সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা

Slider অর্থ ও বাণিজ্য

 

graph_221984

 

 

 

 

 

সারাবিশ্ব থেকে কমলেও সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশের নামে গচ্ছিত অর্থের পরিমাণ বেড়েছে। ২০১৫ সাল শেষে বাংলাদেশের নামে রয়েছে ৫৫ কোটি ৮ লাখ ফ্রাঁ, যা আগের বছরের চেয়ে প্রায় ৯ শতাংশ বেশি। তবে এর সবই পাচার করা অর্থ নয়। অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশ থেকেও পাচার হওয়া অর্থের একটি অংশ সুইস ব্যাংকগুলোতে জমা হয়।

গ্রাহকের তথ্য গোপন রাখার কারণে সুইস ব্যাংকগুলো অবৈধ অর্থ রাখার নিরাপদ জায়গা হিসেবে পরিচিত। তবে সাম্প্রতিক সময়ে আন্তর্জাতিক নানা চাপের মুখে সুইজারল্যান্ড কিছুটা নমনীয় হয়েছে। উপযুক্ত প্রমাণসহ কোনো দেশ তথ্য চাইলে ক্ষেত্রবিশেষ দেশটি সহায়তা করছে। ফলে অবৈধভাবে অর্জিত অর্থ সুইস ব্যাংকে জমা রাখার বৈশ্বিক প্রবণতা কমেছে।

সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুইস ন্যাশনাল ব্যাংক (এসএনবি) গতকাল বৃহস্পতিবার ‘ব্যাংকস ইন সুইজারল্যান্ড ২০১৫’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনে এসব ব্যাংকের কাছে বিভিন্ন দেশভিত্তিক অর্থ জমার তথ্য রয়েছে। এতে দেখা যায়, ২০১৫ সাল শেষে সুইস ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামে থাকা অর্থের পরিমাণ ৪ হাজার ৪০৬ কোটি (৮০ টাকায় এক ফ্রাঁ) টাকা। গত ১০ বছরের মধ্যে এটিই সর্বোচ্চ । ২০১৪ সালে বাংলাদেশের নামে ছিল ৫০ কোটি ৬০ লাখ সুইস ফ্রাঁ (৪০৪৮ কোটি টাকা), যা তার আগের বছরের চেয়ে ৩৬ শতাংশ বেশি। ২০১৩ সালে বাংলাদেশিদের গচ্ছিত অর্থের পরিমাণ ছিল ৩৭ কোটি ১৯ লাখ সুইস ফ্রাঁ, যা এখনকার বিনিময় হার অনুযায়ী প্রায় তিন হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ। ২০১৫ সালে সুইজারল্যান্ডের বাইরে অর্থাৎ সারাবিশ্ব থেকে সুইস ব্যাংকগুলোতে জমা হয়েছে ১ লাখ ৩৩ হাজার কোটি ফঁদ্ধা। ২০১৪ সালে এর পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৩৮ হাজার কোটি ফ্রাঁ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত ডেপুটি গভর্নর আবু হেনা মোহা. রাজী হাসান  বলেন. গত বছর সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশের অর্থ থাকার খবর প্রকাশিত হওয়ার পর সেদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের (এসএনবি) কাছে এ বিষয়ে তথ্য চেয়ে চিঠি দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এসএনবি তখন জানায়, কোনো ব্যক্তির নামে তথ্য চাইলে তারা দেওয়ার চেষ্টা করে। পুরো দেশের তথ্য দেওয়া সম্ভব নয়। রাজী হাসান আরও বলেন, ব্যাংকস ইন সুইজারল্যান্ড নামের প্রকাশনায় বাংলাদেশের কাছে ‘দায়’ হিসেবে যে অর্থের পরিমাণ উল্লেখ করা হয়, তার মধ্যে বাংলাদেশের ব্যাংক ও প্রবাসী বাংলাদেশিদের অর্থও রয়েছে, যা বৈধ। কিছু পাচার করা অর্থ থাকতে পারে বলে তার ধারণা।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান মনসুর  বলেন, দেশের বাইরে বাংলাদেশিদের বৈধ ও অবৈধ অর্থের পরিমাণ শত শত মিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে সুইজারল্যান্ডে আছে খুব সামান্য। সুইস ব্যাংকে পাচার করা অর্থও থাকতে পারে। আবার বৈধ অর্থও থাকতে পারে। তিনি বলেন, বাংলাদেশি পাসপোর্টধারী একজন অভিবাসী বৈধভাবেই অন্য দেশের ব্যাংকে টাকা রাখতে পারেন। অর্থ জমা থাকার বিষয়ে সুনির্দিষ্টভাবে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক তথ্য না পেলে পাচার বিষয়ে সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যাবে না। তবে বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছরই যে বড় অঙ্কের অর্থ পাচার হয়, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। আর পাচার করা অর্থ সাধারণত ফেরত আনা সম্ভব হয় না।

সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোয় বিভিন্ন দেশের বিপরীতে ‘দায়’ অথবা ‘গ্রাহকের কাছে দেনা’ খাতে থাকা অর্থকে এসএনবি সংশ্লিষ্ট দেশগুলো থেকে রাখা গচ্ছিত অর্থ হিসেবে বিবেচনা করে। দেখা গেছে, ২০১৫ সালে সুইস ব্যাংকগুলোতে বিদেশি গ্রাহকের নামে দায় কমেছে। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেরও সুইস ব্যাংকগুলোতে অর্থ জমার পরিমাণ কমেছে। অবশ্য পাকিস্তানের বেড়েছে।

বাংলাদেশের কোনো নাগরিক বা প্রতিষ্ঠান যদি নিজের বদলে অন্যের নামে অর্থ গচ্ছিত রেখে থাকে, তাহলে তা এই হিসাবের মধ্যে আসেনি। একইভাবে সুইস ব্যাংকে গচ্ছিত রাখা মূল্যবান শিল্পকর্ম, স্বর্ণ বা দুর্লভ সামগ্রীর আর্থিক মূল্যমান হিসাব করে এখানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। অনেক দেশের নাগরিকই মূল্যবান শিল্পকর্ম বা দুর্লভ সামগ্রী সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকের ভল্টে রেখে থাকেন।

গত মে মাসে অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের আন্তর্জাতিক জোট আইসিআইজে প্রকাশিত পানামার আইনি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান মোসাক ফনসেকা থেকে ফাঁস হওয়া তথ্যে বাংলাদেশের ৫৬ ব্যক্তির নাম পাওয়া যায়।

এসব ব্যক্তি ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ড, সিসিলি, সামোয়াসহ করের স্বর্গ বলে পরিচিত বিভিন্ন দেশে নামসর্বস্ব কোম্পানি খুলে অর্থ পাচার করেছেন।

ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান গ্গ্নোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির (জিএফআই) সর্বশেষ রিপোর্টেও বাংলাদেশ থেকে টাকা পাচারের তথ্য রয়েছে। জিএফআইর তথ্য মতে, ২০১৩ সালে বাংলাদেশ থেকে ৯৬৬ কোটি ৬০ লাখ ডলার পাচার হয়েছে, যা এর আগের বছরের চেয়ে ৩৪ শতাংশ বেশি। বর্তমান বিনিময় হার ( প্রতি ডলার ৭৮ টাকা) অনুযায়ী বাংলাদেশি মুদ্রায় এর পরিমাণ ৭৫ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা। পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে বেশি মূল্য ও পরিমাণ দেখানো (ওভার ইনভয়েসিং) ও রফতানির ক্ষেত্রে কম মূল্য ও পরিমাণ দেখানোর ( আন্ডার ইনভয়েসিং) মাধ্যমেই প্রায় ৮০ ভাগ অর্থ পাচার হয়েছে। ২০০৪ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত এক দশকে বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে ৫ হাজার ৫৮৭ কোটি ৭০ লাখ ডলার বা ৪ লাখ ৩৫ হাজার ৮৪১ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, কর ফাঁকি, দুর্নীতি কিংবা মানি লন্ডারিংয়ের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে সেই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবের তথ্য পাওয়া যায়। এ প্রক্রিয়ায় ভারতকে কিছু গ্রাহকের তথ্য সুইস কর্তৃপক্ষ দিতে রাজি হয়েছে। এর বাইরে তথ্য চাইলে সাধারণত পাওয়া যায় না।

এসএনবির রিপোর্টের তথ্য মতে, সু্ইস ব্যাংকগুলোতে ২০১৫ সালে ভারতীয়দের জমা থাকা অর্থের পরিমাণ ১২২ কোটি ৪০ লাখ ফ্রাঁ বা ৮ হাজার ৩৯২ কোটি রুপি। আগের বছর এর পরিমাণ ছিল প্রায় ১২ হাজার কোটি রুপি। এক বছরের ব্যবধানে কমেছে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। গতকাল ইকোনমিক টাইমসের এক খবরে বলা হয়েছে, কালো টাকার বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী যুদ্ধ ঘোষণা এবং তথ্য পাওয়ার বিষয়ে ভারতকে সুইজারল্যান্ডের সহযোগিতার কারণে ভারতীয়দের অর্থ জমা রাখার পরিমাণ কমেছে। গত বছর সুইস ব্যাংকগুলোতে পাকিস্তানের জমা অর্থের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৪৮ কোটি ফ্রাঁ, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় সাড়ে ১১ হাজার কোটি টাকা। আগের বছর ছিল ১২৪ কোটি ফ্রাঁ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *