ঢাকা: দুই মন্ত্রীর বিরুদ্ধে শপথ ভঙ্গের বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের দেওয়া রায়ে কিছুটা বিব্রত সরকার ও আওয়ামী লীগ। তবে এর জন্য তাঁদের এখনই মন্ত্রিসভা থেকে সরানোর সম্ভাবনা কম। আর দুই মন্ত্রীর নিজে থেকে সরে যাওয়ারও কোনো আভাস নেই।
সরকারের নীতিনির্ধারক ও আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে। তবে মন্ত্রিসভার একাধিক সদস্য ও আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতাদের অনেকেই বিষয়টি এড়িয়ে চলছেন। অতীতে এমন ঘটনা ঘটেনি বলে এ সম্পর্কে কী বলা উচিত, এটা নিয়েও দ্বিধাদ্বন্দ্বে আছেন তাঁরা। তাঁরা মনে করেন, অভিযুক্ত দুই মন্ত্রীর মনোভাব কিংবা অন্যের ব্যক্তিগত মতের চেয়ে বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কীভাবে দেখছেন, সেটাই গুরুত্বপূর্ণ।
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্লাহ বলেন, দুজনের মন্ত্রিত্ব থাকা না-থাকার বিষয়টি এখন নৈতিক। এতে দল হিসেবে আওয়ামী লীগের কিছু বলার নেই। তবে মন্ত্রিসভার প্রধান হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যদি দলীয় ফোরামে বিষয়টি তোলেন, তাহলে তাঁরা মতামত দেবেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন মন্ত্রী প্রথম আলোকে বলেন, আপিল বিভাগের রায়ের ‘স্পিরিট’, নৈতিকতা এবং এ বিষয়ে মানুষের ভাবনা—সব মিলিয়ে পরিস্থিতি সরকারের জন্য সুখকর নয়। আবার এগুলো আমলে নিয়ে মন্ত্রীদের বাদ দেওয়াও কঠিন। কারণ আপিল বিভাগ তো বাদ দেওয়ার কথা বলেননি এবং সংবিধানেও এ ব্যাপারে নির্দেশনা নেই। তা ছাড়া বাংলাদেশের মতো দেশের মন্ত্রীদের যে অবস্থা, তাতে কদিন পর পরই বাদ দেওয়ার প্রশ্ন চলে আসবে। সব মিলিয়ে মনে হচ্ছে, রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের মন্ত্রিত্ব এখনই যাচ্ছে না। তবে মন্ত্রিসভায় রদবদল হলে পরিবর্তন আসতে পারে।
গত বৃহস্পতিবার আদালত অবমাননার দায়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক ও খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলামের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। রায়ে দেখা যায়, আপিল বিভাগের আটজন বিচারপতি দুই মন্ত্রী আদালত অবমাননা করেছেন বলে সিদ্ধান্ত টানেন। পাঁচজন বিচারপতি বলেছেন, ওই দুই মন্ত্রীর সংবিধান রক্ষার শপথ ভঙ্গ হয়েছে। অন্য তিনজন বিচারপতি শপথ ভঙ্গের বিষয়টি বিচার্য ছিল না বলে উল্লেখ করেছেন। এই রায়ের ফলে এই দুজন মন্ত্রী থাকতে পারেন কি না, সে প্রশ্ন আবারও সামনে চলে এসেছে।
এর আগে দুই মন্ত্রীকে দোষী সাব্যস্ত করে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের আট সদস্যের বেঞ্চ গত ২৭ মার্চ রায় দেন। পাঁচ মাস পর গতকাল সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে ৫৪ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করা হয়। এ বিষয়ে জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি রায়টি পড়ছি। এ বিষয়ে পরে প্রতিক্রিয়া জানাব।’ তবে দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানিয়েছে, সরকারের পক্ষ থেকে আজ শনিবার আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানানো হতে পারে।
দুই মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ সূত্র জানায়, মার্চে রায়ের পর দুই মন্ত্রী তা মেনে নিয়ে জরিমানা পরিশোধ করেন। কিন্তু পূর্ণাঙ্গ রায়ে শপথ ভঙ্গের বিষয়টি থাকতে পারে, তা আঁচ করতে পেরে তাঁরা কিছুটা উদ্বিগ্ন ছিলেন। ব্যক্তিগতভাবে এই পরিস্থিতি এড়ানোর চেষ্টাও করেছিলেন তাঁরা। তবে রায়ের পর বিতর্ক উঠলেও তাঁরা নিজে থেকে পদত্যাগ করবেন না। বিষয়টি দ্রুত চাপা পড়ে যাক, এমনটাই চাইছেন দুই মন্ত্রী ও তাঁদের ঘনিষ্ঠজনেরা।
জানতে চাইলে খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম গতকাল বলেন, ‘আপিল বিভাগের পাঁচজন বিচারপতি শপথ ভঙ্গের বিষয়টি তাঁদের রায়ের পর্যবেক্ষণে উল্লেখ করেছেন। অপর তিনজন বিচারপতি সেই বিষয়টি তাঁদের পর্যবেক্ষণে খণ্ডন করেছেন। অতএব, এ বিষয়ে আমার আর কোনো বক্তব্য নেই। তবে আমি অত্যন্ত আনন্দিত ও তৃপ্ত যে ফাঁসির দড়ি যুদ্ধাপরাধী ঘাতক মীর কাসেম আলীর অতি কাছাকাছি।’
আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল দুজন নেতা মনে করেন, রাজনৈতিক বিবেচনায় খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক এ যাত্রায় বেঁচে যেতে পারেন। কারণ ব্যক্তিগত স্খলন, অর্থাৎ দুর্নীতি-অনিয়মের কারণে তাঁরা দোষী সাব্যস্ত হননি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়টি দল ও দেশের মানুষের কাছে আবেগের বিষয়। বিচার বন্ধে সরকারের ওপর দেশি-বিদেশি চাপও রয়েছে। ফলে আওয়ামী লীগ বা সমমনাদের রাজনৈতিক অবস্থান বা চাপ থাকা দোষের নয়। তবে প্রধান বিচারপতি ও অ্যাটর্নি জেনারেলকে জড়িয়ে বক্তব্য দেওয়ার ক্ষেত্রে দুই মন্ত্রী যে বিচক্ষণতার পরিচয় দিতে পারেননি, এটা তাঁরা মানছেন।