্লা এলাকার ডালিম হোটেলে স্থাপিত হয় আলবদর বাহিনীর ক্যাম্প ও নির্যাতনকেন্দ্র। একাত্তরে চট্টগ্রামে এই ডালিম হোটেলকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হতো সব ধরনের মানবতাবিরোধী অপরাধ, যার তত্ত্বাবধানে ছিলেন আলবদর নেতা মীর কাসেম আলী। মুক্তিযুদ্ধের সময় ডালিম হোটেল মানুষের কাছে পরিচিতি পায় হত্যাপুরী হিসেবে, আর নৃশংসতার জন্য মীর কাসেমের পরিচয় হয় ‘বাঙালি খান’।
মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭৭ সালে ইসলামী ছাত্র সংঘ নাম বদল করে ছাত্রশিবির নামে রাজনীতি শুরু করে। মীর কাসেম ছিলেন ইসলামী ছাত্রশিবিরের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। ওই সময় থেকে তিনি জামায়াতের রাজনীতিকে শক্তিশালী করতে দলটির অর্থনৈতিক ভিত্তি শক্ত করার জন্য উদ্যোগ নিতে শুরু করেন। ১৯৮০ সালে তিনি রাবেতা আল-আলম আল-ইসলামী নামের একটি বিদেশি বেসরকারি সংস্থার এ-দেশীয় পরিচালক হন। এ ছাড়া তিনি দিগন্ত মিডিয়া করপোরেশনের চেয়ারম্যান, ইবনে সিনা ট্রাস্টের অন্যতম সদস্য। ধীরে ধীরে তিনি জামায়াতের অর্থের অন্যতম জোগানদাতায় পরিণত হন।
চার বছরের পরিক্রমা
জামায়াতের অর্থের জোগানদাতা হিসেবে পরিচিত মীর কাসেমকে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ২০১২ সালের ১৭ জুন গ্রেপ্তার করা হয়। ২০১৩ সালের ৫ সেপ্টেম্বর তাঁর বিরুদ্ধে ১৪টি অভিযোগ গঠন করে বিচারকাজ শুরু করেন ট্রাইব্যুনাল। ২০১৪ সালের ২ নভেম্বর ট্রাইব্যুনালের রায়ে দুটি অভিযোগে তাঁকে ফাঁসির আদেশ ও আটটি অভিযোগে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
২০১৪ সালের ৩০ নভেম্বর আপিল করেন মীর কাসেম। চলতি বছরের ৮ মার্চ আপিলের রায়ে ১৯৭১ সালে চট্টগ্রামের কিশোর মুক্তিযোদ্ধা জসিমকে হত্যার (১১ নম্বর অভিযোগ) দায়ে মীর কাসেমের ফাঁসির আদেশ বহাল রাখেন আপিল বিভাগ। অন্য ছয়টি অভিযোগে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড বহাল থাকে। আপিলের পূর্ণাঙ্গ রায় ৬ জুন প্রকাশিত হয়। রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে ১৯ জুন আবেদন করেন মীর কাসেম। এই রিভিউ আবেদনের ওপর ২৪ আগস্ট শুনানি শুরু হয়।
যে অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড
আপিল বিভাগের রায়ে ১১ নম্বর অভিযোগে মীর কাসেম আলীর মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকে। এই অভিযোগের বর্ণনা অনুসারে, ১৯৭১ সালে ঈদুল ফিতরের পরের যেকোনো একদিন মীর কাসেমের পরিকল্পনা ও নেতৃত্বে আলবদর বাহিনীর সদস্যরা চট্টগ্রাম শহরের কোনো এক অজ্ঞাত স্থান থেকে মুক্তিযোদ্ধা জসিমকে অপহরণ করে আন্দরকিল্লার ডালিম হোটেলে নিয়ে যায়। ২৮ নভেম্বর পর্যন্ত তাঁকে সেখানে আটকে রেখে নির্যাতন করা হয়। নির্যাতনের ফলে জসিমের মৃত্যু হলেও আরও পাঁচজন অজ্ঞাতনামা ব্যক্তির লাশসহ তাঁর মৃতদেহ কর্ণফুলী নদীতে ফেলে দেওয়া হয়।
রিভিউ খারিজের যত দিন পর ফাঁসি কার্যকর
আবদুল কাদের মোল্লা: ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর আবেদন খারিজ হয়, ওই দিন রাতে ফাঁসি কার্যকর হয়।
মুহাম্মদ কামারুজ্জামান: ২০১৫ সালের ৬ এপ্রিল আবেদন খারিজ, ১১ এপ্রিল রাত সাড়ে ১০টায় ফাঁসি কার্যকর হয়।
সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী: ২০১৫ সালের ১৮ নভেম্বর আবেদন খারিজ হয়, ২১ নভেম্বর রাত ১২টা ৫৫ মিনিটে ফাঁসি কার্যকর হয়।
আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ: ২০১৫ সালের ১৮ নভেম্বর আবেদন খারিজ হয়, ২১ নভেম্বর রাত ১২টা ৫৫ মিনিটে ফাঁসি কার্যকর।
মতিউর রহমান নিজামী: ২০১৬ সালের ৫ মে আবেদন খারিজ হয়, ১০ মে রাত ১২টা ১০ মিনিটে ফাঁসি কার্যকর হয়।