১০৫ বছর পর আসছে বিদ্যুৎ আইন, বেসরকারি খাতকে অগ্রাধিকার

Slider কৃষি, পরিবেশ ও প্রকৃতি

file (1)

 

বেসরকারি খাতকে উৎসাহ দিতে ও বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে আসছে নতুন বিদ্যুৎ আইন। এই আইনে বিদ্যুৎ উৎপাদন, সঞ্চালন, বিতরণ, ক্রয়-বিক্রয় ও আমদানি-রপ্তানি সবই যাচ্ছে বেসরকারি খাতে। ১০৫ বছর পর এটিই হবে বাংলাদেশের প্রথম বিদ্যুৎ আইন। ১৯১০ সালের ইলেকট্রিসিটি অ্যাক্ট অনুযায়ী এতদিন দেশের বিদ্যুৎ খাত পরিচালিত হয়ে আসছিল। এখন শতাব্দি প্রাচীন এ আইনটি যুগোপযোগী ও হালনাগাদ করা হয়েছে। মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দ্য ইলেকট্রিসিটি অ্যাক্ট বাংলায় ভাষান্তর করা হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় বিদ্যুৎ আইন ২০১৬-এর খসড়া নীতিগত অনুমোদনের জন্য আজ মন্ত্রিসভা বৈঠকে উঠছে। সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সভাকক্ষে বেলা ১২টায় শুরু হওয়া বৈঠকে ১ নং এজেন্ডা হিসেবে বিষয়টি রাখা হয়েছে। অনুমোদন মিললে বিদ্যুৎ খাতের প্রয়োজনীয় সংস্কার কার্যক্রম শুরু হবে। এর আগে নানাবিধ সংস্কারের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম বিদ্যুৎ আইন ২০১৫-এর খসড়া তৈরি করে সরকার। এ আইন অনুযায়ী যে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপন, পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারবে। নিজস্ব স্থাপনায় ব্যবহারের জন্য নিজস্ব ব্যবস্থায় বিতরণ লাইনও স্থাপন করতে পারবে। একই সঙ্গে সরকারি-বেসরকারি এসব স্থাপনা রক্ষায় নতুন আইনে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, প্রাথমিকভাবে বিদ্যুৎ বিভাগের আওতাধীন সংশ্লিষ্ট দপ্তর/সংস্থা/কোম্পানি এবং স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে পরামর্শক্রমে বিদ্যুৎ আইন ২০১৬-এর খসড়া প্রণয়ন করা হয়। এরপর বিভিন্ন পর্যায়ে এ নিয়ে একাধিক বৈঠক করে বিদ্যুৎ বিভাগ। পরবর্তীতে আইনটি মন্ত্রিসভায় উত্থাপনে নীতিগত সম্মতির জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে উপস্থাপন করলে গত ১৯শে জুলাই তিনি এতে সম্মতি দেন। তবে প্রস্তাবিত বিদ্যুৎ আইনের ৩৪ ধারায় ‘বৈদ্যুতিক উপদেষ্টা’ ও ‘প্রধান বিদ্যুৎ পরিদর্শক’ শব্দের বৈদ্যুতিক উপদেষ্টা শব্দটি বাদ দিয়ে ‘প্রধান বিদ্যুৎ পরিদর্শক’ নাম নির্ধারণে অনুশাসন দেন প্রধানমন্ত্রী। সে অনুযায়ী আইনটির খসড়া সংশোধন করা হয়। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, খসড়া বিদ্যুৎ আইন ২০১৬-এ ৮টি অধ্যায় এবং ৭৬টি ধারা রয়েছে। আইনের প্রথম অধ্যায়ে শিরোনাম ও সংজ্ঞা, দ্বিতীয় অধ্যায়ে উৎপাদন, সঞ্চালন, বিতরণ ও ক্রয়-বিক্রয় ইত্যাদির বিধান, তৃতীয় অধ্যায়ে পূর্ত কর্মাদির বিধানাবলী; চতুর্থ অধ্যায়ে বিদ্যুৎ সরবরাহের বিষয়াদি; পঞ্চম অধ্যায়ে সুরক্ষা এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থার বিধান; সপ্তম অধ্যায়ে অপরাধ ও দণ্ডের বিধান রয়েছে। আর অষ্টম অধ্যায়ে রয়েছে বিবিধ বিষয়াদি- যেমন বিরোধ নিষ্পত্তি, জরুরি ও অত্যাবশ্যকীয় সার্ভিস, বিদ্যুৎ লাইসেন্সিং প্রতিষ্ঠানকে শ্রম আইনের আওতাবহির্ভূত রাখা। খসড়া আইনে বলা আছে, নাশকতার উদ্দেশ্যে কেউ বিদ্যুৎ কেন্দ্র, উপকেন্দ্র, বিদ্যুৎ লাইন, খুঁটি ও সঞ্চালন যন্ত্রপাতিতে কোনো বস্তু নিক্ষেপ করলেই ৬ মাসের কারাদণ্ড দেয়া হবে। একই সঙ্গে এ ধরনের অপরাধে কেউ প্ররোচনা ও সহায়তা দিলে তার বিরুদ্ধেও ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে অন্তর্ঘাতমূলক মামলা ও শাস্তি হবে। সরকারি কর্মচারী-বেসরকারি সংস্থা, কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের বেলায়ও একই আইন প্রযোজ্য হবে। শুধু তাই নয়, এই আইনে অপরাধীর বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ না করে বিষয়টি ধামাচাপা দিলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও সংস্থার বিরুদ্ধেও প্ররোচনার অভিযোগে মামলা হবে। নতুন খসড়া বিদ্যুৎ আইনে বিদ্যুৎ উৎপাদন, সঞ্চালন, বিতরণ, ক্রয়-বিক্রয়, আমদানি, রপ্তানিতে বেসরকারি বিনিয়োগকে উৎসাহ দেয়া হবে। এই আইনে বিদ্যমান সরকারি বিদ্যুৎ লাইন ব্যবহার করে বেসরকারি কেন্দ্রগুলো খুচরা গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারবে। বিলের টাকাও সংগ্রহ করতে পারবে। বিদ্যমান বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোসহ ভবিষ্যতে ব্যক্তিখাতে যেসব কেন্দ্র গড়ে উঠবে, সবক’টিকে এ সুযোগ দেবে সরকার। বিদ্যুৎ খাতে বেসরকারি বিনিয়োগে উৎসাহিত করতে সরকার পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের (পিপিপি) মাধ্যমে প্রকল্প গ্রহণ করতে পারবে। এজন্য সরকার প্রয়োজনীয় নীতিমালা প্রণয়ন করবে। খসড়া আইনে রয়েছে, যে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপন, পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারবে। নিজস্ব স্থাপনায় ব্যবহারের জন্য নিজস্ব ব্যবস্থায় বিতরণ লাইনও স্থাপন করতে পারবে। এতে বেসরকারি খাতের কোনো শিল্প-কারখানা আগ্রহী হলে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সঙ্গে দরকষাকষির মাধ্যমে ট্যারিফ ঠিক করে যে কোনো মুহূর্তে বিদ্যুৎ সংযোগ নিতে পারবে। শুধু তাই নয়, সরকার নির্ধারিত দরে উৎপাদিত বিদ্যুৎ সরকারি বিতরণকারী কোম্পানি বা সংস্থার কাছে বিক্রি করা যাবে। বিদ্যমান ও নতুন বাণিজ্যিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোয় উৎপাদিত বিদ্যুৎ বিতরণ ও সঞ্চালনের জন্য সরকারি সঞ্চালন ও বিতরণ লাইন ব্যবহার করা যাবে। এ ক্ষেত্রে বিদ্যুতের দাম নির্ধারণ করবে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন। একই সঙ্গে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ খাতে উন্মুক্ত বাজার ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পাওয়ার মার্কেট ও সিঙ্গেল বায়ার প্রতিষ্ঠার সুযোগ রাখার কথাও রয়েছে খসড়া আইনে। ফলে বিদ্যুতের উন্মুক্ত বাজার থেকে যে কোনো ক্রেতা চাহিদামাফিক বিদ্যুৎ কিনতে পারবেন। বর্তমান ব্যবস্থায় বেসরকারি খাত বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারলেও গ্রাহক পর্যায়ে বিতরণ ও সরবরাহ করার সুযোগ পায় না। সঞ্চালন ও বিতরণ খাত দুটি এককভাবে পরিচালনা করছে দেশের রাষ্ট্র মালিকানাধীন কোম্পানি ও বোর্ড। বেসরকারি কেন্দ্রগুলোতে উৎপাদিত বিদ্যুৎ কিনে নিয়ে তা সঞ্চালন ও বিতরণ করছে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠানগুলো। নতুন আইন হলে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন, সঞ্চালন, বিতরণ ও সরবরাহ কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বেসরকারি খাতে লাইসেন্স দেয়া হবে। সরকারের অনুমতি নিয়ে উৎপাদিত বিদ্যুৎ বিদেশে রপ্তানিও করতে পারবে। একই সঙ্গে বিদেশ থেকে বিদ্যুৎ আমদানি করতে পারবে। এই আমদানি বা রপ্তানির জন্য বাংলাদেশের বিদ্যমান সঞ্চালন লাইন ব্যবহারের সুযোগ দেয়া হবে ওই প্রতিষ্ঠানকে। আইনের খসড়া পর্যালোচনা করে দেখা যায়, এটি আইনে রূপান্তরিত হলে বিদ্যুৎ খাতে বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়বে। জ্বালানি সরবরাহের নিশ্চয়তা দিয়ে সরকারের অনুমোদন নিয়ে বেসরকারি খাত বাণিজ্যিকভাবে বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন, পরিচালন ও রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারবে। বিদ্যমান ও নতুন বাণিজ্যিক কেন্দ্রগুলোতে উৎপাদিত বিদ্যুৎ বিতরণ ও সঞ্চালনের জন্য বিদ্যুৎ সঞ্চালন ও বিতরণ সংস্থাগুলোর লাইন ব্যবহারের অনুমতি দেয়া হবে। এ খাতগুলোতে দেশি ও বিদেশি বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের উৎসাহ দেয়ার জন্য সরকার প্রতিযোগিতামূলক এবং অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করবে। বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় বিদ্যুৎ উৎপাদনে নবায়নযোগ্য এবং অপ্রচলিত জ্বালানি ব্যবহারে সরকারের উৎসাহ দেয়ার কথাও খসড়া আইনে বলা হয়েছে। এজন্য আলাদা একটি নীতিমালা প্রণয়ন করা হবে। ওই নীতিমালা অনুযায়ী, এ ধরনের জ্বালানি ব্যবহারকারীদের জন্য আর্থিক প্রণোদনাসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা থাকবে। এছাড়া, স্মার্ট গ্রিড স্থাপনের মাধ্যমে গ্রিড বিপর্যয়ের সময় সারা দেশ একসঙ্গে অন্ধকারে নিমজ্জিত হওয়ার মতো পরিস্থিতি রোধ করার কথা বলা হয়েছে। সমস্যাগ্রস্ত সঞ্চালন বা বিতরণ লাইন বিচ্ছিন্ন করলেই গ্রিড বিপর্যয় মোকাবিলা করা যাবে। এই আইনে সারা দেশে বিদ্যুৎ ব্যবস্থা সমন্বিত আকারে পরিচালনার জন্য সরকার একটি ইন্ডিপেনডেন্ট সিস্টেম অপারেটর প্রতিষ্ঠা করবে। একই সঙ্গে পুরো দেশে টেকসই, সাশ্রয়ী এবং নিরাপদ বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে উৎপাদন, সঞ্চালন ও বিতরণের দায়িত্বে নিয়োজিত সংস্থা বা কোম্পানিগুলোর জাতীয় গ্রিড সিস্টেমকে স্মার্ট গ্রিড ব্যবস্থায় রূপান্তরের উদ্যোগ নেবে। খসড়া আইন অনুযায়ী কোনো গ্রাহকের বিদ্যুতের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে হলে তাকে ১০ দিন আগে লিখিত নোটিশ দিতে হবে। সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার পর সংশ্লিষ্ট গ্রাহক যদি ক্ষতিপূরণ দেন তাহলে ক্ষতিপূরণ দেয়ার দুদিনের মধ্যে তার বিদ্যুতের লাইন পুনঃসংযোগ করে দিতে হবে। কোনো গ্রাহক নির্দিষ্ট মাসে বা সময়ে বিদ্যুৎ ব্যবহার করতে না চাইলে তা সংশ্লিষ্ট বিতরণ কর্তৃপক্ষকে লিখিতভাবে অবহিত করলে ওই সময় পর্যন্ত তার বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রাখা হবে। গ্রাহককে ওই সময়ের বিদ্যুৎ বিল দিতে হবে না, শুধু সার্ভিস চার্জ দিতে হবে। এছাড়া গ্রাহক চাইলে বিদ্যুতের অগ্রিম বিলও দিতে পারবেন। খসড়া আইনে উল্লেখ রয়েছে, বিদ্যুৎ খাতের সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে সরকার প্রয়োজনে জাতীয় বিদ্যুৎ নীতি প্রণয়ন করতে পারবে। এই নীতি বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদন, সঞ্চালন, বিতরণ ও মানবসম্পদ উন্নয়নসহ স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করবে। একইভাবে তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেবে। বিদ্যুৎ সেবা দানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মদক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে গ্রাহককে সর্বোচ্চ সেবা প্রদান, গুণগত মানের বিদ্যুৎ সরবরাহ এবং দীর্ঘমেয়াদি জ্বালানি নিরাপত্তার উদ্দেশ্যে সরকার বিদ্যুৎ খাতে প্রয়োজনীয় সংস্কার ও পুনর্বণ্টন করতে পারবে। বিদ্যুৎ খাতে স্বচ্ছতা ও গতিশীলতা আনতে সরকার ইচ্ছা করলে উৎপাদন, সঞ্চালন ও বিতরণের জন্য এক বা একাধিক বিদ্যুৎ প্রতিষ্ঠান, বিদ্যুৎ বোর্ড বা হোল্ডিং কোম্পানি গঠন করতে পারবে। খসড়া আইনে অবৈধ বিদ্যুৎ বিতরণ বা ব্যবহারকারীকে অনধিক দুই বছরের কারাদণ্ড বা ৫০ হাজার টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। এছাড়া ১০ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ চুরির জন্য তিন বছর, ১০ কিলোওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ চুরির জন্য ৫ বছরের কারাদণ্ড ও ১ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *