কয়েক সপ্তাহ রিপাবলিকান দলের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের জন্য ছিল বেশ কঠিন। ক্লিভল্যান্ডে রিপাবলিকান দলের সম্মেলন অনুপ্রেরণাদায়ী কিছু ছিল না। এরপর যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত এক মার্কিন সেনার পিতামাতার বিরুদ্ধে অর্থহীন এক লড়াইয়ে নামেন তিনি। এবার তিনি ঘোষণা দিয়েছেন, সিনেট নির্বাচনে রিপাবলিকান দলের সবচেয়ে জ্যেষ্ঠ নেতা জন ম্যাককেইনকে সমর্থন দেয়ার জন্য তিনি প্রস্তুত নন।
এটা সবার জানা যে, রিপাবলিকান দলের অনেকেই তাদের প্রার্থীর পারফরম্যান্স ও আচরণ নিয়ে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। তাই প্রতিদ্বন্দ্বীতা থেকে ট্রাম্প বিদায় নিলে, শেষ মুহূর্তে হলেও খুশি হবেন ওই নেতারা।
কোন্দল তো আছেই। সংবাদমাধ্যমে ক্রমাগত বাজে শিরোনাম হচ্ছেন ট্রাম্প। আর তাতে অনেকে ভেবে নিয়েছেন ৭০ বছর বয়সী বিলিয়নিয়ার এ প্রার্থী এবার বুঝি বাক্স-পেটরা গুছিয়ে বাড়ির পথে রওনা হবেন। যদি সত্যিই প্রতিদ্বন্দ্বীতা থেকে সরে দাঁড়ান ট্রাম্প, তবে আমেরিকার ইতিহাসে এটিই হবে প্রথম কোন প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর সরে দাঁড়ানোর ঘটনা। তবে ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রার্থীদের সরে দাঁড়ানোর নজির আছে। এবিসি নিউজ জানিয়েছে, রিপাবলিকান দলের শীর্ষ নেতারা এমন পরিস্থিতি আঁচ করছেন। ৮ই নভেম্বরের নির্বাচনে আগে সত্যিই যদি ট্রাম্প সরে দাঁড়ান, সেক্ষেত্রে করণীয় কী হবে তা নিয়ে এখনই নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা সারছেন তারা। তবে ট্রাম্পের প্রচার শিবিরের মুখপাত্র হোপ হিকস সম্প্রতি একটি ইমেইল পাঠিয়েছেন সাংবাদিকদের কাছে। সেখানে তিনি লিখেছেন, এসব গুঞ্জনের কোন সত্যতা একেবারেই নেই।
ট্রাম্পের স্থির বিবেচনাবোধ আছে কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলে গত কয়েক দিনে একগাধা নিবন্ধ বেরিয়েছে মার্কিন সংবাদমাধ্যমে। সম্প্রতি হিলারি ক্লিনটনের ইমেইল হ্যাক করতে রাশিয়াকে আহবান জানানোর পর হুলস্থুল বেঁধে যায় রাজনৈতিক মঞ্চে। এরকম কথাবার্তা আমেরিকায় রাষ্ট্রদ্রোহী মন্তব্যের মতো। অবশ্য পরে ট্রাম্প জানিয়েছেন এটা ছিল স্রেফ কৌতুক।
এমএসএনবিসি চ্যানেলের জো স্ক্যারবোরোফ জানিয়েছেন রিপাবলিকান দলের অনেক নেতার ফোন পাচ্ছেন তিনি, যারা কিনা ট্রাম্পের সুস্থতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে! তিনি বলেন, ‘রক্ষনশীল, রিপাবলিকান, সরকারী কর্মকর্তা ও ডানপন্থী ব্লগারদের ফোন পাচ্ছি আমি। তাদের সবাই তার মানসিক সুস্থতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন!’ ওয়াশিংটন পোস্টে ইউজিন রবিনসনের কলামের শিরোনাম ছিল ‘ডোনাল্ড ট্রাম্প কি স্রেফ পাগল?’। প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাও বিতর্কে ঢুকে পড়েছেন। তিনি বলেন তার বিশ্বাস যে প্রেসিডেন্ট হওয়ার জন্য ট্রাম্প শোচনীয় মাত্রার অযোগ্য।
বুধবার ট্রাম্প সমস্ত গুঞ্জনের ব্যাখ্যা দিতে টুইটারে হাজির হয়েছেন। ভেতরে ভেতরে কিছু একটা চলছে Ñ এমন গুঞ্জনে পানি ঢালতে চাইলেন তিনি। বললেন, ‘আমার শিবিরে ঐক্য অনেক দৃঢ়। সম্ভবত অতীতের যেকোন সময়ের চেয়ে একতা এখন বেশি। বিপুল সমর্থনের জন্য আমি সবাইকে ধন্যবাদ দিতে চাই।’
ট্রাম্প সরে দাঁড়ালে কী হবে?
যদি সত্যিই তা হয়, তবে বিকল্প খুঁজে বের করতে হন্য হয়ে উঠতে হবে না রিপাবলিকান দলকে। কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার বিভাগের প্রধান রবার্ট শ্যাপিরো বলেন, এমন পরিস্থিতিতে দলের করনীয় কী তা দলীয় নীতিমালাতেই বলা আছে। রিপাবলিকান ন্যাশনাল কমিটির (আরএনসি) রুল ৯-এ বলা আছে, যদি দলের প্রেসিডেন্ট বা ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রার্থী সরে দাঁড়ান, তাহলে দু’ভাবে শূন্যস্থান পূরণ করা যাবে। এক হলো আবারও জাতীয় সম্মেলনে আহবান করে, অন্যথায় আরএনসি নিজেই শূন্যস্থান পূরণ করবে। যদি আরেকটি সম্মেলন আয়োজন করতে না চায় দল, তাহলে প্রত্যেক অঙ্গরাজ্যের বিপরীতে যেসব সদস্য আরএনসি’তে রয়েছেন, তারাই সমভাবে ওই অঙ্গরাজ্যের নির্ধারিত ডেলিগেটদের অনুপাতে ভোট প্রয়োগ করতে পারবেন।
পূর্বে কি কখনও এমন ঘটেছে?
ইউনিভার্সিটি অব ভার্জিনিয়ার সেন্টার ফর পলিটিকস-এর পরিচালক ল্যারি সাবাতো বলেন, ‘আমি নিশ্চিত যে আপনি জানেন এসব স্রেফ গুজব। দৃশ্যত এমন সম্ভাবনার কোন ভিত্তি নেই। তবে এমনটা যদি সত্যিই ঘটে, সেক্ষেত্রে আরএনসি একাই নতুন বিকল্প প্রার্থী দিতে পারবে। নতুন কোন সম্মেলন ডাকা হবে না।’ তিনি আরও বলেন, ‘এ ধরণের দু’টি ঐতিহাসিক নজির রয়েছে। তবে দু’টি ঘটনাই ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর বেলায় হয়েছে। ১৯১২ সালের অক্টোবরে দ্বিতীয় মেয়াদের নির্বাচনের কয়েকদিন আগে প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম হাওয়ার্ড টাফটের ভাইস প্রেসিডেন্ট নিজ কার্যালয়ে মারা যান। আরএনসি তখন নতুন বিকল্প এনেছিল। কিন্তু তাতে কোন লাভ হয়নি। দ্বিতীয় নির্বাচনে ডেমোক্রেট দলের প্রার্থী উইড্রো উইলসনের কাছে বিপুল ব্যবধানে পরাজিত হন প্রেসিডেন্ট টাফট।’
দ্বিতীয় নজিরের ক্ষেত্রে ল্যারি সাবাতো বলেন, ‘১৯৭২ সালে ডেমোক্রেটিক দলের ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রার্থী সিনেটর (মিশৌরি) থমাস এগলেটন প্রতিদ্বন্দ্বীতা থেকে সরে দাঁড়ান। অথচ, সপ্তাহ কয়েক আগে তিনি চূড়ান্ত প্রার্থী হিসেবে মনোনীত হয়েছিলেন। এগলেটনের সরে দাঁড়ানোর কারণ হলো, ততদিনে বের হয়ে যায় যে, তার গুরুতর মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা রয়েছে। এ জন্য ইলেক্ট্রিক শক থেরাপিরও প্রয়োজন পড়ে। এগলেটন সরে দাঁড়ালে নতুন প্রার্থী নিয়োগ দেয় ডিএনসি। জন এফ কেনেডির বোনের স্বামী সার্জেন্ট শ্রাইভারকে বেছে নেন প্রেসিডেন্ট প্রার্থী জর্জ ম্যাকগোভার্ন। আর তা অনুমোদন করে ডিএনসি।’
ট্রাম্পের বেলায় বিকল্প কে?
শ্যাপিরো বলেন, ট্রাম্প সরে দাঁড়ালে যে কাউকে তার স্থলাভিষিক্ত করতে পারবে আরএনসি। ওই ব্যাক্তির প্রাইমারি নির্বাচনে লড়ার প্রয়োজন পড়বে না। সেক্ষেত্রে ট্রাম্পের ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রার্থী মাইক পেন্স, বা সিনেটর টেড ক্রুজ বা সিনেটর জন ম্যাককেইন হতে পারেন প্রার্থী।
শ্যাপিরো আরও জানান, সেক্ষেত্রে রিপাবলিকান দলের ওপর প্রচ- চাপ থাকবে এমন এক ব্যাক্তিকে মনোনয়ন দিতে যিনি কিনা দলকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারেন। আর তাহলে হাউস ¯িপকার পল রায়ান হতে পারেন ভালো পছন্দ। তিনি ট্রাম্পের কাছ থেকে সতর্কভাবে নিজের দূরত্ব বজায় রেখে চলেছেন। পাশাপাশি, প্রাইমারিতে ট্রাম্পের প্রধান দুই প্রতিদ্বন্দ্বী টেড ক্রুজ ও জন কাসিচও মনোনয়ন দাবি করতে পারেন।
আর ট্রাম্প যদি স্বতন্ত্র হয়ে লড়তে চান?
গুঞ্জন আছে রিপাবলিকান দলের মনোনয়ন ছুড়ে ফেলে এককভাবে লড়তে পারেন ট্রাম্প। যদি তিনি স্বতন্ত্রভাবে লড়েন সেক্ষেত্রে প্রায় নিশ্চিতভাবেই রিপাবলিকান দলের ভোট দুই ভাগ হয়ে যাবে এবং অনায়াসে প্রেসিডেন্ট হবেন হিলারি ক্লিনটন। তবে প্রার্থীর নাম ব্যালট পেপারে উঠানোর ব্যাপারে বেশ কড়া নিয়ম আছে আমেরিকায়। বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যভেদে তা বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। সাধারণত, ব্যালটে নাম উঠানোর শেষ তারিখ উর্তীর্ণ হয়ে যাওয়ার পর যদি রিপাবলিকান মনোনয়ন প্রত্যাখ্যান করেন ট্রাম্প, সেক্ষেত্রে তার নাম ব্যালট পেপারে উঠবে না, বরং ভোটাররা ট্রাম্পের নাম নিজ হাতে ফর্মে লিখে আসতে হবে।
এর কারণে কি ভোট পিছিয়ে যেতে পারে?
প্রায় নিশ্চিতভাবেই নির্বাচনের তারিখ পেছানো হবে না।
ট্রাম্পের সরে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা কতটুকু?
শ্যাপিরো বলেছেন তার বিশ্বাস ট্রাম্পের সরে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা মাত্র ১০ শতাংশ। তিনি বলেন, এই প্রার্থী খ্যাতি ও যশের প্রতি অনুরক্ত। তার জন্য এমন ¯পটলাইট থেকে সরে দাঁড়ানো বেশ কঠিন। এছাড়াও, আরও বড় কারণও আছে। প্রতিদ্বন্দ্বীতা থেকে সরে দাঁড়ালে ট্রাম্পের ব্যবসায়িক সাম্রাজ্যও ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে।
(সুত্র: দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্ট। অনুবাদ: নাজমুল আহসান।)