আর্টিজানের কর্মী এখন হকার

Slider জাতীয়

25482_f3

 

শিশির বৈরাগী। আলোচিত হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টের সহকারী শেফ। বছর চারেক আগে তার নিজ এলাকা বরিশালের আগৈলঝাড়ায় ব্যবসা করতেন। কিন্তু সেখানে লোকসানের পর লোকসানে তিনি ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন। জীবিকার সন্ধানে এসেছিলেন ঢাকায়। ২ বছর  বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে কাজ করেন। এরপর সহকারী শেফের কাজ নেন হলি আর্টিজান রেস্তরাঁয়। গত দু’বছর ধরে সেখানেই কাজ করছিলেন। তখন থেকেই ভাগ্য ফিরতে শুরু করে তার। ধারদেনা প্রায় পরিশোধ করে এনেছিলেন। এরই মধ্যে তার ৬ বছরের একমাত্র ছেলেটির কিডনি রোগ ধরা পড়ে। রেস্টুরেন্টে কাজের সুবাদে ছেলের চিকিৎসাও চলছিল ভালোভাবেই। কিন্তু গত ১লা জুলাইয়ে নৃশংস জঙ্গি হামলায় সবকিছু ওলট-পালট করে দিয়েছে। থেমে গেছে শিশিরের জীবনের চাকা। বন্ধ হয়ে গেছে ছেলের চিকিৎসাও। এই ঘটনার পর অন্তত ৫০টি রেস্টুরেন্টে কাজের সন্ধানে ধর্না দিয়েছেন। কাজের জন্য গেছেন মানুষের বাড়ি-বাড়ি। কিন্তু নিরাশ হয়েছেন। উপায় না পেয়ে নেমেছেন ফুটপাতে। সেখানে ছোট্ট একটি ডালায় টুথ ব্রাশ সাজিয়ে বিক্রি করছেন। সেই ব্রাশগুলো কেনার মতো পুঁজিও তার ছিল না। এক পরিচিতজন তাকে এর ব্যবস্থা করে দিয়েছেন, কোনরকম বেকারত্ব ঘুচাতে। দিনে ৩০টি ব্রাশ বিক্রি করতে পারলে তার কমিশন মেলে ১০০-১২০ টাকা। সকাল থেকে রাত অবধি কোনোদিন এই পরিমাণ ব্রাশ বিক্রি হয়, আবার কোনোদিন তার কমও হয়। শিশিরের গ্রামের বাড়ি বরিশাল জেলার আগৈলঝোড়ার জুবার পাড়ে।
গতকাল বারিধারা ব্রিজের ওপর গিয়ে দেখা হয় শিশির বৈরাগীর সঙ্গে। ছোট্ট একটি ডালায় ব্রাশ সাজিয়ে বসে আছেন তিনি। পথচারীরা চলার পথে সেগুলো হাতে নিয়ে দেখছেন। কেউ দামদরও করছেন। তবে একঘণ্টা সেখানে অবস্থান করে একটি ব্রাশও বিক্রি হতে দেখা যায়নি। এ সময় কথা হয় শিশির বৈরাগীর সঙ্গে। রেস্টুরেন্টের সময়কার কথা বলতে গিয়ে তার কণ্ঠ ভারী হয়ে ওঠে। তুলে ধরেন, তার বর্তমান দুঃসময়ের কথা। বলেন, ঋণগ্রস্ত হয়ে তিনি ঢাকা চলে আসেন। প্রথম দুই বছর তেমন সুবিধা করতে না পারলেও হলি আর্টিজানে কাজ করার পর থেকে তার ভাগ্যোন্নয়ন হতে শুরু করে। এই রেস্টুরেন্টে তার প্রতি মাসে গড়ে আয়-রোজগার হতো ২৫ হাজার টাকা। তিন বেলা খাওয়ার ব্যবস্থা ছিল। এমনকি পোশাকের খরচও বহন করতেন রেস্টুরেন্টের মালিক। সপ্তাহে একদিন ছুটি ছিল। এছাড়া প্রতি তিন মাস পর এক সপ্তাহের ছুটি পাওয়া যেতো। শিশির জানান, এই সময়ে তিনি ঋণের বোঝা অনেকটাই পরিশোধ করেন। কিন্তু ১লা জুলাইয়ে রেস্টুরেন্টে জঙ্গি হামলার পর সবকিছু পাল্টে যায়। বলেন, প্রথমদিকে ভেবেছিলেন রেস্টুরেন্টটি আবার চালু হবে। কিন্তু যখন বুঝতে পারেন শিগগিরই চালু হওয়ার সম্ভাবনা নেই তখন বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে কাজের সন্ধানে যান। শিশির জানান, গুলশান-বারিধারার অন্তত ৫০টি রেস্টুরেন্টে তিনি গেছেন। এর মধ্যে কয়েকটির নামও বললেন।
এছাড়া বিভিন্ন বিদেশির বাড়িতে এবং গেস্ট হাউসেও গেছেন কাছের সন্ধানে। কোথাও কাজ মেলেনি। ওইসব রেস্টুরেন্টের ব্যবসাও চলছে না। তাদের বিক্রি নেই। তাই লোক নেয়া তো দূরের কথা বরং  তাদের লোকজনই ছাঁটাই করছেন। শিশির বলেন, উপায় না পেয়ে তাই ফুটপাতে নেমেছি। নিজের চালান নেই। তাই পাশের রুমের থাকা এক ব্যক্তি এই ব্রাশ বিক্রির ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। এতে আয় কেমন জানতে চাইলে বলেন, প্রতিদিন ৩০/৪০ পিস বিক্রি হয়। এতে যে লাভ হয় তার থেকে ১০০ টাকা মতো কমিশন পাই। কোনোদিন ১২০ টাকাও পাই। শিশির বলেন, খুব কষ্টে আছি। একমাত্র ছেলের কিডনিতে সমস্যা। প্রস্রাবের সঙ্গে রক্ত পড়ে। প্রতি দু’মাস পরপর ঢাকায় এনে ডাক্তার দেখাতে হয়। সেখানে ১৫ হাজার টাকা যায়। যাওয়া-আসা যাবতীয় সবকিছু মিলে আরো যায় ৫ হাজার। তিনি বলেন, আর্টিজানের মালিক তার ছেলের চিকিৎসার জন্য লোনমানি দিতে চেয়েছিলেন কিন্তু তার ৩ দিন পরই বিপদ হয়ে গেলো। ডাক্তার জানিয়েছেন, তিন বছর তার চিকিৎসা করালে সে সুস্থ হয়ে যাবে। কিন্তু এখন তার চিকিৎসা কিভাবে চলবে এ নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছি। শিশিরি জানান, তিনি নতুন বাজারের পূর্ব পাশে ভাটারা এলাকায় এক রুম ভাড়া করে থাকেন। কিন্তু গত মাসের ভাড়াও বাকি পড়েছে। বাসার মালিক আর কতদিন থাকতে দেবেন তাও জানি না। আর্টিজানের এই সহকারী শেফ জানান, আজ সকালে একটুখানি ভাজি দিয়ে আধপেটা খেয়ে এসেছি। আবার রাতে গিয়ে খাবো। এভাবেই প্রতিদিন বেলা ১১টার দিকে এসে এই ব্রিজের ফুটপাতে বসেন আবার রাত ৯টার দিকে ব্রাশের মালিককে লাভের টাকা বুঝিয়ে দিয়ে কমিশন নিয়ে বাসায় ফেরেন। তিনি বলেন, এই রেস্টুরেন্টের ৭৫ জন কর্মচারীই এখন বেকার। অনেকেই ইতিমধ্যে গ্রামে চলে গেছেন। আমার মতো যাদের গ্রামে তেমন কিছু নেই তারা এখনও ঢাকা শহরে ঘুরছেন কাজের সন্ধানে। মানবেতর জীবনযাপন করছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *