ঢাউস আকারের জাতীয় নির্বাহী কমিটি করার ক্ষেত্রে নিজেদের গঠনতন্ত্র পুরোপুরি অনুসরণ করেনি বিএনপি। গত কাউন্সিলে দলটি যেসব নতুন পদের অনুমোদন নিয়েছিল, তার বাইরে গিয়ে অতিরিক্ত ৫৩ জনকে জায়গা দেওয়া হয়েছে।
বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটি ছিল ৩৫১ সদস্যের। গত কাউন্সিলে নতুন সৃষ্ঠ ৫৭টি পদ মিলিয়ে কমিটি হওয়ার কথা ৪০৮ সদস্যের। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী দলের চেয়ারপারসন ১০ শতাংশ সদস্য বাড়াতে পারেন। সেটিও যোগ করে কমিটির আকার হয় কমবেশি ৪৪৯ সদস্যের।
কিন্তু বিএনপি যে জাতীয় নির্বাহী কমিটি ঘোষণা করেছে, তাতে মোট সদস্য ৫০২ জন। অর্থাৎ এখন পর্যন্ত অনুমোদিত গঠনতন্ত্রের বাইরে গিয়ে অন্তত ৫৩ জনকে নির্বাহী কমিটিতে জায়গা দেওয়া হয়েছে।
অবশ্য বিএনপির নেতারা বলছেন, দলের চেয়ারপারসন চাইলে পরবর্তী কাউন্সিলে অনুমোদন সাপেক্ষে যেকোনো সময় কমিটির আকার বাড়াতে কমাতে পারেন। দলের গঠনতন্ত্রে চেয়ারপারসনকে সেই ক্ষমতা দেওয়া আছে।
গত ১৯ মার্চ রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে বিএনপির ষষ্ট জাতীয় কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। সেদিন দ্বিতীয় অধিবেশনে নির্বাহী কমিটিতে কর্মকর্তা পর্যায়ে ৫৭টি পদ বাড়ানোর প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়। আগে কর্মকর্তা পর্যায়ের (সহসম্পাদক পর্যন্ত) পদ ছিল ১২১টি। সে হিসাবে এখন কর্মকর্তা পদ হওয়ার কথা ১৭৮টি। কিন্তু বিএনপি ঘোষণা করেছে ২০৯টি পদ। অর্থাৎ কাউন্সিলে অনুমোদিত পদের চেয়ে কর্মকর্তা পর্যায়ে ৩১টি পদ বেশি বাড়ানো হয়েছে। সদস্য হওয়ার কথা ২৭১ জন। কিন্তু রাখা হয়েছে ২৯৩ জনকে। অর্থাৎ এখানে অতিরিক্তি ২২ জনকে নেওয়া হয়েছে।
আগে বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি ছিল ৩৫১ সদস্যের। সেখানে কর্মকর্তা পর্যায়ে ১২১টি পদ বাদে সদস্য ছিল ২৩০। (তবে কার্যত বিএনপির গত নির্বাহী কমিটির কর্মকর্তা ও সদস্য সব মিলে ছিল ৩৮৬ জন।) গত কাউন্সিলে সদস্য পদ বাড়ানোর কোনো প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়নি। কিন্তু ঘোষিত কমিটিতে দেখা গেছে নির্বাহী সদস্য হচ্ছেন ২৯৩ জন। অর্থাৎ সদস্য বাড়ানো হয়েছে ৬৩ জন।
কাউন্সিলে চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পদ সংশোধন করে বলা হয়, এটি হবে উপদেষ্টা কাউন্সিল। উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য কত হবে, তা নির্দিষ্ট থাকবে না। এটি চেয়ারপারসনের ওপর নির্ভর করবে।
গত কাউন্সিলে গঠনতন্ত্র সংশোধন কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য তরিকুল ইসলাম। অসুস্থার কারণে কাউন্সিলে তাঁর পক্ষে সংশোধনী প্রস্তাবগুলো উত্থাপন করেছিলেন ওই কমিটির সদস্য ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান। জানতে চাইলে নজরুল ইসলাম খান প্রথম আলোকে বলেন, দলের সর্বশেষ কাউন্সিলে অনেকগুলো পদ বাড়ানো হয়েছিল। তাৎক্ষণিকভাবে তিনি বলতে পারছেন না ঠিক কতটি পদ বাড়ানো হয়েছিল। কাউন্সিলে পদ বাড়িয়ে যে সংশোধনী পাস হয়েছে, তার বেশি পদে নাম ঘোষণা করার কথা নয়। আর দলের চেয়ারপারসন চাইলে পরবর্তী কাউন্সিলে অনুমোদন সাপেক্ষে পদ বাড়াতে পারেন। তবে সেটির প্রয়োজন মনে হয় হয়নি।
গত ১৯ মার্চ কাউন্সিল হলেও বিএনপির সংশোধিত গঠনতন্ত্র এখন পর্যন্ত প্রকাশ করা হয়নি। গত ৬ আগস্ট কমিটি ঘোষণার পর এক প্রশ্নের জবাবে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছিলেন, বিএনপির গঠনতন্ত্রের সংশোধনীগুলো এখনো চূড়ান্ত করা হয়নি। চূড়ান্ত করে গণমাধ্যমকে জানানো হবে। কমিটির আকার বড় কেন—এমন প্রশ্নের জবাবে মির্জা ফখরুল বলেছিলেন, দেশের যে সামগ্রিক পরিস্থিতি, এটা একটা কারণ। আর বিগত দিনগুলোতে বিএনপি যে বিকাশ লাভ করেছে, বিশেষ করে রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণকারী নেতা-কর্মীর সংখ্যা বেড়ে গেছে, ছাত্রদল-যুবদল থেকে যাঁরা আসছেন, তাঁদের তৈরি করার জন্য নতুন কমিটিতে আনতে হয়েছে। সে জন্য অবয়বটা বড় হয়েছে।
কাউন্সিলে যেসব পদ তৈরি করা হয়েছিল: বিএনপির ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিলে কমিটির আকার বড় করে কিছু সংশোধনী পাশ হয়েছিল। কাউন্সিলে ভাইস চেয়ারম্যান পদ ১৭ থেকে বাড়িয়ে ৩৫টি করা হয়। কাউন্সিলে বলা হয়েছিল, সাংগঠনিক সম্পাদকের পদ হবে প্রতি বিভাগে একজন। প্রত্যেক বিভাগে দুজন করে সহসাংগঠনিক সম্পাদক থাকবেন (আগে ছিল একজন করে)। নতুন কমিটিতে সাংগঠনিক সম্পাদক করা হয়েছে ১০ জনকে। আর সহসাংগঠনিক সম্পাদক করা হয়েছে ২০জনকে। কুমিল্লা, ফরিদপুরকেও সাংগঠনিক বিভাগ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে।
এ ছাড়া কাউন্সিলে ক্ষুদ্রঋণ–বিষয়ক সম্পাদক, আন্তর্জাতিক–বিষয়ক সহসম্পাদক (সাতটি), অর্থনীতি–বিষয়ক সহসম্পাদক, জলবায়ু পরিবর্তন–বিষয়ক সহসম্পাদক, প্রশিক্ষণ–বিষয়ক সহসম্পাদক (দুটি), গণশিক্ষা–বিষয়ক সহসম্পাদক, ধর্ম–বিষয়ক সহসম্পাদক (তিনজন থেকে বাড়িয়ে চারজন,) শিল্প ও বাণিজ্য–বিষয়ক সহসম্পাদক, বন ও পরিবেশ–বিষয়ক সহসম্পাদক, স্বনির্ভর–বিষয়ক সহসম্পাদক, তাঁতি–বিষয়ক সহসম্পাদক, পরিবারকল্যাণ সহসম্পাদক (দুটি), স্বাস্থ্য–বিষয়ক সহসম্পাদক (দুটি), প্রবাসীকল্যাণ–বিষয়ক সহসম্পাদক, বিজ্ঞানপ্রযুক্তি সহসম্পাদক, তথ্যপ্রযুক্তি সহসম্পাদক, মানবাধিকার সহসম্পাদক, ক্ষুদ্রঋণ–বিষয়ক সহসম্পাদক, উপজাতি–বিষয়ক সহসম্পাদক পদ সৃষ্টি করা হয়।
অনুমোদনের বাইরে পদ: বিএনপির ঘোষিত কমিটিতে দেখা যায়, কর্মসংস্থান সম্পাদক, ব্যাংকিং ও রাজস্ব–বিষয়ক সম্পাদক নামে দুটি পদ গঠন করা হয়েছে। এ ছাড়া আইন সম্পাদক করা হয়েছে দুটি। আর আগের শিল্প ও বাণিজ্য–বিষয়ক সম্পাদক পদ ভেঙে আলাদা দুটি পদ, তথ্য ও গবেষণা পদ ভেঙে দুটি আলাদা পদ করা হয়েছে। আর প্রশিক্ষণ–বিষয়ক সম্পাদক পদও দুটি করা হয়েছে। এ ছাড়া সহপ্রচার সম্পাদক করা হয়েছে তিনজন (গঠনতন্ত্রে আছে একজন), সহ–আইনবিষয়ক সম্পাদক করা হয়েছে চারজন (গঠনতন্ত্রে তিনজন), সহশিক্ষা–বিষয়ক সম্পাদক করা হয়েছে দুজন (গঠনতন্ত্রে আছে একজন), সহকর্মসংস্থান–বিষয়ক সম্পাদক, প্রান্তিক জনশক্তি উন্নয়ন–বিষয়ক সহসম্পাদক, ব্যাংকিং ও রাজস্ব–বিষয়ক সহসম্পাদক, মহিলা–বিষয়ক সহসম্পাদক (দুটি কিন্তু গঠনতন্ত্রে আছে একটি), শ্রমিক–বিষয়ক সহসম্পাদক (দুটি করা হয়েছে কিন্তু গঠনতন্ত্রে আছে একটি), শিল্প ও বাণিজ্য–বিষয়ক সহসম্পাদক (করা হয়েছে দুটি অনুমোদন নেওয়া হয়েছিল একটি), প্রশিক্ষণ–বিষয়ক সহসম্পাদক করা হয়েছে চারজনকে (অনুমোদন নেওয়া হয়ছিল দুজন), স্বাস্থ্য–বিষয়ক সহসম্পাদক তিনটি (অনুমোদন ছিল দুটি); নার্সেস ও স্বাস্থ্য সহকারী সহসম্পাদক একটি পদ করা হয়েছে (কিন্তু কাউন্সিলে বলা হয়েছিল স্বাস্থ্য–বিষয়ক সহসম্পাদক হবেন দুজন এর মধ্যে একজন হবেন নার্স); বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি–বিষয়ক সহসম্পাদক করা হয়েছে দুজন, তথ্যপ্রযুক্তি–বিষয়ক সহসম্পাদকও করা হয়েছে দুজন।
আরও পড়ুন