সারা দেশে কোচিং বাণিজ্য এখন তুঙ্গে। প্রতি বছরের মতো এবারও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিকে কেন্দ্র করে শুরু হয়েছে বাণিজ্য। রাজধানীসহ দেশের প্রায় প্রত্যেকটি জেলায় চলছে ভর্তির মৌসুম। শিক্ষাবিদরা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় যত আসন, তার কয়েক গুণ বেশি প্রতিযোগী। এ প্রতিযোগিতায় সুযোগ পাওয়ার জন্য শিক্ষার্থীরা কোচিং করে আত্মবিশ্বাস বাড়াতে চায়। কোচিং বাণিজ্য রোধে শিক্ষক-শিক্ষার্থী-অভিভাবকসহ সব মহলকেই সচেতন হতে হবে। আইন করে এটা রোধ করা যাবে না। কোচিংয়ের নেতিবাচক দিকগুলো জনসমক্ষে তুলে ধরতে হবে। তাহলে অনেকেই সচেতন হবে বলে মনে করেন তারা।
রাজধানীর কোচিং বাণিজ্যের আঁতুরঘর ফার্মগেট গিয়ে কয়েক ডজনখানেক কোচিং সেন্টারের দেখা মিললো। একাডেমিক কোচিং, বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিং, মেডিকেল ও ইঞ্জিনিয়ারিং ভর্তি কোচিং, ক্যাডেট কলেজ ভর্তি কোচিং, বিসিএস কোচিং, আর্মি-নেভি-বিমানবাহিনীতে চাকরি পাওয়ার কোচিংসহ বহু ধরনের কোচিং সেন্টার। কেবল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য রাজধানীতেই মোট ৩৩টি কোচিং সেন্টারের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে- ইউসিসি, ইউনিএইড (কিরণ, কবির, সুমন), ইউনিএইড (মনির, মল্লিক, জহির), ফোকাস, সানরাইজ, গার্ডিয়ান, ডিভাইন, এনইউসিসি (জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়), সাইফুর’স, ইপিপি (শুধু ক ইউনিট), ডিইউসিসি, ডিহক স্যার, লীডস, হোপ, আইকন প্লাস, ভয়েজ, মেরিন, আইকন, কোয়ান্টা, দুর্বার, প্যারাগন, অ্যাডমিশন অ্যাইড, প্রাইমেট, প্লাজমা, এইউএপি, সংশপ্তক, এফ্লিক্স, এডমিশন প্লাস, এডমিয়ার, ইউএসি, ইউরেনাস, পিএসি ও ইঞ্জিনিয়ার্স। মেডিকেল ও ডেন্টাল ভর্তির জন্য রয়েছে ১৩টি কোচিং সেন্টার-রেটিনা, সানরাইজ, পিএসি, কর্ণিয়া, ডিএমসি, মেডিকো, দি রয়াল, গ্রীন অ্যাডমিশন এইড, থ্রি ডক্টরস, ফেইম, প্রাইমেট, প্লাজমা, এভিস ও মেডিকেয়ার। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য উদ্ভাস, সানরাইজ, পিএসি, ওমেকা ও মেরিনথ এ পাঁচটি কোচিং সেন্টার রয়েছে। এরমধ্যে বেশ কয়েকটি কোচিং সেন্টার টেলিভিশনে পর্যন্ত ভর্তির বিজ্ঞাপন দিতে দেখা গেছে।
শিক্ষা নিয়ে কাজ করা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গণসাক্ষরতা অভিযান তথ্যমতে, দেশের প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক, স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যন্ত প্রায় সাড়ে পাঁচ কোটি শিক্ষার্থী রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় চার কোটি ২৪ লাখ ছাত্রছাত্রী কোনো না কোনোভাবে মূল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বাইরে অর্থের বিনিময়ে কোচিং নিচ্ছে। এ সংখ্যা প্রায় ৭৭ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ। দেশজুড়ে ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় দুই লাখ কোচিং সেন্টার রয়েছে। প্রতিবছর এইসব একাডেমিক ও ভর্তির কোচিং-এ বাণিজ্য হয় প্রায় ৩২ কোটি টাকা। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ এবং শিক্ষা নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের হিসাব প্রায় একই রকম। শিক্ষার জন্য বছরে এ পরিমাণ অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের। শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ বহুগুণে বাড়িয়ে তুলেছে কোচিং সেন্টারগুলো। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতেও কোচিং সেন্টার গড়ে উঠেছে। দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা এখন কোচিংনির্ভর। প্রথম শ্রেণি থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায় পর্যন্ত ভর্তি হতে এখন কোচিং করার রেওয়াজ শুরু হয়েছে ভর্তিচ্ছুদের। এছাড়া, সকল পরীক্ষাতেই কোচিং করছেন শিক্ষার্থীরা। অনেকের কাছে শিক্ষাবোর্ড কর্তৃক নির্ধারিত পাঠ্যবইয়ের চেয়ে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে গাইড বই। ফলে এখন চলছে রমরমা কোচিং বাণিজ্য। কোনো ভাবেই রোধ করা যাচ্ছে না শিক্ষা ধ্বংসের এই আত্মঘাতী প্রবণতা।
জানা গেছে, শিশুদের পিএসসি পরীক্ষাকে ঘিরে কোচিং সেন্টার চালুর হিড়িক পড়ে যায় সারা দেশে। কেবল রাজধানীতেই এ ধরনের কোচিং সেন্টারের সংখ্যা প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার। নিজ বাসায় কোচিং সেন্টার খুলে বসেছেন নামিদামি স্কুল-কলেজের অনেক শিক্ষক। অভিযোগ রয়েছে, যেখানে না পড়লে তার রোষানলে পড়েন শিক্ষার্থীরা। পরীক্ষায় নম্বর কমিয়ে দেয়ার ভয় দেখিয়ে শিক্ষার্থীদের কোচিংয়ে বাধ্য করে ওই সব শিক্ষক। শুধু রাজধানী ঢাকা নয়, এ অভিযোগ আছে দেশের অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের বিরুদ্ধেই।
বিশেষজ্ঞদের মতে, মূলত নিত্যনতুন শিক্ষা ও পরীক্ষা পদ্ধতি চালু, মানসম্পন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অভাব, শ্রেণিকক্ষে মানসম্পন্ন শিক্ষা না পাওয়া আর সরকারি অর্থের অপ্রতুলতার কারণে কোচিং নির্ভর হয়ে পড়ছে প্রাথমিক, মাধ্যমিকসহ পুরো শিক্ষা ব্যবস্থা। রাষ্ট্রের পরিবর্তে শিক্ষা ব্যয়ের চাপ বাড়ছে পরিবারের ওপর।
বাড়ছে শিক্ষা ব্যয়: সরকারি হিসাব ও দেশি- বিদেশি গবেষণা সংস্থার পরিসংখ্যান বলছে, দেশে এই মুহূর্তে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৫৯ শতাংশ ও সরকারি সহায়তাপ্রাপ্ত (এমপিওভুক্ত) মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ব্যয়ের ৭১ শতাংশই নির্বাহ করে পরিবার। আর এই অর্থের সবচেয়ে বড়ো অংশই ব্যয় হয় কোচিংয়ে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৪৩ শতাংশ এবং মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ৮৫ শতাংশ শিক্ষার্থী আটকে আছে কোচিংয়ে। এডুকেশন ওয়াচের এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, পারিবারিক ব্যয়ে প্রাইভেট কোচিংয়ের ওপর নির্ভরতা শিক্ষা ক্ষেত্রে বড় ধরনের সংকট তৈরি করছে। প্রাথমিক পর্যায়েও ব্যাপকভাবে প্রাইভেট কোচিংয়ের ওপর নির্ভর হয়ে পড়ছে শিক্ষা ব্যবস্থা। তথ্য মতে, মাধ্যমিক পর্যায়ে সরকারি স্কুলের ক্ষেত্রে ৮৮ শতাংশ, বেসরকারি স্কুলের ক্ষেত্রে ৭৮ শতাংশ এবং মাদরাসার ক্ষেত্রে ৭০ শতাংশ অভিভাবক ছেলেমেয়েদের জন্য প্রাইভেট কোচিংয়ের ব্যবস্থা করে থাকেন। আর প্রাথমিক পর্যায়েও ৩০ থেকে ৪৩ শতাংশ অভিভাবক প্রাইভেট শিক্ষক নিয়োগ করে থাকেন। এই অবস্থা আবার সরকারি স্কুলের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ৪৩ শতাংশ। গবেষণায় দেখা গেছে, প্রাইভেট কোচিংয়ে খরচ হচ্ছে পারিবারিক ব্যয়ের সবচেয়ে বড়ো অংশ। মোট বার্ষিক মাথাপিছু ব্যয়ের ১৬ থেকে ২৪ শতাংশ প্রাথমিক পর্যায়ে এবং ২১ থেকে ৪২ শতাংশ মাধ্যমিক পর্যায়ে। দরিদ্র পরিবারগুলোর পক্ষে প্রাইভেট শিক্ষক নিয়োগ করা সম্ভব হয় না। ফলে এসব পরিবারের ছেলেমেয়েরা সচ্ছল ঘরের ছেলেমেয়েদের তুলনায় অনেক বেশি পিছিয়ে থাকতে বাধ্য হচ্ছে।
পরীক্ষা পদ্ধতিতেই বড় সমস্যা: অনেকে মনে করেন, নিত্যনতুন শিক্ষা ও পরীক্ষা পদ্ধতি চালু, মানসম্পন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অভাব, শ্রেণিকক্ষে মানসম্পন্ন শিক্ষা না পাওয়ায় কোচিংনির্ভর হয়ে পড়ছে শিক্ষার্থীরা। আর এই সুযোগে নানা পন্থায় শিক্ষার নামে বেপরোয়া বাণিজ্য চলছে দেশজুড়ে। এদিকে কোচিংয়ের অভিযোগ আছে ঢাকাসহ দেশের সকল বড় শহরের প্রধান প্রধান শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের বিরুদ্ধেই। তিন বছর আগে শিক্ষকদের কেবল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অধীনে কোচিংয়ের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল সরকারিভাবে।
গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, এটি আজ একটি ব্যাধি হয়ে দাঁড়িয়েছে। আসলে, ভালো মানের স্কুল কম, তাই এই কম স্কুলে ভর্তির জন্য শুরু হয় অসুস্থ প্রতিযোগিতা। জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির সদস্য সচিব অধ্যাপক শেখ ইকরামুল কবীর জানান, কোচিং নির্ভরতা এখন ভয়াবহ সমস্যা হয়ে উঠেছে। স্কুলে শিক্ষার্থীদের কোচিংয়ে বাধ্য করা হচ্ছে। আবার বাইরেও দোকান খুলে হাজার হাজার কোটি টাকার কোচিং বাণিজ্য হচ্ছে। এগুলো বন্ধ করা জরুরি।
মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) মহাপরিচালক অধ্যাপক ফাহিমা খাতুন বলেন, শ্রেণিকক্ষে ছাত্র-শিক্ষকের অনুপাত ঠিক করতে না পারলে সমস্যার সমাধান হবে না। একেকটি ক্লাসে ৭০ থেকে ৮০ জন শিক্ষার্থীকে একজন শিক্ষক পড়ালে আসলে কিছুই হয় না। উন্নত দেশগুলোতে এটা করা হয় না।
অকার্যকর নীতিমালা: ২০১২ সালের ২০শে জুন কোচিং বাণিজ্য বন্ধের নীতিমালার প্রজ্ঞাপন জারি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এরপর ওই বছরের ২৫শে জুন নীতিমালায় একটি সংশোধনী আনা হয়। এতে সব বিষয়ের জন্য স্কুলভিত্তিক কোচিং ফি সর্বোচ্চ এক হাজার ২০০ টাকা নির্ধারণ করে দেয়া হয়। নীতিমালায় বলা আছে, সরকারি-বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা নিজ প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীদের কোচিং বা প্রাইভেট পড়াতে পারবেন না। তবে তারা নিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধানের অনুমতি সাপেক্ষে অন্য প্রতিষ্ঠানে দিনে সর্বোচ্চ ১০ জন শিক্ষার্থীকে নিজ বাসায় পড়াতে পারবেন। বাস্তবে এ নীতিমালা কেউই মানছেন না।
রাজধানীর কোচিং বাণিজ্যের আঁতুরঘর ফার্মগেট গিয়ে কয়েক ডজনখানেক কোচিং সেন্টারের দেখা মিললো। একাডেমিক কোচিং, বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিং, মেডিকেল ও ইঞ্জিনিয়ারিং ভর্তি কোচিং, ক্যাডেট কলেজ ভর্তি কোচিং, বিসিএস কোচিং, আর্মি-নেভি-বিমানবাহিনীতে চাকরি পাওয়ার কোচিংসহ বহু ধরনের কোচিং সেন্টার। কেবল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য রাজধানীতেই মোট ৩৩টি কোচিং সেন্টারের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে- ইউসিসি, ইউনিএইড (কিরণ, কবির, সুমন), ইউনিএইড (মনির, মল্লিক, জহির), ফোকাস, সানরাইজ, গার্ডিয়ান, ডিভাইন, এনইউসিসি (জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়), সাইফুর’স, ইপিপি (শুধু ক ইউনিট), ডিইউসিসি, ডিহক স্যার, লীডস, হোপ, আইকন প্লাস, ভয়েজ, মেরিন, আইকন, কোয়ান্টা, দুর্বার, প্যারাগন, অ্যাডমিশন অ্যাইড, প্রাইমেট, প্লাজমা, এইউএপি, সংশপ্তক, এফ্লিক্স, এডমিশন প্লাস, এডমিয়ার, ইউএসি, ইউরেনাস, পিএসি ও ইঞ্জিনিয়ার্স। মেডিকেল ও ডেন্টাল ভর্তির জন্য রয়েছে ১৩টি কোচিং সেন্টার-রেটিনা, সানরাইজ, পিএসি, কর্ণিয়া, ডিএমসি, মেডিকো, দি রয়াল, গ্রীন অ্যাডমিশন এইড, থ্রি ডক্টরস, ফেইম, প্রাইমেট, প্লাজমা, এভিস ও মেডিকেয়ার। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য উদ্ভাস, সানরাইজ, পিএসি, ওমেকা ও মেরিনথ এ পাঁচটি কোচিং সেন্টার রয়েছে। এরমধ্যে বেশ কয়েকটি কোচিং সেন্টার টেলিভিশনে পর্যন্ত ভর্তির বিজ্ঞাপন দিতে দেখা গেছে।
শিক্ষা নিয়ে কাজ করা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গণসাক্ষরতা অভিযান তথ্যমতে, দেশের প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক, স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যন্ত প্রায় সাড়ে পাঁচ কোটি শিক্ষার্থী রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় চার কোটি ২৪ লাখ ছাত্রছাত্রী কোনো না কোনোভাবে মূল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বাইরে অর্থের বিনিময়ে কোচিং নিচ্ছে। এ সংখ্যা প্রায় ৭৭ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ। দেশজুড়ে ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় দুই লাখ কোচিং সেন্টার রয়েছে। প্রতিবছর এইসব একাডেমিক ও ভর্তির কোচিং-এ বাণিজ্য হয় প্রায় ৩২ কোটি টাকা। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ এবং শিক্ষা নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের হিসাব প্রায় একই রকম। শিক্ষার জন্য বছরে এ পরিমাণ অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের। শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ বহুগুণে বাড়িয়ে তুলেছে কোচিং সেন্টারগুলো। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতেও কোচিং সেন্টার গড়ে উঠেছে। দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা এখন কোচিংনির্ভর। প্রথম শ্রেণি থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায় পর্যন্ত ভর্তি হতে এখন কোচিং করার রেওয়াজ শুরু হয়েছে ভর্তিচ্ছুদের। এছাড়া, সকল পরীক্ষাতেই কোচিং করছেন শিক্ষার্থীরা। অনেকের কাছে শিক্ষাবোর্ড কর্তৃক নির্ধারিত পাঠ্যবইয়ের চেয়ে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে গাইড বই। ফলে এখন চলছে রমরমা কোচিং বাণিজ্য। কোনো ভাবেই রোধ করা যাচ্ছে না শিক্ষা ধ্বংসের এই আত্মঘাতী প্রবণতা।
জানা গেছে, শিশুদের পিএসসি পরীক্ষাকে ঘিরে কোচিং সেন্টার চালুর হিড়িক পড়ে যায় সারা দেশে। কেবল রাজধানীতেই এ ধরনের কোচিং সেন্টারের সংখ্যা প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার। নিজ বাসায় কোচিং সেন্টার খুলে বসেছেন নামিদামি স্কুল-কলেজের অনেক শিক্ষক। অভিযোগ রয়েছে, যেখানে না পড়লে তার রোষানলে পড়েন শিক্ষার্থীরা। পরীক্ষায় নম্বর কমিয়ে দেয়ার ভয় দেখিয়ে শিক্ষার্থীদের কোচিংয়ে বাধ্য করে ওই সব শিক্ষক। শুধু রাজধানী ঢাকা নয়, এ অভিযোগ আছে দেশের অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের বিরুদ্ধেই।
বিশেষজ্ঞদের মতে, মূলত নিত্যনতুন শিক্ষা ও পরীক্ষা পদ্ধতি চালু, মানসম্পন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অভাব, শ্রেণিকক্ষে মানসম্পন্ন শিক্ষা না পাওয়া আর সরকারি অর্থের অপ্রতুলতার কারণে কোচিং নির্ভর হয়ে পড়ছে প্রাথমিক, মাধ্যমিকসহ পুরো শিক্ষা ব্যবস্থা। রাষ্ট্রের পরিবর্তে শিক্ষা ব্যয়ের চাপ বাড়ছে পরিবারের ওপর।
বাড়ছে শিক্ষা ব্যয়: সরকারি হিসাব ও দেশি- বিদেশি গবেষণা সংস্থার পরিসংখ্যান বলছে, দেশে এই মুহূর্তে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৫৯ শতাংশ ও সরকারি সহায়তাপ্রাপ্ত (এমপিওভুক্ত) মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ব্যয়ের ৭১ শতাংশই নির্বাহ করে পরিবার। আর এই অর্থের সবচেয়ে বড়ো অংশই ব্যয় হয় কোচিংয়ে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৪৩ শতাংশ এবং মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ৮৫ শতাংশ শিক্ষার্থী আটকে আছে কোচিংয়ে। এডুকেশন ওয়াচের এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, পারিবারিক ব্যয়ে প্রাইভেট কোচিংয়ের ওপর নির্ভরতা শিক্ষা ক্ষেত্রে বড় ধরনের সংকট তৈরি করছে। প্রাথমিক পর্যায়েও ব্যাপকভাবে প্রাইভেট কোচিংয়ের ওপর নির্ভর হয়ে পড়ছে শিক্ষা ব্যবস্থা। তথ্য মতে, মাধ্যমিক পর্যায়ে সরকারি স্কুলের ক্ষেত্রে ৮৮ শতাংশ, বেসরকারি স্কুলের ক্ষেত্রে ৭৮ শতাংশ এবং মাদরাসার ক্ষেত্রে ৭০ শতাংশ অভিভাবক ছেলেমেয়েদের জন্য প্রাইভেট কোচিংয়ের ব্যবস্থা করে থাকেন। আর প্রাথমিক পর্যায়েও ৩০ থেকে ৪৩ শতাংশ অভিভাবক প্রাইভেট শিক্ষক নিয়োগ করে থাকেন। এই অবস্থা আবার সরকারি স্কুলের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ৪৩ শতাংশ। গবেষণায় দেখা গেছে, প্রাইভেট কোচিংয়ে খরচ হচ্ছে পারিবারিক ব্যয়ের সবচেয়ে বড়ো অংশ। মোট বার্ষিক মাথাপিছু ব্যয়ের ১৬ থেকে ২৪ শতাংশ প্রাথমিক পর্যায়ে এবং ২১ থেকে ৪২ শতাংশ মাধ্যমিক পর্যায়ে। দরিদ্র পরিবারগুলোর পক্ষে প্রাইভেট শিক্ষক নিয়োগ করা সম্ভব হয় না। ফলে এসব পরিবারের ছেলেমেয়েরা সচ্ছল ঘরের ছেলেমেয়েদের তুলনায় অনেক বেশি পিছিয়ে থাকতে বাধ্য হচ্ছে।
পরীক্ষা পদ্ধতিতেই বড় সমস্যা: অনেকে মনে করেন, নিত্যনতুন শিক্ষা ও পরীক্ষা পদ্ধতি চালু, মানসম্পন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অভাব, শ্রেণিকক্ষে মানসম্পন্ন শিক্ষা না পাওয়ায় কোচিংনির্ভর হয়ে পড়ছে শিক্ষার্থীরা। আর এই সুযোগে নানা পন্থায় শিক্ষার নামে বেপরোয়া বাণিজ্য চলছে দেশজুড়ে। এদিকে কোচিংয়ের অভিযোগ আছে ঢাকাসহ দেশের সকল বড় শহরের প্রধান প্রধান শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের বিরুদ্ধেই। তিন বছর আগে শিক্ষকদের কেবল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অধীনে কোচিংয়ের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল সরকারিভাবে।
গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, এটি আজ একটি ব্যাধি হয়ে দাঁড়িয়েছে। আসলে, ভালো মানের স্কুল কম, তাই এই কম স্কুলে ভর্তির জন্য শুরু হয় অসুস্থ প্রতিযোগিতা। জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির সদস্য সচিব অধ্যাপক শেখ ইকরামুল কবীর জানান, কোচিং নির্ভরতা এখন ভয়াবহ সমস্যা হয়ে উঠেছে। স্কুলে শিক্ষার্থীদের কোচিংয়ে বাধ্য করা হচ্ছে। আবার বাইরেও দোকান খুলে হাজার হাজার কোটি টাকার কোচিং বাণিজ্য হচ্ছে। এগুলো বন্ধ করা জরুরি।
মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) মহাপরিচালক অধ্যাপক ফাহিমা খাতুন বলেন, শ্রেণিকক্ষে ছাত্র-শিক্ষকের অনুপাত ঠিক করতে না পারলে সমস্যার সমাধান হবে না। একেকটি ক্লাসে ৭০ থেকে ৮০ জন শিক্ষার্থীকে একজন শিক্ষক পড়ালে আসলে কিছুই হয় না। উন্নত দেশগুলোতে এটা করা হয় না।
অকার্যকর নীতিমালা: ২০১২ সালের ২০শে জুন কোচিং বাণিজ্য বন্ধের নীতিমালার প্রজ্ঞাপন জারি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এরপর ওই বছরের ২৫শে জুন নীতিমালায় একটি সংশোধনী আনা হয়। এতে সব বিষয়ের জন্য স্কুলভিত্তিক কোচিং ফি সর্বোচ্চ এক হাজার ২০০ টাকা নির্ধারণ করে দেয়া হয়। নীতিমালায় বলা আছে, সরকারি-বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা নিজ প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীদের কোচিং বা প্রাইভেট পড়াতে পারবেন না। তবে তারা নিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধানের অনুমতি সাপেক্ষে অন্য প্রতিষ্ঠানে দিনে সর্বোচ্চ ১০ জন শিক্ষার্থীকে নিজ বাসায় পড়াতে পারবেন। বাস্তবে এ নীতিমালা কেউই মানছেন না।