মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’ জানিয়েছে, গত সাত বছরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে থাকাবস্থায় নির্যাতনে মারা গেছে ১০১ জন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায়মুক্তির সংস্কৃতি এবং ‘নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন’ বাস্তবায়ন না হওয়ায় নির্যাতন ও বিচারবহির্ভূত হত্যা বেড়েছে উল্লেখ করে সংগঠনের নেতৃবৃন্দ বলেছেন- রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থার দুর্বলতা একে আরো প্রকট করে তুলেছে। ‘নির্যাতিতদের সমর্থনে আন্তর্জাতিক সংহতি দিবস’ উপলক্ষে গতকাল রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে আলোচনা সভার আয়োজন করে অধিকার। অনুষ্ঠানে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন অধিকার-এর সম্পাদক আদিলুর রহমান খান। তিনি বলেন, আটকাবস্থায় নির্যাতন, বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুমসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধ এখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে সাধারণ ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। তিনি বলেন, ২০০৯ সাল থেকে ২০১৬ সালের মে মাস পর্যন্ত কমপক্ষে ১০১ জন মানুষ বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নির্যাতনে মারা গেছে। অধিকার সম্পাদক বলেন, নির্যাতনের বিষয়ে দীর্ঘদিন ধরে দায়মুক্তির সংস্কৃতি চালু থাকা এবং এটি বন্ধে ‘নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন-২০১৩’ বাস্তবায়ন না হওয়ায় আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হেফাজতে নির্যাতন ও অমানবিক ঘটনা বেড়ে চলেছে। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক সনদ অনুযায়ী কোনো ডিটেনশন সেন্টার, কারাগার বা হেফাজতে কোনো অজুহাতেই কাউকে নির্যাতন, নিষ্ঠুর, অমানবিক অথবা মর্যাদাহানিকর আচরণ করা ও শাস্তি দেয়া যাবে না। ১৯৯৮ সালের ৫ই অক্টোবর কনভেনশনের ১৪ (১) অনুচ্ছেদের উপর আপত্তি দিয়ে জাতিসংঘ প্রণীত নির্যাতনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সনদটি অনুমোদন করে বাংলাদেশ। কিন্তু নির্যাতনবিরোধী আইন পাস হলেও কনভেনশন বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কোনো বাধ্যবাধকতা অনুসরণ করা হচ্ছে না। ফলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে নির্যাতন এক ভীতিকর অবস্থার সৃষ্টি করেছে। আলোচনা সভায় মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নয়ন এবং নির্যাতন বন্ধে অবিলম্বে একটি স্বাধীন ও পৃথক তদন্তকারী প্রতিষ্ঠান গঠন, নির্যাতন বন্ধে দায়মুক্তির সংস্কৃতি বন্ধসহ আটটি সুপারিশ পেশ করেন অধিকারের নেতৃবৃন্দ।
এ সময় আলোচনায় অংশ নিয়ে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) সভাপতি আ স ম আবদুর রব বলেন, বাংলাদেশে এখন সবচেয়ে নৈরাজ্যকর অবস্থা বিরাজ করছে। হত্যা-খুন, অপহরণ, নির্যাতনের চারণভূমি এখন বাংলাদেশ। তিনি বলেন, খুন এখন সরকারি-বেসরকারি উৎসব। সন্ত্রাসীরা যদি একটি খুন করে সরকার করে ১০টা। রাষ্ট্র হত্যার প্রতিকার না করে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করে হত্যাকাণ্ডের প্রতি-উত্তর দেয়। সাম্প্রতিক গণগ্রেপ্তারকে ‘নাটক’ আখ্যায়িত করে আ স ম আবদুর রব বলেন, বাংলাদেশে জীবনের নিরাপত্তা ও আইনের শাসন এখন ধসে যাচ্ছে। সরকার সংবিধান ও আদালতের নির্দেশনা মানছে না। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনা উপেক্ষা করে সাঁড়াশি অভিযানের নামে সারা দেশে গ্রেপ্তার ও নির্যাতন চালাচ্ছে। সরকার শুধু দমন শক্তি ও বলপ্রয়োগ করে রাজনৈতিক সংকটের সমাধান চায়। ক্ষমতাকে প্রলম্বিত করতেই এ হীন কৌশলের আশ্রয় নিয়েছে সরকার। আলোচনায় অংশ নিয়ে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশে আইনের শাসন না শাসনের জন্য আইন- এটা বোঝা মুশকিল। সুরক্ষিত এলাকায় তনুর মতো মেয়ে ধর্ষিত ও তাকে হত্যা করা হয়। কিন্তু ঘাতকরা ধরা পড়ে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম এখন বড় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারও জীবনের নিরাপত্তা নেই। বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি সাইফুল হক বলেন, একটি ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে আমাদের বাস করতে হচ্ছে। সরকারে যারা মন্ত্রী আছেন তাদের উদ্দেশে বলবো, ক্ষমতায় থাকা মানে বেহেস্তে থাকা আর ক্ষমতায় না থাকা মানে দোজখে নিক্ষিপ্ত হওয়া। তাই চিন্তাভাবনা করে কাজ করবেন। তিনি বলেন, আমরা আশা করছি আমাদের সুপারিশগুলো বাস্তবায়িত হবে।
আলোচনা সভায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জালাল আহমেদ, মিরপুর বাঙলা কলেজের শিক্ষার্থী আকরাম আহমেদ তাদের ওপর পুলিশি নির্যাতনের বর্ণনা দেন। অধিকারের সভাপতি সি আর আবরারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় আরো বক্তব্য দেন বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) একাংশের সভাপতি শওকত মাহমুদ, আন্তর্জাতিক নির্যাতনবিরোধী সংস্থা-ওএমসিটির সাবেক মহাসচিব এরিক সটাস, আইন ও সালিশ কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক নূর খানম, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সম্পাদক ফায়জুল হাকিম প্রমুখ।