উত্তরাঞ্চলের কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, লালমনিরহাট, বগুড়া ও দক্ষিণাঞ্চলের ফরিদপুরে সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। তীব্র বর্ষণ, পাহাড়ি ঢল ও নদীভাঙনের কারণে পানিবন্দী হয়ে পড়েছে কয়েক লাখ মানুষ। চরম দুর্ভোগে দিন কাটাচ্ছে বানভাসিরা।
প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর…
কুড়িগ্রাম: জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী মাহফুজার রহমান বলেন, আজ শনিবার সন্ধ্যা ছয়টায় ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বিপৎসীমার ৫৬ সেন্টিমিটার ও ধরলা নদীর পানি বিপৎসীমার ৫৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে নয়টি উপজেলার ৫৫টি ইউনিয়নের দুই লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। গত দুই দিনে নদীভাঙনে চার শতাধিক পরিবার গৃহহীন হয়ে পড়েছে। নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে একটি নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয় ও চারটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। ভাঙনের ঝুঁকিতে রয়েছে আরও কয়েকটি স্কুল। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ২২ কিলোমিটার বাঁধ।
ওসব এলাকায় দেখা দিয়েছে খাদ্য, বিশুদ্ধ খাওয়ার পানি ও গো-খাদ্যের তীব্র সংকট। রাস্তাঘাট তলিয়ে যাওয়ায় ভেঙে পড়েছে যোগাযোগব্যবস্থা। বন্যাকবলিত এলাকার শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। ইতিমধ্যে এসব এলাকায় পানিবাহিত নানা রোগের প্রকোপ শুরু হয়েছে।
কুড়িগ্রাম বন্যানিয়ন্ত্রণ কক্ষের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম বলেন, সরকারি হিসাবে ৩৩টি ইউনিয়নের ৩২৫টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। ৪১৫ বর্গকিলোমিটার এলাকা এখন বন্যার পানিতে ডুবে আছে। নদীভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৪ হাজার ৩৬২টি পরিবার। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার ৪০ হাজার ৬৩৪টি। এ হিসাবে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা ১ লাখ ২৬ হাজার ২৫১ জন। যোগাযোগের রাস্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১৭৯ কিলোমিটার। এর মধ্যে পাকা রাস্তা ১০ কিলোমিটার ও কাঁচা রাস্তা ১৬৯ কিলোমিটার। শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৬৫টি। বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ২২ কিলোমিটার এবং সেতু ও কালভার্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১১টি। একই সময়ে ফসল নষ্ট হওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ১৫ হাজার কৃষক।
জেলার সিভিল সার্জন জয়নাল আবেদীন জিল্লুর দাবি করেছেন, বন্যাদুর্গত এলাকায় ৮৫টি মেডিকেল টিম কাজ করছে। পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট, ওরস্যালাইনসহ প্রয়োজনীয় সব ওষুধ পর্যাপ্ত রয়েছে। এখন পর্যন্ত কোনো খারাপ খবর নেই। গত ২৪ ঘণ্টায় ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে ২৪ জন।
এদিকে ফুলবাড়ী, উলিপুর ও ভূরুঙ্গামারী উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বন্যার্ত ব্যক্তিদের মাঝে শুকনা খাবার বিতরণ করা হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল বলে জানিয়েছেন স্থানীয় ব্যক্তিরা।
ফুলবাড়ী উপজেলার ধরলা, নীলকুমর, বারোমাসিয়া নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে বন্যা দেখা দিয়েছে। তলিয়ে গেছে আউশ ধান ও রোপা আমন ধানের বীজতলা। ভেসে গেছে পুকুরের মাছ। প্লাবিত হয়েছে উপজেলার গোরকমণ্ডল, চর গোরকমণ্ডল, পেছাই, পশ্চিম ফুলমতী, কিশামত শিমুলবাড়ী, রোশন শিমুলবাড়ী, সোনাইকাজী, যতীন্দ্র নারায়ণ, কবিরমামুদ, রামপ্রসাদ, প্রাণকৃষ্ণ, চন্দ্রখানা, পশ্চিম ধনিরাম, পূর্ব ধনিরাম, মেকলি, বড়লই, বড়ভিটা, চর বড়লই, খোচাবাড়ী ও রাঙ্গামাটি গ্রাম। পাউবো নির্মিত ধরলার তীরবর্তী সোনাইকাজী রামপ্রসাদ গ্রামে ওয়াপদা বাঁধটি ভেঙে যাওয়ায় প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন গ্রাম।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা দেবেন্দ্র নাথ উরাঁও বলেন, সরকারিভাবে ৫০ হাজার টাকায় কেনা কিছু শুকনা খাবার বন্যার্ত ব্যক্তিদের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে।
ভূরুঙ্গামারীতে দুধকুমার নদের পানি বাড়ায় নদীর তীরবর্তী গ্রামগুলো প্লাবিত হয়েছে। এতে সাতটি গ্রামের কয়েক হাজার পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। পানিবন্দী গ্রামগুলো হলো কাজিয়ার চর, চর-তিলাই, নলেয়া, ইসলামপুর, পাইকডাঙ্গা, ভরতেরছড়া, গনাইরকুঠি। ভরতেরছড়া ও গনাইরকুঠি গ্রামে নদীভাঙন ও বন্যাকবলিত মানুষের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করা হলেও অন্য এলাকায় এখনো ত্রাণ বিতরণ করা হয়নি।
উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা রবিউল ইসলাম বলেন, ইতিমধ্যে ৬০ হাজার টাকার চাল, তেল, মুড়ি, ডাল ও মোমবাতি বিতরণ করা হয়েছে। আরও পাঁচ টন চাল পাওয়া গেছে, যা বিতরণের অপেক্ষায় রয়েছে।
রৌমারীতে বন্যায় প্রায় ৫০ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। দুই উপজেলার দায়িত্বে থাকা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা সাখাওয়াত হোসেন বলেন, রৌমারীতে ১৫ টন খয়রাতি চাল ও নগদ ৫০ হাজার টাকা এবং রাজীবপুরে ১০ টন চাল ও নগদ ২০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। বরাদ্দকৃত চাল ও টাকা বানভাসি মানুষের মাঝে বিতরণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
কুড়িগ্রামের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক আকতার হোসেন আজাদ বলেন, বন্যার্ত ব্যক্তিদের জন্য পাঁচ লাখ টাকার শুকনা খাবার বিতরণ শুরু হয়েছে। এ ছাড়া আরও ৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকা ও ৯৮ মেট্রিক টন চাল বিতরণের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। নতুন করে আরও ২০০ মেট্রিক টন চাল ও দুই লাখ টাকা বরাদ্দ পাওয়া গেছে, যা পর্যায়ক্রমে বিতরণ করা হবে।
গাইবান্ধা: গাইবান্ধার চারটি উপজেলার নদীতীরবর্তী অন্তত ১৯টি ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এতে প্রায় ২৫ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে।
প্লাবিত ইউনিয়নগুলো হচ্ছে সাঘাটা উপজেলার হলদিয়া, ঘুড়িদহ, সাঘাটা, জুমারবাড়ি, ভরতখালী, ফুলছড়ি উপজেলার কঞ্চিপাড়া, গজারিয়া, ফজলুপুর, এরেন্ডাবাড়ি, উড়িয়া, ফুলছড়ি, সদর উপজেলার কামারজানি, মোল্লারচর, গিদারি, সুন্দরগঞ্জ উপজেলার কাপাসিয়া, হরিপুর, চণ্ডীপুর, তারাপুর ও বেলকা।
এ ছাড়া বন্যায় জেলায় ১ হাজার ৮২৯ হেক্টর জমির পাট, পটোল, রোপা আমনের বীজতলার ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। চারটি উপজেলার ৪৫টি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পানি ওঠায় লেখাপড়া ব্যাহত হচ্ছে।
এদিকে ঘাঘট নদের পানিবৃদ্ধির কারণে সাদুল্যাপুর-লক্ষ্মীপুর বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধের পুরাণ লক্ষ্মীপুর গ্রামের প্রায় ১০০ ফুট অংশ হুমকির মুখে পড়েছে। বাঁধটি নদীগর্ভে বিলীন হলে পাশের শতাধিক ঘরবাড়ি ও আবাদি জমি তলিয়ে যাবে। অন্যদিকে শনিবার তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, করতোয়া ও ঘাঘট নদের পানিবৃদ্ধি অব্যাহত ছিল।
গাইবান্ধা জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা হাবিবুর রহমান বলেন, বন্যাকবলিত মানুষের জন্য ১০টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। ১২৫ মেট্রিক টন চাল ও নগদ ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা বিতরণ করা হয়েছে।
লালমনিরহাট: ভারতের উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল আর বৃষ্টিপাতের কারণে জেলার তিস্তা ও ধরলা নদীসহ সব নদ-নদীর পানি বেড়েছে। এতে দেখা দিয়েছে জলাবদ্ধতা।
জেলা প্রশাসক মো. হাবিবুর রহমান বলেন, গত এক সপ্তাহের বৃষ্টিপাতে তিস্তা ও ধরলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এতে ৪৫টি ইউনিয়নের মধ্যে ১৬টি ইউনিয়নে এখন পর্যন্ত ২৪ হাজার ৭৯৩ পরিবার পানিবন্দী অবস্থায় রয়েছে।
জেলা পাউবো দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, আজ দুপুর ১২টায় তিস্তা নদীর পানি ডালিয়া পয়েন্টে বিপৎসীমার ২৫ সেন্টিমিটার ও কাউনিয়া পয়েন্টে বিপৎসীমার ২০ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছিল।
জেলা প্রশাসক বলেন, বন্যাদুর্গত এলাকায় জেলা প্রশাসন ইতিমধ্যে ৩৬৫ মেট্রিক টন জিআরের চাল এবং শুকনা খাবার কেনার জন্য নগদ টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। বন্যায় ঘরবাড়ি ভেঙে গেলে বা ক্ষতিগ্রস্ত হলে প্রাথমিক বরাদ্দ হিসাবে নগদ তিন হাজার টাকা করে বিশেষ সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।
বগুড়া: উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে যমুনা নদীতে পানি বেড়ে যাওয়ায় বগুড়ার সারিয়াকান্দি, সোনাতলা ও ধুনট উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতি অবনতি ঘটেছে। বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে বেশ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) রেকর্ড অনুযায়ী, গত ২৪ ঘণ্টায় যমুনা নদীর পানি সারিয়াকান্দি পয়েন্টে ১৫ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়েছে। আজ সন্ধ্যা ৬টায় তা বিপৎসীমার ১৯ দশমিক ৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
বগুড়ার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. খোরশেদ আলম প্রথম আলোকে বলেন, বন্যার কারণে আজ পর্যন্ত তিনটি উপজেলার মোট ৬৮টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাঠদান কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এর মধ্যে সারিয়াকান্দিতে ৪৯টি, সোনাতলায় ১০টি এবং ধুনটে নয়টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় সারিয়াকান্দি উপজেলার দুর্গম চর কাজলা, কর্ণিবাড়ী, বোহাইল, চালুয়াবাড়ী এবং যমুনার তীরবর্তী সারিয়াকান্দি সদর, হাটশেরপুর, কুতুবপুর, কামালপুর ও চন্দনবাইশা ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে। সোনাতলা উপজেলার পাকুল্যা ও তেকানী চুকাইনগর ইউনিয়নের চরাঞ্চল এবং নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। বন্যায় চরাঞ্চলের প্রায় ২৪ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে।
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক বলেন, আজ সারিয়াকান্দি উপজেলায় দুই হাজার ৫০০ পরিবারের মধ্যে ২৫ মেট্রিকটন চাল বিতরণ করা হয়েছে। এ ছাড়া সেখানে আরও ৫০ হাজার টাকা ও ৩০ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। সোনাতলা ও ধুনট উপজেলার দুর্গত এলাকায় বিতরণের জন্য ৪০ মেট্রিক টন ত্রাণের চাল পাঠানো হয়েছে।
ফরিদপুর: গত কয়েক দিনের প্রবল বর্ষণের কারণে ফরিদপুরের চরভদ্রাসন উপজেলার তিনটি ইউনিয়নে পদ্মা নদীর ভাঙন তীব্রতর হয়েছে। এদিকে হাজিগঞ্জ বাজারে পদ্মানদীর তীর সংরক্ষণ বাঁধের সিসি ব্লকের প্রায় ১০০ ফুট ধসে গেছে।
এদিকে গত চার দিনে উপজেলার গাজীরটেক, চরঝাউকান্দা ও সদর ইউনিয়নের প্রায় ২০ একর পাট ও ধঞ্চেখেত পদ্মার গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। নদীভাঙনের কারণে আলিয়াবাদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ফাজেলখাঁরডাঙ্গি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও হুকুম আলি চোকদার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভাঙনের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।
ফরিদপুর পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মঈনউদ্দিন বলেন, আজ গোয়ালন্দ পয়েন্টে পদ্মা নদীর পানি বিপৎসীমার ৬ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। হাজিগঞ্জ বাজারের ভাঙনকবলিত এলাকায় জিও ব্যাগ ও সিসি ব্লক ফেলে ভাঙন রোধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
(প্রতিবেদনটি তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন কুড়িগ্রামের সফি খান, গাইবান্ধার শাহাবুল শাহীন, লালমনিরহাটের আবদুর রব, বগুড়ার আনোয়ার পারভেজ ও ফরিদপুরের পান্না বালা)