ঢাকা; এমন স্কোর লাইন সচরাচর ফুটবলে খুব বেশি দেখা যায় না। ফুটবলের বিশ্বের তলানিতে থাকা একটি দেশ হিসেবে বাংলাদেশ এমন স্কোর লাইন উপহার দেবে—এমন স্বপ্ন দেখার সাহসও করেন না এ দেশের ফুটবলপ্রেমীরা। কিন্তু কী আশ্চর্য! গতকাল সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে উপস্থিত দর্শকেরা সাক্ষী হলো এমন কিছুরই। কিরগিজস্তানের বিপক্ষে বাংলাদেশের অনূর্ধ্ব-১৬ মেয়েদের দল ১০-০ গোলে জিতে ফুটবলে সাফল্য-সুধা বঞ্চিত ফুটবলপ্রেমীদের পরিচয় করিয়ে দিল অনন্য অনুভূতির সঙ্গে।
ফিফা র্যাঙ্কিং কিংবা ফুটবল অবকাঠামো—বাংলাদেশের চেয়ে বিস্তর ব্যবধানে এগিয়ে থাকা একটি দেশের বিপক্ষে অনূর্ধ্ব-১৬ মেয়েদের দলের এমন দুর্দান্ত সাফল্য কিন্তু ফুটবলের হারিয়ে যাওয়া স্বপ্নটা নতুন করেই দেখাচ্ছে সবাইকে। সম্ভব! ফুটবল বিশ্বকাপেও সম্ভব বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা ওড়ার কার্যত অলীক এক স্বপ্ন দেখা। আমাদের মেয়েরাই কিন্তু এনে দিতে পারে এই সাফল্য।
গত দুই বছর ধরেই আলোচনায় বাংলাদেশের মেয়েদের বয়সভিত্তিক দল। অনূর্ধ্ব-১৪ পর্যায়ে সফল এই দলটিই অনূর্ধ্ব ১৬ হিসেবে যেন আরও অনেক বেশি পরিণত। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের সাধারণ পরিবার থেকে উঠে আসা এই মেয়েদের ফুটবল-শৈলী ও প্রতিভায় মন্ত্রমুগ্ধ হতে বাধ্য যেকোনো ফুটবলপ্রেমী। এই মেয়েদের অফুরন্ত দম আর গোলের অদম্য খিদে যেন বাংলাদেশের ফুটবলপ্রেমীদের নতুন এক অভিজ্ঞতা।
এই দলের কাছে ইরানের মতো এশীয় পরাশক্তিও উড়ে যায়। পাত্তা পায় না সিঙ্গাপুর, ভারত, তাজিকিস্তান, সংযুক্ত আরব আমিরাত কিংবা জর্ডানের মতো দেশগুলোও। কিরগিজস্তান, ভুটান ভেসে যায় গোলের বন্যায়। এই মেয়েদের প্রতিভাদীপ্ত ফুটবল কিন্তু দারুণভাবে মনে করিয়ে দেয় সেই কথাটিই—সুষ্ঠু পরিকল্পনা নিয়ে এগোলে, ফুটবলের স্বপ্নটা দেশব্যাপী ছড়িয়ে দিতে পারলে খেলাধুলায় অনেক বড় স্বপ্নই দেখা সম্ভব বাংলাদেশের জন্য।
ফুটবল প্রতিভার আকাল চলছে বলে অনেক আফসোস আমাদের ফুটবলপ্রেমীদের। কিন্তু এই মেয়েরা উঠে এল কোথায় থেকে! সিলেট, রাজশাহী, সাতক্ষীরা, রাঙামাটি, কুষ্টিয়া, টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ—দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের প্রতিনিধিত্ব আছে এই দলটিতে। কিন্তু এই দলটির প্রসঙ্গে দেশের একটি বিশেষ অঞ্চলের নাম আলাদাভাবেই তুলে ধরতে হয়, সেটি হচ্ছে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তবর্তী ময়মনসিংহের ধোবাউড়া উপজেলার কলসিন্দুর গ্রাম। বাংলাদেশের ফুটবলে মেয়েদের দল গড়তে যে কলসিন্দুর গ্রামের রয়েছে অনন্য অবদান। এশিয়ার বড় বড় ফুটবল শক্তিকে গুঁড়িয়ে দেওয়া বাংলাদেশের অনূর্ধ্ব-১৬ নারী দলটির ৯ জনই উঠে এসেছেন এই কলসিন্দুর গ্রাম থেকে।
প্রায় এক দশক আগে এ দেশে শুরু হয়েছিল মেয়েদের ফুটবলের পথচলা। একেবারে ‘অ-আ-ক-খ’ অবস্থা থেকে পরিবেশ-পরিস্থিতির সঙ্গে লড়াই করে মেয়েরা আজ এই অবস্থানে উঠে এসেছে। একটা সময় বলে লাথি মারাতে পারাটাই যেখানে আমাদের নারী ফুটবল দলের ‘সাফল্য’ হিসেবে ধরা হতো, তারা এখন অবলীলায় গোল-উৎসব করে বিদেশি দলের বিপক্ষে। অদম্য মনোবল নিয়ে লড়াই করে যায় ম্যাচের গোটা সময়টা। স্বপ্ন দেখায় অনেক বড় কিছুর।
তবে একেবারে সিঁড়ির একাধিক ধাপ টপকে এগোতে গেলে পা হড়কে যাওয়ার শঙ্কা থাকেই। এগোতে হবে তাই ধাপে ধাপে। বিশ্বকাপের আগে লক্ষ্যস্থির করতে হবে বয়সভিত্তিক বিশ্বকাপে। চোখ রাখতে হবে এশিয়ান কাপে। আশার কথা, বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন ভালোমতো ছক কষেই এগোচ্ছে বলে মনে হচ্ছে।
বাফুফে মহিলা কমিটির চেয়ারম্যান মাহফুজা আক্তার (কিরণ) কদিন আগে বলেছিলেন, ২০২২ অনূর্ধ্ব-১৭ বা অনূর্ধ্ব-২০ বিশ্বকাপের যেকোনো একটিতে খেলতে চায় বাংলাদেশ। আগামী চার বছর তাই মহিলা দলকে টানা অনুশীলন করানো হবে। এই টুর্নামেন্ট শেষেই কদিনের বিরতি দিয়ে শুরু হবে বিশেষ ক্যাম্প। নভেম্বরে সাফ আছে। অক্টোবর থেকে ক্লাব লিগ আয়োজনেরও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
ফিফার কাছে জমা দেওয়া চার বছর মেয়াদি প্রকল্পটি অনুমোদন পেলে মেয়েদের ফুটবলে তৃণমূল থেকে আরও বেশি প্রতিভা তুলে আনা সম্ভব হবে। সামর্থ্য আর সম্ভাবনায় মেয়েদের ফুটবলে বাংলাদেশের সামনে অনেক ভালো কিছু করার হাতছানি। আর সাফল্য যে পুরো দেশকে প্রভাবিত করে, সেটা তো ক্রিকেটই বড় প্রমাণ। এক আইসিসি ট্রফির সাফল্যই তো দেশের ক্রিকেটকে এক ধাক্কায় অন্য এক জগতে এনে ফেলেছে।
শুধু শক্ত করে ধরে রাখতে হবে হাল, যে পথ হারিয়ে না ফেলে জাহাজটা।