ড. ফখরুদ্দীন আহমদ
২০০৯ সালের ৬ই জানুয়ারি আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর ড. ফখরুদ্দীন আহমদ কিছুদিন দেশেই ছিলেন। তিনি ঘোষণাও দিয়েছিলেন দেশে থাকবেন। প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব ছেড়ে দেয়ার পর তার নিরাপত্তাও দিয়েছিল সরকার। ছিলেন সরকারের দেয়া বাড়িতে। কিন্তু ওই বছরের মে মাসে খবর প্রকাশ হয়, ড. ফখরুদ্দীনকে সংসদীয় কমিটিতে তলব করা হচ্ছে। তার বিরুদ্ধে উঠা বিভিন্ন অভিযোগ তদন্ত হবে। এরপরই সরকারি বাড়ি ছেড়ে পরিবার নিয়ে পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রে। দেশটির নাগরিক হওয়ার সুবাদে বাড়ি কেনেন মেরিল্যান্ড স্টেটের পটোম্যাকে। সেখানে তার দুটি বাড়ির একটিতে তিনি পরিবার নিয়ে থাকেন। আর অন্য বাড়িতে থাকে তার মেয়ের পরিবার। ইউনিভার্সিটি অব ভার্জিনিয়ায় ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ বিষয়ে ভিজিটিং স্কলার হিসেবে গবেষণা ও শিক্ষকতা করেছেন তিনি। দীর্ঘ দিন থেকে তিনি সেখানে অবস্থান করলেও বাংলাদেশি কমিউনিটির সামনে তিনি প্রকাশ হন না খুব একটা। গত বছরের শেষের দিকে বন্ধু আবদুল মুনিম চৌধুরীর জানাজায় অংশ নিতে নিউ ইয়র্কে এসেছিলেন। জ্যামাইকা মুসলিম সেন্টারে জানাজায় অংশ নিতে গিয়ে বিব্রতকর অবস্থায় পড়েন ফখরুদ্দীন। জানাজার আগে তিনি কিছু কথা বলতে চাইলে সেখানে হইচই শুরু হয়। আপত্তি জানান উপস্থিত প্রবাসীরা। বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতির জন্য ড. ফখরুদ্দীনকে দায়ী করে তাদের কেউ কেউ তার ওপর চড়াও হওয়ার চেষ্টা করেন। জানাজা শেষে তিনি নীরবেই ওই স্থান ত্যাগ করেন। এরপর থেকে তাকে আর জনসমক্ষে দেখা যায়নি।
মইন উ আহমেদ
এক এগারোর সময়কার সেনাপ্রধান জেনারেল মইন উ আহমেদ সেনাপ্রধান হিসেবে অবসর নেন আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালের মাঝামাঝিতে। ওই বছরের ১৪ই জুন তিনি চলে যান যুক্তরাষ্ট্রে। প্রথমে ফ্লোরিডায় ছোট ভাই ও ছেলের কাছে থাকতেন। পরে তার ক্যানসার ধরা পড়লে চিকিৎসার জন্য নিউ ইয়র্কে চলে যান। সেখানে একটি ভাড়া বাসায় স্ত্রী নাজনীন মইনকে নিয়ে বসবাস শুরু করেন। একটি অ্যাপার্টমেন্ট ভবনের পার্কিং ফ্লোরে দুই কক্ষের একটি ছোট বাসায় বসবাস করছেন। সেখান থেকেই নিয়মিত চিকিৎসা নিচ্ছেন। সেখান থেকে পাবলিক বাসে করেই মাঝে মাঝে তিনি চিকিৎসকের কাছে যান। ক্যানসারের সঙ্গে বোনম্যারোর সমস্যায়ও ভুগছেন সাবেক এই সেনা প্রধান। ক্যানসারের জন্য ক্যামো থেরাপি নিতে হচ্ছে। আর ব্যোনমেরোতে অস্ত্রোপচারও হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে মাঝে একবার ওমরা পালন করতে তিনি সৌদি আরব গিয়েছিলেন। নিউ ইয়র্কের একান্ত ঘনিষ্ঠজন ছাড়া কারও সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ হয় না তার। একান্ত প্রয়োজন ছাড়া বাইরে বের হন কম। সম্প্রতি ফাউন্ডেশন অব ফ্লোরিডার আয়োজনে উত্তর আমেরিকা রবীন্দ্র সম্মিলনে অংশ নিয়েছিলেন জেনারেল মইন। সম্প্রতি একটি গণমাধ্যমকে দেয়া সাক্ষাৎকারে মইন উ আহমেদ জানিয়েছিলেন তিনি দেশে আসতে চান। তবে চিকিৎসকরা তাকে ছাড়পত্র দিচ্ছেন না। তিনি এও বলেছেন, দেশকে ভালোবেসে তিনি পরবাসী হয়েছেন।
মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী
ওয়ান-ইলেভেনের সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দেশের দুর্নীতি-অনিয়ম দূর করার অভিযানের জন্য গঠন করা ‘গুরুতর অপরাধ দমন সংক্রান্ত জাতীয় কমিটি’র প্রধান সমন্বয়ক ছিলেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল মাসুদ উদ্দিন চৌধুুরী (অব.)। সে সময় সাভারের নবম পদাতিক ডিভিশনের জিওসি থাকা মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী পরে পদোন্নতি পেয়ে মেজর জেনারেল হয়েছিলেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় সক্রিয় থাকা এ কর্মকর্তা নির্বাচন প্রস্তুতিকালীন সময়ে ২০০৮ সালের ৪ঠা নভেম্বর হাইকমিশনারের দায়িত্ব নিয়ে অস্ট্রেলিয়া চলে যান। স্বাভাবিক মেয়াদ শেষ হওয়ার পর বর্তমান সরকার চার দফায় তার মেয়াদ বাড়ায়। সেখানে ছয় বছর দায়িত্ব পালনের পর ২০১৪ সালের শেষ নাগাদ ঢাকায় ফিরে আসেন। দেশে ফিরে তেজগাঁওয়ে আন্তর্জাতিক মানের একটি রেস্টুরেন্ট দিয়ে ব্যবসা শুরু করেন। রেস্টুরেন্টের নাম পিকাসো। জেনারেল মাসুদ ও তার স্ত্রী এর দেখাশোনা করেন। নিজের ব্যবসা নিয়েই ব্যস্ত থাকেন। বাইরের অনুষ্ঠানাদিতে খুব একটা দেখা যায় না তাকে।
এটিএম আমিন
ওয়ান-ইলেভেন সময়ে প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরের (ডিজিএফআই) পরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন মেজর জেনারেল এটিএম আমিন (অব.)। নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় আসার পরও প্রভাবশালী এ কর্মকর্তা তার পদেই ছিলেন। অবসরের আগে দায়িত্ব দেয়া হলেছিল আনসারে। ২০০৯ সালের ১৭ই মে সব আর্থিক সুবিধাসহ সেনাবাহিনী থেকে অবসরে যান তিনি। পরে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক পরিচয়ে দেশত্যাগ করেন। বর্তমানে তিনি দুবাইয়ে অবস্থান করছেন। সেখানে তিনি একটি আন্তর্জাতিক সংস্থায় কাজ করছেন বলে জানা গেছে। দেশ ছাড়ার পর মেজর জেনারেল আমিন আর দেশে ফিরেননি।
চৌধুরী ফজলুল বারী
ওয়ান-ইলেভেনের সময়ের আরেক আলোচিত সামরিক কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল চৌধুরী ফজলুল বারী অবস্থান করছেন যুক্তরাষ্ট্রের ডালাসে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শেষ সময়ে ব্রিগেডিয়ার বারী ওয়াশিংটন ডিসিতে বাংলাদেশ দূতাবাসে সামরিক অ্যাটাশের চাকরি নিয়ে দেশ ত্যাগ করেছিলেন। পরে নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় আসার পর তাকে দেশে ফেরার নির্দেশ দিলেও তিনি আর দেশে ফিরেননি। তিনি যুক্তরাষ্ট্রেই স্থায়ীভাবে বসবাসের সিদ্ধান্ত নেন। স্ত্রীর আবেদনে সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাসের সুযোগ পান ফজলুল বারী। সেখানে তিনি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন।
এ ছাড়া এক-এগারোর আগে উপদেষ্টা পদ থেকে পদত্যাগ করা লেফটেন্যান্ট জেনারেল হাসান মশহুদ চৌধুরী (অব.) পরে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। বলা হয়ে থাকে, সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পছন্দে তাকে ওই পদে বসানো হয়েছিল। ওই সময়ে রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে ঢালাও অভিযোগ এবং একের পর এক মামলা করে আলোচনায় ছিল দুর্নীতি দমন কমিশন। পরবর্তী গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় আসার পর ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন দুদক চেয়ারম্যান হাসান মশহুদ। সমালোচনার মুখে ২০০৯ সালের ২রা এপ্রিলে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন তিনি। এরপর থেকেই অনেকটা লোকচক্ষুর আড়ালে সাবেক এই সেনা কর্মকর্তা। ঢাকার ডিওএইচএসের বাসাতেই সময় কাটান। শরীর চর্চার জন্য বাসা থেকে বের হলেও বন্ধু ও ঘনিষ্ঠজন ছাড়া অন্যদের এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেন।