কেন এত গোপনীয়তা

Slider জাতীয়

mitu_today_221428

 

 

 

 

 

পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু হত্যার ঘটনায় রহস্য আরও ঘনীভূত হচ্ছে। বাবুল আক্তারকে দীর্ঘ জিজ্ঞাসাবাদ এবং মূল পরিকল্পনাকারীর নাম ও হত্যার কারণ এখনও প্রকাশ না করায় জনমনে নানা সন্দেহ ও গুঞ্জন বাড়ছে। এ ছাড়া সন্দেহভাজন দুই আসামির স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি নিয়ে পুলিশের ‘অতি গোপনীয়তায়’ও নানা প্রশ্ন উঠেছে। অনেকে বলছেন, বিভিন্ন সময় জনগণের আগ্রহ ও স্বার্থে চাঞ্চল্যকর ঘটনায় আসামিদের দেওয়া জবানবন্দি গণমাধ্যম প্রকাশ করে থাকে। তবে মিতু হত্যার ঘটনায় আদালতে আসামিদের দেওয়া বক্তব্যের ব্যাপারে সংশ্লিষ্টরা যেন মুখে কুলুপ এঁটেছেন। প্রকাশ্যে তারা এ নিয়ে কোনো কথাই বলতে রাজি নন। সংশ্লিষ্টরা দাবি করছেন, দুই সন্দেহভাজনের ২৪ পাতার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির অনুলিপি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সিলগালা করে পাঠানো হয়েছে। তবে এর আগে কখনও জবানবন্দির অনুলিপি নিয়ে এত গোপনীয়তা দেখা যায়নি। সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র বলছে, জবানবন্দিতে দু’জন জানিয়েছেন, খুনের নির্দেশদাতা বাবুলের সোর্স আবু মুছা। এখন প্রশ্ন, কার নির্দেশে মিতু হত্যার পরিকল্পনা করেছিলেন মুছা। কে তাকে ভাড়া করেছিলেন? কেন এত দিনের বিশ্বস্ত দুই গুপ্তচর মুছা ও এহতেশামুল হক ভোলা পুলিশ কর্মকর্তা বাবুলের স্ত্রীর হত্যার সঙ্গে জড়াবেন? নাকি আলোচিত এই মামলার তদন্ত মুছা পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকবে
এ ব্যাপারে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, হত্যার সঙ্গে জড়িত আরও দু-একজন ধরা পড়বে। এরই মধ্যে জড়িত সন্দেহভাজনদের শনাক্ত করা হয়েছে। সন্দেহভাজন আসামিদের সঙ্গে কথা বলিয়ে দিতে বাবুলকে ডিবি কার্যালয়ে নেওয়া হয়েছিল। তাকে ওই সময় আসামিদের মুখোমুখি করা হয়।

গত শুক্রবার কঠোর গোপনীয়তার মধ্য দিয়ে খিলগাঁওয়ের শ্বশুরের বাসা থেকে বাবুল আক্তারকে মিন্টো রোডের ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে টানা ১৫ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। মিতু হত্যার পর ওই বাসায় দুই শিশুসন্তানকে নিয়ে থাকছেন বাবুল। বাবুলকে জিজ্ঞাসাবাদের পর থেকেই তার শ্বশুর মোশাররফ হোসেন বলে আসছেন, বাবুলকে বাসা থেকে নিয়ে যাওয়ার পর পুুলিশ যে লুকোচুরি করেছে, তা ঠিক হয়নি। পুলিশের নাটকীয়তার কারণেই বিভ্রান্তি ও গুজব ছড়ানোর সুযোগ পেয়েছে একটি চক্র। বাবুলের কাজে ঈর্ষান্বিত হয়ে কেউ নতুন ষড়যন্ত্র করছে। তবে এখনও মিতু হত্যার ঘটনায় বাবুলকে সন্দেহে রেখেছেন সংশ্লিষ্টরা। যদিও তারা কেউ প্রকাশ্যে এ নিয়ে কোনো কথা বলতে রাজি নন।

মামলার তদন্তের সঙ্গে যুক্ত একাধিক কর্মকর্তা গতকাল সমকালকে বলেন, এরই মধ্যে মিতু হত্যা মামলার ৮০ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। যে কোনো মামলার তদন্তের ক্ষেত্রে মূল যেসব বিষষগুলো জানার থাকে, এ ক্ষেত্রে তার প্রায় সবই বের করা হয়েছে। সন্দেহভাজন মূল আসামির নাম তারা জানতে পেরেছেন। তবে মিতু হত্যার এমন কিছু তথ্য এরই মধ্যে উঠে এসেছে, যা অত্যন্ত ‘স্পর্শকাতর’। যা মামলার তদন্তের শুরুতে সংশ্লিষ্টদের কল্পনারও বাইরে ছিল। তবে এসব তথ্য আলোর মুখ দেখবে কি-না এখনই বলা সম্ভব নয়।

মামলার তদন্তের সঙ্গে যুক্ত এক কর্মকর্তা বলেন, যারা মিতু হত্যাকাণ্ডে অংশ নেন, তারা ‘অতি আত্মবিশ্বাসী’ ছিলেন। এত সহজে তারা ধরা পড়বেন, এটা ভাবেননি। এমনকি হয়তো ‘প্রভাবশালী’ কেউ আশ্বস্ত করেছেন, তাদের কিছু হবে না। উগ্রপন্থি স্টাইলে হামলা চালালে তারা ধরা পড়বেন না। বিষয়টি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হবে। তবে বাস্তবে পরিকল্পনাকারীদের চিন্তার উল্টোটাই হয়েছে।

বাবুল আক্তারের শ্বশুর মোশাররফ হোসেন বলেন, জিজ্ঞাসাবাদের পর থেকে বাবুল বিমর্ষ। ডিবি কার্যালয় থেকে বাসায় ফেরার পর থেকে তার মাইগ্রেনের ব্যথাও বেড়েছে। তিনি এখনও স্বাভাবিক হননি। মানসিক যন্ত্রণায় ভুগছেন।

এখন পর্যন্ত পুলিশের তদন্তে পরিবার সন্তুষ্ট কি-না জানতে চাইলে তিনি বলেন, তদন্তাধীন বিষয়ে কিছু বলা সম্ভব নয়। পুলিশ তদন্ত করে দেখছে। দু’জন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন বলে গণমাধ্যম থেকে জেনেছি। কারা জড়িত, কীভাবে জড়িত তা এখনও জানা যায়নি।

মিতু খুনের নির্দেশদাতা মুছা: পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের সোর্স আবু মুছার পরিকল্পনা ও নির্দেশনাতেই খুন হন মিতু। ভাড়াটে খুনিদের ব্যবহার করে তাকে হত্যা করা হয়েছে। নির্বিঘ্নে অপারেশন চালাতে গোপন রাখা হয় মিতুর পরিচয়। খুনিদের কাছে ‘জঙ্গিনেত্রী’ হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয় মিতুকে। খুনের আগে ভাড়াটে ব্যক্তিদের নিয়ে পরিকল্পনা বৈঠকও করেন মুছা। তার পরিকল্পনা অনুযায়ী ৫ জুন ছেলেকে স্কুলে নেওয়ার পথে মুছা, ওয়াসিম ও নবী খুন করেন মিতুকে। প্রথমে মিতুকে সামনে ও পেছন থেকে এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাত করেন নবী। এর পর গুলি করে মৃত্যু নিশ্চিত করেন ওয়াসিম ও মুছা। খুনের সময় ঘটনাস্থলে রেকি করেন আনোয়ার। এ সময় ব্যাকআপ ফোর্স হিসেবে ঘটনাস্থলের আশপাশে ছিলেন রাশেদ, শাহজাহান ও কালু। আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি ও পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে ওয়াসিম ও আনোয়ার এসব তথ্য দিয়েছেন। গত রোববার রাতে ওয়াসিমের ১৪ পাতা ও আনোয়ারের ১০ পাতা জবানবন্দি রেকর্ড করেন চট্টগ্রাম মহানগর হাকিম হারুন-অর-রশিদ। তবে কার ছকে মিতুকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিলেন মুছা, তা স্পষ্ট হয়নি তাদের জবানবন্দিতে। অজানা থেকে গেল মিতুকে খুন করার কারণও।

জবানবন্দি প্রসঙ্গে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও নগর গোয়েন্দা পুলিশের সহকারী কমিশনার (উত্তর) মোহাম্মদ কামরুজ্জামান বলেন, ‘স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন দুই আসামি ওয়াসিম ও আনোয়ার। জবানবন্দি রেকর্ড শেষে তাদের কারাগারে পাঠিয়ে দেন আদালত। জবানবন্দির অনুলিপি হাতে পেলে এ মামলার পরবর্তী কার্যক্রম শুরু করা হবে।’

মিতুকে প্রথম ছুরিকাঘাত করেছেন নবী: আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে আসামি আনোয়ার হোসেন বলেছেন, বোরকা পরিহিত এক নারী (মিতু) বাসা থেকে বের হলে তাকে বাসার সামনে থেকে জিইসি মোড় পর্যন্ত অনুসরণের দায়িত্বে ছিলেন ওয়াসিম। গলি পেরিয়ে জিইসি মোড়সংলগ্ন মূল সড়কে ওঠার পরই মিতুর গতিরোধ করেন মুছা। তার সঙ্গে যোগ দেন ওয়াসিম ও নবী। আনোয়ার পুরো এলাকার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের দায়িত্বে ছিলেন। ওই নারী ‘ওয়েল ফুড’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের সামনে আসার সঙ্গে সঙ্গে মোটরসাইকেলে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়া হয়। মাটি থেকে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে ওয়াসিম ও মুছা তার শরীরে গুলি চালান। একই সঙ্গে প্রথমে সামনে ও পরে পেছনে ছুরিকাঘাত করেন নবী। তার মৃত্যু নিশ্চিত করে মুছা, নবী, ওয়াসিমসহ তিনজন মোটরসাইকেলে করে গোলপাহাড় দিয়ে চলে যান। জিইসি মোড় পেরিয়ে জামান হোটেলের সামনে থেকে সিএনজি করে বহদ্দারহাট দিয়ে বাকলিয়া চলে যান আনোয়ারসহ অন্যরা।

আটজনের অংশগ্রহণে খুন: আনোয়ার জবানবন্দিতে আরও বলেন, এ খুনের ঘটনায় পুলিশের সোর্স মুছা, ওয়াসিম, রাশেদ, নবী, কালু, শাহজাহান, তিনিসহ আটজন অংশ নেন। সোর্স মুছা খুন করার জন্য তাদের ভাড়া করেন। হত্যার একদিন আগে আনোয়ারকে ৫০০ টাকা এবং অপারেশনের দিন এক হাজার টাকা দেন মুছা। অপারেশন সফল হলে পরে আরও টাকা দেবেন বলে কথা দিয়েছিলেন তিনি। আনোয়ার বলেন, মুছা তার ‘বড় ভাই’ হওয়ায় হত্যাকাণ্ডে অংশ নিতে রাজি হন।

জবানবন্দিতে যা বলেছেন ওয়াসিম: ওয়াসিম ১৬৪ ধারার জবানবন্দিতে বলেন, ‘মিতুকে মোটরসাইকেলে ধাক্কা দেওয়ার পর আকাশের দিকে ফাঁকা গুলি করি। ঘটনার মূল হোতা মুছা মিতুর মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে গুলি করেন। নবী সামনে ও পেছনে ছুরিকাঘাত করে মৃত্যু নিশ্চিত করেন। আনোয়ার রেকির দায়িত্ব পালন করেন। আর সফলভাবে অপারেশনটি শেষ করতে ব্যাকআপ ফোর্স হিসেবে ঘটনাস্থলের চারপাশে ছিলেন কালু, শাহাজাহান ও রাশেদ। ওয়াসিম বলেন, মুছার নির্দেশেই আমরা এ হত্যাকাণ্ডে অংশ নিয়েছি। মুছাই আমাদের অস্ত্র সরবরাহ করেন। খুনে অংশ নেওয়ার জন্য তাকে পাঁচ হাজার টাকা দেওয়া হয়। খুন করার পর বাকলিয়ায় বাসায় গিয়ে টেলিভিশন দেখে একজন পুলিশ সুপারের স্ত্রীকে হত্যার বিষয়টি জানতে পারেন। এর পর মুছা ওয়াসিমকে বলেন, ‘চুপ করে থাক। আমি পুলিশের অনেক বড় সোর্স। এসব ঘটনা আমি খুব সহজেই সামলে নিতে পারব। তুই বাড়াবাড়ি করবি না। তাহলে তোকেও খেয়ে ফেলব।’

কে এই ওয়াসিম ও আনোয়ার: রাঙ্গুনিয়া উপজেলার রাজানগর গলাচিপা এলাকার আবদুল নবীর ছেলে মোতালেব ওরফে ওয়াসিম (২৭) এবং ফটিকছড়ি উপজেলার রাঙ্গামাটিয়া উপজেলার শামশুল আলমের ছেলে আনোয়ার হোসেন (২৮)। ওয়াসিমের বিরুদ্ধে দুটি হত্যা, অস্ত্র, ছিনতাই, ডাকাতিসহ রয়েছে এক ডজন মামলা। রাঙ্গুনিয়ার থানার তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসীও তিনি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *