লাইলাতুল কদর, মহিমান্বিত এক রজনী, বছরের কোনো রাত-দিন বা সময়ের এমন মর্যাদা নেই যার সাথে এর তুলনা চলে। তাই এর নামকরণ হয়েছে ‘লাইলাতুল কদর’।
পবিত্র কুরআনে ‘আল-কদর’ নামে একটি সূরার নামকরণের মাধ্যমে এর গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য প্রকাশ পেয়েছে। এই সূরায় স্বয়ং আল্লাহ প্রশ্ন করেছেন- তুমি কি জান কদর রাত কী?
আল্লাহ নিজেই এর উত্তর বলে দিয়েছেন, কদরের রাত হাজার মাস অপেক্ষা অধিক কল্যাণময়।
এই রাতে এমন কী হয়েছে, কী এমন ঘটেছে, যার জন্য এত মর্যাদা? এমন কী আছে এই রাতে, স্বয়ং আল্লাহ নিজের জবানীতে এই বিশাল মর্যাদার ঘোষণা দিলেন?
সূরা আল-কদরের শুরুতে আল্লাহ সুস্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, ‘আমি এই কুরআনকে কদর রাতে নাজিল করেছি।’ এটাই কদর রজনীর মর্যাদার মূল কারণ। মূলত পবিত্র কুরআন অবতরণের সাথে সম্পৃক্ততায় কদর রাতের এই মর্যাদা। অর্থাৎ মূল মর্যাদা রাতের নয়, বরং কুরআন মাজিদের। কুরআন মাজিদের কারণেই সাধারণ একটি রাত হাজার মাসের সেরা হওয়ার গৌরব অর্জন করেছে। তাহলে ভেবে দেখার বিষয় পবিত্র কুরআন কতখানি মর্যাদা ও সম্মানের অধিকারী।
এখন আমাদের জানতে হবে কুরআন কী? কুরআন অবতরণের কারণ কী? কুরআন অবতরণের পরে পৃথিবীতে কী পরিবর্তন সূচিত হয়েছে?
আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের জবানীতেই আমরা প্রশ্নগুলোর সংক্ষেপে উত্তর জানার চেষ্টা করি। সূরা বাকারার একেবারে শুরুতেই আল্লাহ পাক কুরআন মাজিদের পরিচয় তুলে ধরেছেনÑ এটি আল্লাহর কিতাব যাতে সন্দেহের লেশমাত্র নেই, এটি মুত্তাকিদের জন্য হেদায়াত।
হজরত আদম আ:কে জান্নাত থেকে পৃথিবীতে পাঠানোর সময় আল্লাহ বলেন, তোমরা এখনই এখান থেকে নেমে যাও। এরপর আমার পক্ষ থেকে যে হেদায়াত তোমাদের কাছে পৌঁছবে, যারা আমার সেই হেদায়াত অনুসরণ করবে তাদের জন্য থাকবে না কোনো ভয়, কোনো দুঃখ-কষ্ট। আর যারা একে মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানাবে এবং আমার আয়াতকে মিথ্যা বলে উড়িয়ে দেবে, তারা হবে জাহান্নামের অধিবাসী। সেখানে তারা চিরকাল থাকবে (সূরা বাকারা- ৩৮-৩৯)।
পবিত্র কুরআন হচ্ছে আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ সর্বশেষ পরিপূর্ণ আসমানী হেদায়াত এবং অতীতের সব আসমানী হেদায়াতের নির্যাস, যা সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ রাসূল হজরত মুহাম্মাদ সা:-এর ওপর অবতরণ করা হয় সমগ্র মানবমণ্ডলীর পথ প্রদর্শনের জন্য।
সূরা বাকারার ১৮৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, রমজান মাস, এ মাসেই কুরআন নাজিল করা হয়েছে, যা মানবজাতির জন্য পরিপূর্ণ হেদায়াত এবং এমন দ্ব্যর্থহীন শিক্ষাসংবলিত যা সত্য-সঠিক পথ দেখায় এবং হক ও বাতিলের মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য তৈরি করে দেয়।
পবিত্র কুরআনের এই আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কুরআন নাজিলের কারণ সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছেন। অর্থাৎ সত্য-সঠিক পথ দেখানো এবং সত্য ও অসত্যের মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য তৈরি করে দেয় এই কুরআন।
দুনিয়ার বুকে সর্বপ্রথম মানব ও পয়গাম্বর হজরত আদম আ: থেকে শুরু করে সর্বশেষ পয়গাম্বর হজরত মুহাম্মাদ সা: পর্যন্ত আসমানী হেদায়াতের সুদীর্ঘ ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, নবুয়ত ও রিসালাতের ধারাবাহিকতায় সাইয়্যেদেনা হজরত ইবরাহীম আ:-এর মর্যদা ও গুরুত্ব ভিন্ন রকম। হজরত ইবরাহীম আ:-এর দুই পুত্রÑ হজরত ইসমাঈল আ: ও হজরত ইসহাক আ:।
হজরত মুহাম্মাদ সা:-এর ঊর্ধ্বতন বংশধারা হজরত ইসমাঈল আ:-এর দিকে সরাসরি হজরত ইবরাহীম আ:-এর সাথে গিয়ে মিলিত হয়েছে। হজরত ইবরাহীম আ:-এর এই বংশে পয়গাম্বর মাত্র দুই জনÑ হজরত ইসমাঈল আ: ও হজরত মুহাম্মাদ সা:। পক্ষান্তরে হজরত ইসহাক আ:-এর বংশে আল্লাহ অগণিত নবী-রাসূল পাঠিয়েছেন। হজরত ইসহাক আ:-এর পুত্রের নাম হজরত ইয়াকুব আ:। তাঁর উপাধি ছিল ইসরাঈল। তাঁর বংশধারাই ইতিহাসে বনি ইসরাঈল নামে পরিচিত। অর্থাৎ হজরত ইবরাহীম আ:-এর বংশধারা দু’টিÑ বনি ইসহাক এবং বনি ইসমাঈল। বনি ইসহাকের ধারায় ইসরাঈল এবং বনি ইসমাঈল থেকে সাইয়্যেদুল আম্বিয়া মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সা:।
বনি ইসরাঈলের প্রতি আল্লাহ পাক অশেষ করুণা দেখিয়েছেন। অজস্র নেয়ামত তাদের দান করেছেন। তাদের জন্য পরিশ্রম ব্যতিরেকে আসমানী খাদ্যের ব্যবস্থা করেছিলেন, ফেরাউনের জুলুম থেকে রক্ষা করেছিলেন, এমনকি গোটা দুনিয়ার শ্রেষ্ঠত্বও আল্লাহ পাক তাদের দিয়েছিলেন। পবিত্র কুরআনে এর বিস্তারিত বিবরণ এসেছে। সূরা বাকারার ৪৭ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন, হে বনি ইসরাঈল! আমার সেই নেয়ামতের কথা স্মরণ করো, যা আমি তোমাদেরকে দান করেছিলাম। এ কথাটিও স্মরণ করো যে, আমি দুনিয়ার সমস্ত জাতির ওপর তোমাদেরকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছিলাম।
এত নেয়ামত, দয়া, করুণা সত্ত্বে¡ও বনি ইসরাঈল তাদের ওপর আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে যে দায়িত্ব ছিল, তা পালনে তারা ব্যর্থ হয়। তাদেরকে বারবার সতর্ক করার পরও তারা সংশোধন হয়নি। এমনকি গোটা দুনিয়ার শ্রেষ্ঠত্ব তাদের দেয়ার পরও তারা সীমালঙ্ঘন করে। দিনদুপুরে তারা অনেক নবী-রাসূলকে নির্মমভাবে হত্যা করে। তাদের এই সীমালঙ্ঘন ও ব্যর্থতায় বিশ্বে নতুন নেতৃত্ব ও হেদায়াত অপরিহার্য হয়ে পড়ে।
অবশেষে সেই গুরুত্বপূর্ণ সময় এসে উপস্থিত হলোÑ পবিত্র মাহে রমজানের লাইলাতুল কদর। এই সেই মহিমান্বিত রাত, যে রাতের এক সিদ্ধান্তেই হাজার হাজার বছরের ইসরাঈলি কর্তৃত্ব ধুলোয় লুটিয়ে পড়ে এবং হজরত মুহাম্মাদ সা:-এর মাধ্যমে গোটা দুনিয়ার নেতৃত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব ও বনি ইসমাঈলের হাতে চলে আসে। লাইলাতুল কদরে হজরত মুহাম্মাদ সা:-এর ওপর পবিত্র কুরআন নাজিল হওয়ার মাধ্যমে নবুয়তের দরজা চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। তিনিই সর্বশেষ নবী। ভবিষ্যতে আর কোনো নবী আসবে না, পৃথিবী নতুন কোনো আসমানী হেদায়াতের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করবে না। কেয়ামত পর্যন্ত গোটা দুনিয়া পরিচালিত হবে বনি ইসমাঈল হজরত মুহাম্মাদুর রা:-এর নেত্বত্বে এবং লাইলাতুর কদরে অবতীর্ণ মহাগ্রন্থ আল-কুরআন নির্দেশিত পথে।
ক্ষমতা বলতে যা বুঝায় তার সবটুকুর একচ্ছত্র মালিক আল্লাহ রাব্বুল আলামীন। যাবতীয় ক্ষমতা তাঁরই হাতে। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা ক্ষমতা দেন করেন, আবার যার কাছ থেকে ইচ্ছা করেন, ক্ষমতা ছিনিয়ে নেন। কদর রজনীতে বনি ইসরাঈলের হাত থেকে যাবতীয় ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব ছিনিয়ে নিয়ে আল্লাহ পাক তা সমর্পণ করেন বনি ইসমাঈল হজরত মুহাম্মাদ সা:-এর হতে। কেয়ামত পর্যন্ত এখানে আর পরিবর্তন আসবে না। পরিবর্তনের প্রয়োজনও হবে না।
মুফাচ্ছিরগণ ‘কদরের রাত’ শব্দের যে দু’টি অর্থ করেছেন এর মধ্যে একটি হচ্ছেÑ এটি সেই রাত, যে রাতে ভাগ্যের ফায়সালা করে দেয়া হয়। কদরের রাত মানে ভাগ্য রচনা ও ভাগ্য বিপর্যয়ের রাত। সুতরাং এটি সাধারণ কোনো রাত নয়। এই রাতে গোটা মানবজাতির জন্য এই ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে গেল যে, এখন থেকে তাদের ইহকাল-পরকাল তথা জীবনের সামগ্রিক উন্নতি, অগ্রগতি, কল্যাণ ও মুক্তি সব কিছুই নির্ভর করবে কুরআন মানার ওপর। অর্থাৎ বনি ইসমাঈল সাইয়্যেদেনা মুহাম্মাদুর রা:-এর নেতৃত্বের প্রতি স্বতঃস্ফূর্ত আনুগত্যই মানবজাতির মুক্তির একমাত্র পথ। পক্ষান্তরে কদরের রাত বনি ইসরাইলের জন্য চরম ভাগ্য বিপর্যয়ের রাত। গোটা দুনিয়ার সমস্ত জাতির ওপর যাদের শ্রেষ্ঠত্ব ছিল, এই এক রাতেই তা ভূলুণ্ঠিত হয়ে যায়।
সময়ের হিসাবে রাত নয়, বরং আমলই এখানে মুখ্য। অর্থাৎ এ রাতের আমল হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম। কদরের রাত সবার ওপর দিয়েই অতিবাহিত হয়, কিন্তু মর্যাদাবান তারাই হন, যারা এ রাতে আমল করেন। বুখারি শরিফে বর্ণিত হাদিস, হজরত আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত, তিনি রাসূলে করিম সা: থেকে বর্ণনা করেছেন, রাসূলে করিম সা: এরশাদ করেছেন, যে লোক আল্লাহর প্রতি ঈমান ও তাঁর কাছে সওয়াব পাওয়ার আকাক্সা মনে পোষণ করে রমজান মাসে রোজা রাখবে, তার অতীতের সব গোনাহ মাফ করে দেয়া হবে। আর যে লোক কদর রাতে জাগ্রত থেকে আল্লাহর ইবাদতে অতিবাহিত করবে, তারও সব গোনাহ মাফ করে দেয়া হবে।
আফসোস! গোটা মানজাতির ভাগ্য রচনার গুরুত্বপূর্ণ এই রাতকে কেন্দ্র করে অনেক বিদয়াত হয়ে গেছে। কুরআন এবং সুন্নাহকে বাদ দিয়ে ইবাদতের মনগড়া ফর্মুলা প্রদর্শিত হচ্ছে। মনে রাখতে হবে, এই রাত কুরআন অবতরণের রাত। তাই ইবাদত হতে হবে কুরআনের ধারক ও বাহক সাইয়্যেদুল আম্বিয়া মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সা: নির্দেশিত ও শেখানো পদ্ধতিতে। সাহাবায়ে কেরাম রা: তাই করেছেন। রমজান মাসে এবং লাইলাতুল কদরের সর্বোত্তম আমল হচ্ছে কুরআন ও সুন্নাহকেন্দ্রিক ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজ গঠনের আমল।