পঞ্চগড়: পঞ্চগড়ে চলতি মৌসুমে সরকারি খাদ্য গুদামে সরকার নির্ধারিত মূল্যে গম সংগ্রহে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। কৃষকের নাম ভাঙিয়ে সর্বদলীয় রাজনৈতিক নেতাদের যৌথ সিন্ডিকেট হাতিয়ে নিয়েছে কয়েক কোটি টাকা। বরাদ্দ কয়েকজন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) পেয়েছেন বলে কৃষকরা অভিযোগ করেছে। এভাবেই চরম অনিয়মের মধ্য দিয়েই শেষ করা হয়েছে গম সংগ্রহ অভিযান।
জেলা খাদ্য বিভাগ সূত্রে জানা যায়, চলতি মৌসুমে পঞ্চগড় জেলায় গম সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ১১ হাজার ৯৬৮ টন। এর মধ্যে তেঁতুলিয়া উপজেলায় তিন হাজার ২৮৩ টন, পঞ্চগড় সদর উপজেলায় দুই হাজার ৯২৩ টন, আটোয়ারী উপজেলায় দুই হাজার ৩৩৫ টন, বোদা উপজেলায় এক হাজার ৭৮৯ টন এবং দেবীগঞ্জ উপজেলায় এক হাজার ২৭৫ টন। পঞ্চগড় জেলায় গত ১ এপ্রিল থেকে ৭ জুন পর্যন্ত গম সংগ্রহ অভিযান পরিচালিত হয়।
সংগ্রহ অভিযান শুরুর আগেই অধিকাংশ ক্ষুদ্র কৃষক তাদের উৎপাদিত গম বিক্রি করে দেন। বিশেষ কারণে স্থানীয় খাদ্যগুদাম মে মাসের শেষের দিকে গম সংগ্রহ শুরু করায় প্রকৃত কৃষকদের পরিবর্তে খাদ্যগুদামে সর্বদলীয় একটি সিন্ডিকেটের ব্যবসায়ীরা গম সরবরাহ করেন। আর কৃষকদের নাম ভাঙিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় একটি সিন্ডিকেট।
পঞ্চগড় জেলার পাঁচটি উপজেলার মধ্যে পঞ্চগড় সদর, আটোয়ারী ও তেঁতুলিয়া উপজেলায় গম সংগ্রহে অনিয়মের মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে বলে জানিয়েছে কৃষকরা। এমনকি বঞ্চিত কৃষকরা প্রতিবাদ জানিয়ে একাধিকবার বিক্ষোভ মিছিল করেছে। তবু প্রশাসনের নীরব ভূমিকা কৃষকের মাঝে অসন্তোষের সৃষ্টি করেছে।
ক্ষোভ প্রকাশ করে পঞ্চগড়ের আটোয়ারী উপজেলার রাধানগর ইউনিয়নের কৃষক নুর আলম জানান, সরকার কেজি প্রতি ২৮ টাকা দরে ন্যায্যমূল্যে কৃষকের কাছ থেকে গম সংগ্রহ করবে এই আশায় টাকার প্রয়োজন সত্যেও বাড়িতে ১২০ মণ গম বিক্রি করিনি। কিন্তু ১০ বিঘা জমিতে আবাদ করেও কৃষক হিসেবে তালিকায় নাম না থাকায় ন্যায্যমূল্যে সরকারের খাদ্য গুদামে গম দিতে পারিনি। এভাবেই প্রতিবছর আমরা প্রকৃত কৃষকরা বঞ্চিত হয়ে চলেছি। আমাদের দিকে দেখার কেউ নেই।
অপরদিকে আলোখোয়া ইউনিয়নের ভুমিহীন কৃষক দাহিরুল ইসলাম অবাক হয়ে বলেন, আমার এক ছোটাক জমিও নেই, কোন গম আবাদও করিনি। তারপরও আমার নামে ৩ টন গম বরাদ্দ হয়েছে অথচ আমি এর কিছুই জানিনা। তার মতো হাজার হাজার কৃষকের অবস্থা একই। প্রকৃত কৃষক হওয়া সত্যেও পায়নি কোন গমের স্লিপ আবার কেউ গম চাষ না করেই পেয়েছে গমের বরাদ্দ।
বঞ্চিত কৃষকরা জানান, সরকারি খাদ্য গুদামে সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে গম সংগ্রহ করার কথা থাকলেও খাদ্য গুদামে কৃষকের পরিবর্তে ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে গম দিয়েছে প্রশাসন ও দলীয় একটি সিন্ডিকেট। খাদ্য সংগ্রহ কমিটির আহ্বায়ক, কৃষি কর্মকর্তাসহ জনপ্রতিনিধি ও দলীয় নেতারা প্রকৃত কৃষকের নাম ছাটাই করে ভূমিহীন মানুষের ২ থেকে ৩ একর জমির আবাদ দেখিয়ে তাদের নাম তালিকায় অন্তর্ভূক্ত করে। আবার কখনও দেখা গেছে একই পরিবারের নারী পুরুষসহ ৩ থেকে ৪ জনের নাম। সেই নামের জন প্রতি ৩ টন করে গমের স্লিপ বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। আর তাদের বরাদ্দকৃত স্লিপ খাদ্য সংগ্রহ কমিটি গোপনে ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে দেয়। যার টন প্রতি তারা ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি করে। নাম অন্তর্ভূক্ত কৃষক বরাদ্দের বিষয়ে কিছু না জানলেও পরে তাদের হাতে ৫’শ থেকে ১ হাজার টাকা গুজে দিয়ে ব্যাংক একাউন্ট করে নেয় ব্যবসায়ীরা।
এ বিষয়ে পঞ্চগড় সদর উপজেলা খাদ্য গুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সাদেক সারওয়ারের কাছে জানতে চাইলে তিনি তথ্য দিয়ে অস্বীকার করেন।
শুধু তাই নয়, এবছর উপজেলা খাদ্য সংগ্রহ কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে পঞ্চগড় সদর, আটোয়ারী ও তেঁতুলিয়া উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তারাও গমের বরাদ্দ নিয়েছেন বলে অভিযোগ করেছে কৃষকরা। কৃষকরা গম সংগ্রহের অনিয়মের জন্য খাদ্য সংগ্রহ কমিটিকেই দায়ী করছেন। তাদের স্বেচ্ছাচারিতায় সরকারের ন্যায্যমূল্যে গম সংগ্রহের অভিযান ভেস্তে গেছে বলে মনে করেন প্রকৃত গমচাষীরা।
তবে পঞ্চগড় সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা লায়লা মুনতাজেরী দীনা, আটোয়ারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবু রাফা মো. আরিফ ও তেঁতুলিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন গম সংগ্রহে তাদের অনিয়মের বিষয়টি অস্বীকার করেছেন।
এই তিন উপজেলায় গম সংগ্রহ অভিযানে সর্বদলীয় সিন্ডিকেটের কোটি কোটি টাকা অনিয়মে কৃষকরা হতাশ হয়েছেন। সিন্ডিকেটের এই বিরাট অঙ্কের টাকা বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, কৃষি কর্মকর্তা ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে ভাগ হয়েছে। জেলা চালকল সমিতির সভাপতি আমিরুল ইসলাম পঞ্চগড়ে প্রভাবশালীদের একটি অংশের টাকা ভাগের দায়িত্ব পালন করছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। প্রভাবশালীদের সাথে কথা বলে এর সত্যতা পাওয়া গেছে।
তবে বোদা ও দেবীগঞ্জ উপজেলায় স্থানীয় সাংসদ অ্যাডভোকেট নূরুল ইসলাম সুজন সরাসরি কৃষকদের হাতে কার্ড সরবরাহ করায় এই দুই উপজেলায় রাজনৈতিক দলগুলোর নেতা ও ব্যবসায়ীদের কোনো সিন্ডিকেট হয়নি। তবে ওই দুই উপজেলায় কিছু কৃষক গম সরবরাহ না করেও পেয়েছেন ৩ থেকে ৪ হাজার টাকা। এদিকে দুই উপজেলার খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তারা বস্তাপ্রতি ৫০ থেকে ১০০ টাকা করে হাতিয়েছেন।
এবিষয়ে পঞ্চগড় জেলা প্রশাসক অমল কৃষ্ণ মন্ডল জানান, গম সংগ্রমের অনিয়মের বিষয়ে এখনো কোন অভিযোগ হাতে পাইনি। অভিযোগ পেলে তদন্ত সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
একদিকে সিন্ডিকেটের কোটি কোটি টাকা ভাগাভাগি অন্যদিকে প্রকৃত গমচাষীদের চোখে হতাশা কান্না ঝরছে। প্রতিবছর এভাবেই প্রান্তিক এ জেলার কৃষকরা প্রতারিত ও বঞ্চিত হয়ে চলেছেন বলে জানিয়েছেন কৃষকরা। এ বিষয়ে পঞ্চগড়ের কৃষকরা সরকারে সুদৃষ্টি কামনা করেছেন।