‘আসুন, আমরা সাহসের সঙ্গে সীমানা টপকে যাই; নিজেদের জীবনে তাঁরা যা দেখিয়ে গেছেন। আসুন, যাদের আমরা প্রিয়জন মনে করি, তাদের সবাইকে বুকে টেনে নিই। একসঙ্গে যতটা সময় আছি তার সদ্ব্যবহার করি। ফারাজ ও অবিন্তার রেখে যাওয়া আলো সবার মাঝে ছড়িয়ে দিই।’
গত ১ জুলাই ঢাকার গুলশানে ভয়াবহ জঙ্গি হামলায় নিহত বাংলাদেশের তরুণ ফারাজ আইয়াজ হোসেন (২০) এবং বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক অবিন্তা কবীর (১৯) স্মরণে যুক্তরাষ্ট্রের ইমোরি বিশ্ববিদ্যালয়ের অক্সফোর্ড কলেজে আয়োজিত স্মরণ অনুষ্ঠানে এ আহ্বান জানান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট ক্লেয়ার স্টার্ক। ইমোরি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকাশনায় এ খবর প্রকাশিত হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়ার ইমোরি বিশ্ববিদ্যালয়ের অক্সফোর্ড কলেজেই পড়েছেন ফারাজ ও অবিন্তা। অক্সফোর্ড কলেজের বর্তমান ও সাবেক শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা গত ২৮ আগস্ট একত্র হয়েছিলেন এ কলেজের সেনি মিলনায়তনে। এদিন উপস্থিত শিক্ষার্থীদের অনেকে ফারাজ ও অবিন্তার সঙ্গে ক্লাস করেছেন, কেউবা ছিলেন তাঁদের খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু। অনুষ্ঠানে অনেকে সপরিবার যোগ দেন। হারানো দুই বন্ধুকে স্মরণ করে উপস্থিত অনেকে বলেন, দুজনের হাসি মুখই তাঁদের কাছে ছিল বড্ড চেনা।
ফারাজ ছিলেন বিশাল হৃদয়, অসামান্য ধৈর্য আর গভীর অন্তঃশক্তির অধিকারী, যা তাঁর লাজুক হাসি ও হালকা গড়ন থেকে বোঝা যেত না। আর অবিন্তা ছিলেন ঝলমলে চোখ আর উজ্জ্বল হাসির এক মেয়ে।
অনুষ্ঠানে ফারাজ ও অবিন্তাকে নিয়ে অক্সফোর্ড কলেজ এবং ইমোরি বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরোনো ও নতুন শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণা ছাড়াও ছিল প্রার্থনা অনুষ্ঠান। ছিল মৌন মিছিল। অনুষ্ঠানস্থল সেনি হলে বাজানো হয় দুজনের সম্মিলিত বয়স অনুযায়ী ৩৯ বার ঘণ্টাধ্বনিও।
শুরুতেই উপস্থিত ব্যক্তিদের অভ্যর্থনা জানান অক্সফোর্ড কলেজের ডিন ডগলাস হিকস। একে একে সবাইকে স্মৃতিচারণার আহ্বান জানান তিনি। আহ্বানে সাড়া দিয়ে তাঁরাও শ্রদ্ধা আর গভীর ভালোবাসায় স্মরণ করেন প্রাণবন্ত, উজ্জ্বল, দরদি ও কর্মচঞ্চল এ দুই তরুণকে। ফারাজ আর অবিন্তা দুজনই এই কলেজে স্টুডেন্ট অ্যাকটিভিটিজ কমিটির (এসএসি) নেতৃত্ব দিয়েছেন।
ডগলাস হিকস বলেন, ‘এই পৃথিবী থেকে, আমাদের মাঝ থেকে আর অপরিসীম সম্ভাবনাময় জীবন থেকে যেভাবে কেড়ে নেওয়া হয়েছে ফারাজ আর অবিন্তাকে, তাতে যে ক্ষতি, বিভ্রান্তি আর ক্ষোভের সঞ্চার হয়, তা বর্ণনার কোনো ভাষা নেই।’
হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় হামলার সময় জঙ্গিরা ফারাজকে ছেড়ে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু জঙ্গিদের হাতে বন্ধুদের জিম্মি রেখে তিনি চলে যেতে চাননি। অবশেষে বন্ধুদের সঙ্গে তাঁকেও হত্যা করে জঙ্গিরা। স্মরণ অনুষ্ঠানে ফারাজের এমন সাহস ও ত্যাগের বারবার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন অংশগ্রহণকারী শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।
ফারাজের সহপাঠী ও রুমমেট জানির মালানি বলছিলেন, যেটা সঠিক সেটা করার যে অটল বিশ্বাসে বিশ্বাসী ছিলেন ফারাজ, ওই আত্মত্যাগ তারই প্রতিফলন। ফারাজের মা ও ভাইয়ের চিঠি পড়ে শোনান মালানি। এতে বলা হয়, ‘শৈশব থেকে জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত ফারাজ জীবনের প্রতিটি দিন চারিত্রিক এই শক্তিকে বাস্তবে রূপ দিয়ে গেছে।’ চিঠি পড়ার পর অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়েন জানির।
উজায়ের মালানি ফারাজের নানা-নানির লিখিত বক্তব্য পড়ে শোনান। উজায়ের ও জানির মালানি দুজনেই ফারাজের বন্ধু।
ভ্যালেরি মলিনো ছিলেন গয়জুয়েতা বিজনেস স্কুলে ফারাজের একজন উপদেষ্টা। তিনি বলেন, ‘প্রতিটি কোচিং সেশন শেষে আমি শিক্ষার্থীদের কাছে স্নাতক ও কাঙ্ক্ষিত চাকরির বাইরে তাদের স্বপ্ন সম্পর্কে জানতে চাইতাম। প্রায় সবার জন্য এটা ছিল কঠিন প্রশ্ন। কিন্তু ফারাজ ছিল আলাদা। সে বলত চারটি আকাঙ্ক্ষার কথা—বন্ধুদের যতটা সম্ভব সময় দেওয়া, ভ্রমণ, কলেজ থেকে বের হওয়ার পর অন্তর্বর্তী সময়ে নিজেকে তৈরি করা এবং বিদেশে পড়াশোনা।’
ভ্যালেরি বলেন, ‘ফারাজ তার লক্ষ্য আগেই বুঝেছিল। গ্রীষ্মে ছুটি কাটাতে বাংলাদেশে গিয়েছিল। কলেজে পড়া শেষে সবার সঙ্গে সম্পর্ক রেখে সুন্দর সামাজিক জীবনের প্রস্তুতিও নিচ্ছিল। সংক্ষিপ্ত, উজ্জ্বল আর সাহসী জীবনের শেষ ক্ষণটি পর্যন্ত সে বন্ধুদের সর্বোচ্চ সময় দিয়ে গেছে।’
আনুষ্ঠানিকভাবে সবার স্মৃতিচারণা শেষে অক্সফোর্ড কলেজের যাজক লিন পেস দর্শক-শ্রোতাদের তাঁর সঙ্গে সেনি হলে এক শোকযাত্রায় অংশ নেওয়ার আহ্বান জানান। এতে যোগ দেওয়ার পর তাঁরা হলের সিঁড়িতে জড়ো হন। ফারাজ ও অবিন্তার মৃত্যুর পর তাৎক্ষণিকভাবে সেখানেই তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করা হয়েছিল।
এরপর বক্তব্য দেন অক্সফোর্ড স্টুডেন্ট অ্যাকটিভিটিজ কমিটির প্রেসিডেন্ট অ্যারন স্টডার্ড। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট ক্লেয়ার স্টার্কের সমাপনী বক্তব্য দিয়ে শেষ হয় স্মরণানুষ্ঠান। এ সময় তিনি বলেন, ‘ফারাজ ও অবিন্তার স্মৃতি চিরজাগরূক হয়ে সামনে এগিয়ে চলার পথ দেখাক এবং আমাদের পরিচালিত করুক প্রত্যাশিত শান্তির পথে।’