তাৎপর্যপূর্ণ সফরে কেরি আসছেন আজ

Slider জাতীয় বাংলার মুখোমুখি

29349_keri

 

 তাৎপর্যপূর্ণ সফরে আজ ঢাকা আসছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি। বাংলাদেশে তার সফর হবে ৯ ঘণ্টার। সময়ের ব্যাপ্তি বিবেচনায় সফরটি সংক্ষিপ্ত হলেও নানা প্রেক্ষাপটে এটি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছে ঢাকা ও ওয়াশিংটন। এরই মধ্যে সফরটির বিষয়ে কূটনৈতিক সূত্রে যে খবর বেরিয়েছে তা হলো, গণতন্ত্র, উন্নয়ন, নিরাপত্তা এবং মানবাধিকার বিষয়ে দুই দেশের দীর্ঘমেয়াদি দ্বিপক্ষীয় অংশীদারিত্ব আরো শক্তিশালী করার ওপরে জোর দেবেন  জন কেরি। এ নিয়ে বাংলাদেশের শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে আলোচনা করবেন তিনি। বাংলাদেশে সন্ত্রাসী তৎপরতা মোকাবিলার নামে যেন গণতান্ত্রিক মূল্যবোধগুলো কোনোভাবেই বাধাগ্রস্ত না হয়, এ বিষয়েও তাগিদ থাকবে তার। সেগুনবাগিচার কূটনীতিকরা জানিয়েছেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে স্বাগত জানাতে এখন পুরোপুরি প্রস্তুত ঢাকা। সপ্তাহব্যাপী ঢাকা-ওয়াশিংটন দফায় দফায় আলোচনার পর হাইপ্রোফাইল ওই সফরের সূচিও প্রায় চূড়ান্ত। সফরটি সফল করতে সরকারের তরফে নিরাপত্তা জোরদার করাসহ সার্বিক প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে। একইসঙ্গে সন্ত্রাসবাদ দমনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা নেয়ার বিষয়েও স্পষ্ট বার্তা দেবে ঢাকা। জন কেরিকে জানানো হবে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা নিতে চায়, তবে এর শর্তাবলি বাংলাদেশই ঠিক করবে। সকাল ৯টার অল্প পরেই জন কেরি এবং তার সফরসঙ্গীদের বহনকারী যুক্তরাষ্ট্র বিমানবাহিনীর উড়োজাহাজ হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছাবে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীসহ মন্ত্রণালয় ও মার্কিন দূতাবাসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বিমানবন্দরে মন্ত্রীকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানাবেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদনের মধ্য দিয়ে ঢাকা সফরের কর্মসূচি শুরু করবেন জন কেরি। এরপর পর্যায়ক্রমে প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং সংসদে বিরোধী দলের নেতাসহ রাজনৈতিক পর্যায়ে সাক্ষাৎ-বৈঠক ছাড়াও নাগরিক সমাজ, তরুণ নেতৃত্ব এবং গণমাধ্যমের মুখোমুখি হবেন মার্কিন মন্ত্রী। বাংলাদেশের অর্থনীতির সম্ভাবনাময় খাত গার্মেন্ট শিল্পের একটি কারখানা পরিদর্শন এবং শ্রমিকদের সঙ্গেও কথা বলবেন তিনি। ঢাকায় মার্কিন দূতাবাস কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকের আয়োজনও রয়েছে তার। সব মিলে বাংলাদেশে জন কেরির ঝটিকা সফরটি সর্বজনীন রূপ পবে বলে আশা করা হচ্ছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরের বিষয়ে ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা ব্লুম বার্নিকাট গতকাল বলেছেন, তার সফরে জঙ্গিবাদ দমনে বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতায় নতুন প্রস্তাব থাকবে। দুপুরে সিরডাপ মিলনায়তনে পোশাকশিল্পের শ্রমিকদের স্বাস্থ্যবিষয়ক এক অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন। সফরটি     ‘উপযুক্ত’ সময়ে হচ্ছে উল্লেখ করে রাষ্ট্রদূত বলেন, সন্ত্রাসবাদ দমনে বাংলাদেশকে সহযোগিতায় যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে দেয়া অনেক প্রস্তাব আলোচনার টেবিলে রয়েছে। নতুন নতুন প্রস্তাব নিয়ে দু’পক্ষের মধ্যে আলোচনা চলছে। জন কেরির সফরে এ বিষয়ে আরো সহযোগিতার প্রস্তাব থাকবে জানিয়ে রাষ্ট্রদূত বলেন, সন্ত্রাসবাদ ও সহিংস চরমপন্থা দমনে কৌশলগত সহায়তার পাশাপাশি বাংলাদেশকে অর্থ সহযোগিতা দেয়ার বিষয়ে সেখানে আলোচনা হবে। রাষ্ট্রদূতের মতে, সন্ত্রাস দমনে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম ফোকাস। এছাড়া  অংশীদারিত্ব সংলাপ, নিরাপত্তা সংলাপের মাধ্যমে দু’দেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বিভিন্ন বিষয়ে নিয়মিত আলোচনা হচ্ছে। চার বছর ধরে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকারী জন কেরি প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ সফরে আসছেন উল্লেখ করে বার্নিকাট বলেন, এ সফরে দু’দেশের মধ্যকার সকল বিষয় নিয়েই আলোচনা হবে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীসহ সেগুনবাগিচার কর্মকর্তারাও এমনটাই বলছেন। তাদের মতে, দ্বিপক্ষীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট সব বিষয় নিয়েই কম-বেশি আলোচনা হবে। সেখানে নিরাপত্তার বিষয়টি প্রাধান্য পাবে বলে আভাস মিলেছে। ওই সফর নিয়ে ওয়াশিংটনের তরফে প্রকাশিত আনুষ্ঠানিক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, একটি গণতান্ত্রিক, উদারমনা ও সহিষ্ণু বাংলাদেশের অভিন্ন স্বপ্ন পূরণ এবং দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব দেশের মধ্যে ব্যবসা বাণিজ্যের সেতু হিসেবে বাংলাদেশকে দেখতে চায় ওয়াশিংটন। তারা এ-ও আশা করেছে, বঙ্গোপসাগর এলাকায় স্থিতিশীলতা এবং সমৃদ্ধির সমন্বয়কারী হবে বাংলাদেশ। যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বাস করে, স্পন্দনশীল, নিরাপদ গণতন্ত্র হিসেবে বাংলাদেশকে তাদের সত্যিকারের সম্ভাবনা পূরণের জন্য এখানে ক্রমবিকাশমান রাজনৈতিক দলগুলোর অস্তিত্ব এবং মিডিয়ার স্বাধীনতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। ‘ফেক্ট শিট: ইউএস বাংলাদেশ রিলেশনশিপ’ শিরোনামে ওয়াশিংটনে প্রকাশিত ওই বিবৃতিতে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের পারস্পরিক সহযোগিতার ইতিহাস দীর্ঘদিনের। সহিংস জঙ্গিবাদ, জলবায়ু পরিবর্তন, স্বাস্থ্য ও খাদ্য নিরাপত্তার মতো বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় অভিন্ন প্রচেষ্টার মাধ্যমে দুই দেশের সম্পর্ক দিন দিন জোরালো হয়েছে। অনেক চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও বাংলাদেশ দুই দশক ধরে অসামান্য অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে উল্লেখ করে বলা হয়, দারিদ্র্য নিরসন, মাতৃস্বাস্থ্য ও শিশুস্বাস্থ্য উন্নয়নে অসাধারণ অগ্রগতি অর্জন করেছে বাংলাদেশ। মধ্য আয়ের দেশ হওয়ার লক্ষ্যে বাংলাদেশের এই ধারাবাহিক অগ্রগতিতে সহযোগিতা দিতে পেরে গর্বিত অংশীদার যুক্তরাষ্ট্র। ঢাকার কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, জন কেরি এমন এক সময় বাংলাদেশ সফর করছেন যখন দেশটিতে নির্বাচন এবং নেতৃত্ব পরিবর্তনের দামামা বাজছে। একই সঙ্গে বাংলাদেশ সন্ত্রাস ও সহিংস-চরমপন্থিদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক লড়াই অব্যাহত রেখেছে। সেখানে দেশি-বিদেশি সমন্বিত প্রয়াস লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সঙ্গত কারণেই আগামী দিনে দুই দেশের সম্পর্ক কেমন হবে? যুক্তরাষ্ট্রের যে সহযোগিতার প্রস্তাব রয়েছে তার কোন ফর্মে বা কাঠামোতে গ্রহণ করা হবে সেটি মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরে আলোচনা হবে। গুলশানে জঙ্গি হামলার পর মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফোন করে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার পক্ষ থেকে বাংলাদেশকে সব ধরনের সহায়তার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। সমন্বিত ওই প্রস্তাব নিয়ে তার প্রতিনিধি হিসেবে মার্কিন সহকারী মন্ত্রী নিশা দেশাই বিসওয়ালসহ একাধিক প্রতিনিধিদল সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকা সফর করেছেন। মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা ব্লুম বার্নিকাটও এ নিয়ে পররাষ্ট্র দপ্তরের ঊর্ধ্বতনদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করছেন। বাংলাদেশ অবশ্য ‘প্রয়োজনের নিরিখে’ মার্কিন সহায়তা নেয়ার বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছে। কিন্তু সেটি কোন ফর্মে বা কাঠামোতে নেয়া হবে তা এখনও স্পষ্ট নয়। কূটনীতিকরা বলছেন, কেবল যুক্তরাষ্ট্রই নয়, ভারত, জাপান, ইতালিসহ বিভিন্ন দেশের তরফে তদন্তসহ আগামী দিনে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ঠেকাতে ঢাকাকে সার্বিক সহযোগিতার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ এখনও  বিদেশি সহায়তা নেয়ার বিষয়ে খোলাসা করে কিছু বলছে না। এটি দ্বিপক্ষীয় নাকি বহুপক্ষীয় উদ্যোগ হবে সেটি আগামীর আলোচনায় আরো স্পষ্ট হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দুপুরে, বাকি বৈঠক বিকালে: মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরির সফর সফল করতে ঢাকাস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাটসহ দেশটির দূতাবাস এবং ওয়াশিংটন থেকে আসা কর্মকর্তারা বাংলাদেশ সরকার ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে গতকালও বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনা করেছেন। সন্ধ্যা পর্যন্ত ওই আলোচনা চলছিল। সরকারি কর্মকর্তা এবং মার্কিন দূতাবাস সূত্রে পাওয়া তথ্যমতে, শেষ মুহূর্তেও প্রস্তাবিত সূচিতে সংযোজন-বিয়োজন করা হয়েছে। সূত্রমতে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দুপুরে সাক্ষাৎ করবেন জন কেরি। দুপুর ১২টায় এ সাক্ষাৎ হবে। ১টায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর সঙ্গে একান্ত বৈঠক এবং পরে তার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের সঙ্গে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি নেতৃত্বাধীন দেশটির প্রতিনিধি দলের দ্বিপক্ষীয় আলোচনা হবে। রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় সেই আলোচনা হবে জানিয়ে এক কর্মকর্তা বলেন, কেরির সম্মানে মন্ত্রী মাহমুদ আলী একটি ভোজের আয়োজন করছেন। আলোচনা শেষে কাছাকাছি ভেন্যুতে সেই ভোজ হওয়ার কথা রয়েছে। রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবনের আয়োজন শেষে মার্কিনমন্ত্রী ধানমন্ডির ইএমকে সেন্টারে যাবেন। সেখানে নাগরিক সমাজ, তরুণ নেতৃত্বের সঙ্গে মতবিনিময় করবেন তিনি। সেখানে  গণমাধ্যমের সঙ্গেও কথা বলবেন তিনি। ধানমন্ডি থেকে সরাসরি যাবেন মিরপুরে। সেখানে একটি গার্মেন্ট কারখানা পরিদর্শন এবং শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলবেন তিনি। বিকালে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের গুলশানের বাসভবনে যাবেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি। সেখানে সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে তার বৈঠক হতে পারে বলে ধারণা পাওয়া গেছে। রাষ্ট্রদূতের বাসভবন থেকে অ্যাম্বাসি কমপ্লেক্সে যাওয়ার কথা রয়েছে তার। সেখানে দূতবাসের কূটনীতিক, কর্মকর্তা ও স্টাফদের সঙ্গে মতবিনিময় করে বিমানবন্দরের পথে রওনা করবেন তিনি। সন্ধ্যা পৌনে ৭টায় তার দিল্লির উদ্দেশে ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার কথা রয়েছে। উল্লেখ্য, ২০১২ সালে তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও বর্তমানে দেশটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্রেট দলের প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় থাকা হিলারি ক্লিনটন সর্বশেষ ঢাকা সফর করেছিলেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *