প্রায় এক ঘণ্টার বক্তব্যে খালেদা জিয়া রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সম্ভাব্য পরিবেশগত ক্ষতিকর প্রভাব ও অর্থনৈতিক ক্ষতির বিস্তারিত তুলে ধরেন।
খালেদা জিয়া দাবি করেন, সরকার এই প্রকল্প বাস্তবায়নে তড়িঘড়ি করছে। তাদের ‘যুক্তিহীন জেদ’ ও দ্রুততা শুধু সন্দেহজনক নয়, গভীর উদ্বেগের বিষয়। রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিরোধিতা করে খালেদা জিয়া বলেন, ‘সুন্দরবনকে নিশ্চিত ধ্বংসের শিকার করার চক্রান্ত সফল হতে দেওয়া যায় না—দেওয়া উচিত নয়। দেশের অস্তিত্ব ও স্বার্থের বিনিময়ে ব্যক্তি কিংবা গোষ্ঠীর মুনাফা এবং অনৈতিক স্বার্থ উদ্ধারের অপচেষ্টা রোধ করা তাই সময়ের দাবি।’
খালেদা জিয়া বলেন, বিদ্যুৎ উৎপাদনের অনেক বিকল্প আছে, বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের স্থানেরও অনেক বিকল্প আছে। কিন্তু সুন্দরবনের কোনো বিকল্প নেই। পাশাপাশি তিনি সমস্যার সমাধানের জন্য বিকল্প বিদ্যুৎ ও বিকল্প জ্বালানির সন্ধান করারও পরামর্শ দেন।
খালেদা জিয়া বলেন, দেশের উন্নয়ন ও জনজীবনের স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য বিদ্যুৎ প্রয়োজন। কিন্তু সেই বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে গিয়ে যদি দেশ এবং দেশের স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, জনজীবন বিপর্যস্ত হয়, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়, তাহলে সেই সিদ্ধান্ত হয় দেশবিরোধী-গণবিরোধী। বাগেরহাট জেলার রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন ঠিক তেমনি একটি দেশবিরোধী-গণবিরোধী সিদ্ধান্ত।
খালেদা জিয়া বলেন, ভারতে সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ২৫ কিলোমিটারের মধ্যে কয়লা–বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে আইনি বাধা আছে। অথচ সে দেশের একটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান তাদের নিজের দেশে যা করতে পারে না, শুধু ব্যবসায়িক স্বার্থে তা বাংলাদেশে করছে। আর জনগণের প্রতি দায়িত্বহীন এবং দেশের স্বার্থের প্রতি উদাসীন বাংলাদেশ সরকার তার অনুমতি দিয়েছে।
পরিবেশগত ক্ষতি
খালেদা জিয়া বলেন, ‘শূন্য নির্গমন’ নীতি অনুসরণ না করায় রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে প্রতি ঘণ্টায় নির্গত ৫ হাজার ১৫০ ঘনমিটার পানি পশুর নদের জলজ পরিবেশের তাপমাত্রা, পানি নির্গমনের গতি, পানিতে দ্রবীভূত নানান উপাদান বিভিন্ন মাত্রায় পরিবর্তন করবে—যা পুরো সুন্দরবন এলাকার পরিবেশের ওপর ধ্বংসকারী প্রভাব সৃষ্টি করবে। ইআইএ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াটের এই প্রকল্পে বছরে ৪৭ লাখ ২০ হাজার টন কয়লা পোড়ানো হবে। সরকারি প্রতিবেদন অনুযায়ী, সুপার ক্রিটিক্যাল পদ্ধতি ব্যবহার করার পরেও ৭৯ লাখ টন কার্বন ডাই–অক্সাইড নির্গত হবে। যত উঁচু চিমনিই ব্যবহার করা হোক, বাতাসের চেয়ে ভারী এই মারাত্মক ক্ষতিকর গ্যাস সুন্দরবনের ওপরেই ফিরে আসবে। এ ছাড়া প্রতিদিন এই বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ১৪২ টন বিষাক্ত সালফার ডাই–অক্সাইড এবং ৮৫ টন নাইট্রোজেন ডাই–অক্সাইড নির্গত হয়ে সুন্দরবনের বাতাসের ঘনত্ব বাড়িয়ে গোটা সুন্দরবন ও তার আশপাশের অঞ্চলকে ধ্বংস করবে।
খালেদা জিয়া আরও বলেন, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্ষতিকর বর্জ্য হবে দুই ধরনের কয়লা পোড়া ছাই। এখানে প্রতিবছর ৪৭ লাখ ২০ হাজার টন কয়লা পোড়ানোর ফলে ৭ লাখ ৫০ হাজার টন ফ্লাই অ্যাশ ও দুই লাখ টন বটম অ্যাশ বর্জ্য তৈরি হবে। এই ফ্লাই অ্যাশ, বটম অ্যাশ এবং তরল ঘনীভূত ছাই বিপজ্জনক মাত্রায় পরিবেশ দূষণ করে। কারণ, এতে পারদ, সিসা, নিকেল, আর্সেনিক, বেরিলিয়াম, ক্রোমিয়াম, রেডিয়াম ইত্যাদির মতো বিভিন্ন ক্ষতিকর ও তেজস্ক্রিয় ভারী ধাতু মিশে থাকে। ইআইএ প্রতিবেদনে উৎপাদিত ছাই ইএসপি সিস্টেমের মাধ্যমে চিমনির মধ্যেই ধরে রাখার কথা বলা হলেও কিছু উড়ন্ত ছাই বাতাসে মিশবে বলে স্বীকার করা হয়েছে।
খালেদা জিয়া বলেন, হিরণ পয়েন্ট থেকে আকরাম পয়েন্ট পর্যন্ত এবং আকরাম পয়েন্ট থেকে রামপাল পর্যন্ত প্রতিবছর ৪৭ লাখ ২০ হাজার টন কয়লা পরিবহন করার সময় জাহাজ থেকে কয়লার গুঁড়া, ভাঙা বা টুকরা কয়লা, তেল, ময়লা-আবর্জনা, জাহাজের দূষিত পানিসহ বিপুল পরিমাণ বর্জ্য নিঃসৃত হয়ে নদী, খাল, মাটিসহ গোটা সুন্দরবন দূষিত করবে।
অর্থনৈতিক ক্ষতি
খালেদা জিয়া দাবি করেন, এটি বাংলাদেশের জন্য অলাভজনক। এই প্রকল্পের ১৫ শতাংশ অর্থ জোগান দেবে পিডিবি, ১৫ শতাংশ ভারতীয় কোম্পানি এনটিপিসি এবং বাকি ৭০ শতাংশ ব্যাংকঋণ নেওয়া হবে। কোম্পানি বন্ধ হলে কিংবা ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলে পুরো ঋণের টাকা পরিশোধ করতে হবে বাংলাদেশকে। উৎপাদিত বিদ্যুৎ পিডিবি কিনবে। আর যে নিট লাভ হবে, তা ৫০ শতাংশ হারে পিডিবি ও এনটিপিসির মধ্যে ভাগ হবে। কিন্তু ১০০ শতাংশ পরিবেশ ধ্বংস হবে শুধুই বাংলাদেশের। ১৫ শতাংশ বিনিয়োগ করে ভারতীয় প্রতিষ্ঠান ৫০ শতাংশ মুনাফা নেবে এবং ‘ট্যাক্স ফ্রি’ সুবিধার আওতায় মুনাফার পুরো টাকা তাদের দেশে নিয়ে যাবে। অন্যদিকে কয়লার ক্রয়মূল্যকে বিদ্যুতের দাম নির্ধারণের ভিত্তি হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে। ইতিমধ্যেই সরকারি পর্যায়ে এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য টনপ্রতি ১৪৫ ডলার মূল্যে কয়লা আমদানির সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হওয়ায় পিডিবিকে ৮ দশমিক ৮৫ টাকা মূল্যে বিদ্যুৎ কিনতে হবে। অথচ পিডিবির সঙ্গে দেশীয় অরিয়ন গ্রুপের যে চুক্তি হয়েছে, তাতে এই কোম্পানির মাওয়ায় প্রতিষ্ঠিত কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে প্রতি ইউনিট ৪ টাকা মূল্যে এবং খুলনার লবণচরা ও চট্টগ্রামের আনোয়ারায় প্রতিষ্ঠিত বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ৩ টাকা ৮০ পয়সা মূল্যে বিদ্যুৎ কেনা হবে।
ভারতের সঙ্গে তুলনা
খালেদা জিয়া বলেন, ভারতের ন্যাশনাল থার্মাল পাওয়ার করপোরেশন নামের যে প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে যৌথভাবে রামপাল কয়লা-বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপিত হচ্ছে, সেই একই প্রতিষ্ঠান দেশটির মধ্যপ্রদেশের নরসিংহপুর জেলায় ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন কয়লা-বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের প্রস্তাব দিয়েছিল। ভারত সরকার তা বাতিল করে দিয়েছে। নরসিংহপুর প্রকল্পটি ১ হাজার একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠা করার প্রস্তাব ছিল। আর রামপালে এই একই আকারের বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের জন্য দেওয়া হয়েছে ১ হাজার ৮৩৪ একর জমি।
খালেদা জিয়া বলেন, নরসিংহপুরের প্রকল্প বাতিল করা হয়েছে প্রধানত তিনটি কারণে—ক. জনবসতিপূর্ণ এলাকায় তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র গ্রহণযোগ্য হতে পারে না; খ. কৃষিজমির ওপর তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র করা যাবে না এবং গ. নর্মদা নদী থেকে ঘণ্টায় ৩২ কিউসেক পানি নেওয়া যাবে না।
এর সঙ্গে রামপালের তুলনা করলে যা দেখা যায়—ক. নরসিংহপুর জেলার আয়তন ৫১২৫.৫৫ বর্গকিলোমিটার এবং জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১৮৭ জন। অন্যদিকে বাগেরহাটের আয়তন ৩৯৫৯.১১ বর্গকিলোমিটার আর রামপালের আয়তন ৩৩৫.৪৬ বর্গকিলোমিটার এবং জনসংখ্যার ঘনত্ব ৩৮২ জন অর্থাৎ নরসিংহপুরের চেয়ে দ্বিগুণের বেশি। খ. নরসিংহপুরের জমি দোফসলি কিন্তু রামপালের জমি তিন ফসলি। ঘেরগুলোতে মাছ চাষ হয় সারা বছর। গ. নর্মদা নদী থেকে ঘণ্টায় ৩২ কিউসেক পানি নিতে দেওয়া যাবে না বলে মধ্যপ্রদেশে বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনুমতি দেওয়া হয়নি। অথচ নর্মদার চেয়েও ছোট পশুর নদ থেকে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য প্রতি ঘণ্টায় ১৪৪ কিউসেক পানি নেওয়া হবে এবং তা লবণাক্ততামুক্ত করার জন্য আলাদা প্ল্যান্ট বসানো হবে। আর যদি গভীর নলকূপ বসিয়ে মিষ্টি পানি তুলতে হয়, তা হলে ২ কিউসেক ক্ষমতাসম্পন্ন ৭২টি গভীর নলকূপ বসাতে হবে। একটি নলকূপের ১ হাজার ফুটের মধ্যে আরেকটি নলকূপ বসানো যায় না। অর্থাৎ, এক বিস্তৃত এলাকায় ভূগর্ভস্থ পানি শুকিয়ে মারাত্মক বিপর্যয় সৃষ্টি করবে।
সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন, নজরুল ইসলাম খান, জোটের শরিক দলের নেতা সৈয়দ মুহাম্মদ ইব্রাহিম, শফিউল আলম প্রধান, আন্দালিব রহমান, গোলাম মোস্তফা ভূঁইয়া প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।