বৃটেনের ইউরোপীয় ইউনয়ন ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে নানা বিশ্লেষণ। এ নিয়ে ঘটনার ময়না তদন্ত হচ্ছে দিকে দিকে। তবে যা-ই হোক, বৃটেন ইউরোপীয় ইউনিয়ন ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন। আজ ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভবিষ্যত নিয়ে জরুরি বৈঠকে বসছেন এ সংগঠনের প্রতিষ্ঠাকালীন ৬ সদস্য দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা। কিন্তু কেন বৃটেন এমন সিদ্ধান্ত নিল? এমন প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছে বিবিসি। তাতে ৮টি কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে। সেগুলো এখানে তুলে ধরা হলো:
১. ব্রেক্সিটের নেতিবাচক অর্থনৈতিক প্রভাবে উল্টো ফল
ইইউ থেকে বেরিয়ে গেলে বৃটেনের মানুষ আরও গরীব হয়ে যাবে, প্রচারণা পর্বে এমন হুঁশিয়ারি মানুষ ক্রমাগত শুনেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হয় মানুষ তা বিশ্বাস করে নি অথবা মনে করেছে সেই ঝুঁকি নিতে তারা প্রস্তুত। বিশ্বের বড় বড় অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান আইএমএফ, ওইসিডি, বৃটিশ ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন সিবিআই, ব্যাংক অফ ইংল্যান্ড-এর শীর্ষস্থানীয় বিশেষজ্ঞরা হুঁশিয়ার করেছেন ইইউ ছাড়লে প্রবৃদ্ধি মুখ থুবড়ে পড়বে, বেকারত্ব বাড়বে, পাউন্ডের দরপতন হবে, দেশ মন্দায় ডুববে, ব্যবসায় লালবাতি জ্বলবে, কর বাড়বে, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, প্রতিরক্ষা খাতে বরাদ্দ কমবে। এমনকি এই হুঁশিয়ারিতে কন্ঠ মিলিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাও।
‘রিমেইন’ শিবিরের কেউ কেউ বলেছেন এই নেতিবাচক প্রচারণা ‘একটু বাড়াবাড়ি’ হয়ে গেছে। জনগণ হয় তাদের বিশ্বাস করে নি, নয়ত শাসক গোষ্ঠির বিরুদ্ধে এটা তাদের বিদ্রোহের পরিচয়।
২. স্বাস্থ্যসেবা খাতে ৩৫০ মিলিয়ন পাউন্ডের প্রতিশ্রুতি
‘লিভ ক্যাম্পেন’-এর সেøাগান ছিল ইইউ ছাড়লে সপ্তাহে ৩৫০ মিলিয়ন পাউন্ড খরচ বাঁচবে- যে অর্থ তারা বলেছে, এখন ইইউকে দিতে হচ্ছে। এই অর্থ স্বাস্থ্যসেবা খাতে বরাদ্দ করা যাবে। এমন আকর্ষণীয় সেøাগান সব বয়সের, সব রাজনৈতিক মতাদর্শের মানুষকে টেনেছে আর প্রচারণা বাসে এই সেøাগান ভোটারদের ইইউ ছাড়তে দারুণভাবে উদ্বুদ্ধ করেছে।
‘রিমেইন ক্যাম্প’ বারবার বলার চেষ্টা করেছে- এ পরিসংখ্যানের ভিত্তি ভুল। বাসের গা থেকে এই মিথ্যা তুলে নেওয়া হোক। সেটা তো হয়ই নি, উল্টে এই প্রচারণায় সব মানুষের মনে গেঁথে যাওয়া পরিসংখ্যানটি ছিল ৩৫০ মিলিয়ন।
৩. অভিবাসন ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নির্ধারণী বিষয়
ইইউ বিরোধী রাজনৈতিক দল হিসেবে পরিচিত ইউকিপ নেতা নাইজেল ফারাজ-এর অভিবাসন বিরোধী মন্তব্য এই প্রচারণায় ‘লিভ ক্যাম্প’-এর জন্য হয়ে উঠেছিল তুরুপের তাস। জাতীয় ও সাংস্কৃতিক পরিচিতি ও ঐতিহ্যের বিষয়টি বিশেষ করে নিম্ন আয়ের মানুষকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছে। গত ১০ বছরে বৃটেনে ব্যাপক সংখ্যায় অভিবাসী আসা নিয়ে উদ্বেগ, সামাজিক জীবনে তাদের প্রভাব, এবং অভিবাসন নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে আগামী বিশ বছরে কী হবে- এসব তুলে ধরে সফল প্রচার চালিয়েছে লিভ ক্যাম্প। এর ফলে ইইউ-তে থাকার বিপক্ষে একটা শক্ত জনমত গড়ে তুলতে তারা সফল হয়েছে।
অভিবাসনের বিরুদ্ধে প্রচারণায় ব্যবহার করা হয়েছে কঠিন ভাষা আর ছবি- এসব নিয়ে সমালোচনার ঝড় উঠলেও ভোটারদের ইইউ ছাড়ার ব্যাপারে মনস্থির করতে সাহায্য করেছে এইসব প্রচারণা।
৪. জনগণ প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যকে গুরুতত্ব দেয় নি
ডেভিড ক্যামেরন দুই মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী পদে জিতেছেন, একটা গণভোটেও জয়ের সাফল্য তিনি পেয়েছেন। কিন্তু এবারে ভাগ্য তার বিপক্ষে গেছে। রিমেইন ক্যাম্প-এ নেতৃত্ব দিয়ে এবং এর মধ্যমণি হয়ে তিনি তার রাজনৈতিক ভবিষ্যত ও ব্যক্তিগত সম্মানকে বাজি রেখেছিলেন। ইইউ-র সঙ্গে যুক্তরাজ্যের সম্পর্কে মৌলিক পরিবর্তন আনতে নয় মাস ধরে তিনি যে দেন-দরবার চালান, তা অসার বলে নাকচ করে দিয়েছিলেন তার দলেরই ইইউ বিরোধী সদস্যরা। ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকা বৃটেনের ভবিষ্যতের জন্য কেন সুফল বয়ে আনবে, প্রচারণায় তা তিনি বারবার জোরের সঙ্গে তুলে ধরলেও যেসব ভোটার সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছিলেন, তারা প্রধানমন্ত্রীর কথাকে শেষ পর্যন্ত আমল না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
৫. লেবার পার্টি ভোটারদের উদ্বুদ্ধ করতে ব্যর্থ হয়েছে
রিমেইন ক্যাম্প-এ যারা প্রচারণা চালাচ্ছিলেন তাদের জেতার জন্য অপরিহার্য ছিল লেবার সমর্থকদের পাশে পাওয়া। লেবার সমর্থকদের শতকরা ৯০ ভাগই ছিল ইইউতে থাকার পক্ষে। কিন্তু তাদের মধ্যে প্রচারণা চালানোর তেমন উদ্যোগ দেখা যায় নি। সাবেক প্রধানমন্ত্রী গর্ডন ব্রাউন, লন্ডনের মেয়র সাদিক খান, অ্যালান জনসনের মতো শীর্ষ লেবার নেতারা বৃটেনের ইইউতে থাকার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে কিছু প্রচারণা চালালেও লেবার পার্টির নেতা জেরেমি করবিন দলের সমর্থকদের যথেষ্ট উদ্বুদ্ধ করতে পারেন নি বলে কিছু মহল থেকে অভিযোগ তোলা হয়েছে।
৬. প্রচারণায় বরিস জনসন এবং মাইকেল গভের মতো ব্যক্তিত্ব
কনজারভেটিভ পার্টির কয়েকজন ক্যাবিনেট মন্ত্রী ব্রেক্সিট অর্থাৎ ইইউ থেকে বেরিয়ে যাবার পক্ষে, এটা সবাই জানতেন। কিন্তু দলের দুই বড় নেতা লন্ডনের সাবেক মেয়র বরিস জনসন এবং বিচারমন্ত্রী মাইকেল গভ এই ব্রেক্সিট শিবিরে যোগ দেওয়ায় লিভ ক্যাম্পেন নতুন মাত্রা পেয়েছিল। জনগণের কাছে মাইকেল গভ-এর আকর্ষণ ছিল বিচক্ষণ ও অভিজ্ঞ রাজনীতিক হিসাবে আর বরিস জনসন ছিলেন তারকা রাজনীতিক।
৭. বয়স্ক মানুষরা বেশি ভোট দিয়েছেন
বিশেষজ্ঞরা বলছেন বয়স্ক মানুষদের ভোট লিভ ক্যাম্পেনকে জয়যুক্ত করতে সাহায্য করেছে – বিশেষ করে দক্ষিণ, দক্ষিণ-পশ্চিম, মিডল্যান্ডস এবং উত্তর পূর্ব ইংল্যান্ডে। এমনিতেই বয়স্ক মানুষের মধ্যে ভোট দেবার প্রবণতা বেশি দেখা যায়। কিন্তু এই গণভোটে দেখা গেছে ৫৫ বছরের বেশি বয়স্কদের মধ্যেই ব্রেক্সিট সমর্থকের সংখ্যা বেশি। ৬৫ উর্ধ্ব ভোটারদের প্রতি ৫ জনের ৩ জনই বলেছেন তারা ইইউ-তে থাকার বিপক্ষে।
৮. ইউরোপ বৃটেনের মানুষের কাছে সবসময়ই ছিল বিদেশ
ইউরোপের সঙ্গে যুক্তরাজ্যের সম্পর্ক কখনই সহজ ছিল না। ইউরোপীয় কমিউনিটিতে যোগ দিতেও বৃটেন অনেক বছর সময় নিয়েছিল। ১৯৭৫ সালে যখন এ নিয়ে গণভোট হয়েছিল তখনও অনেকেই এটাকে সমর্থন জানিয়েছিল কিছুটা প্রতিবাদের সঙ্গে এবং শুধুমাত্র অর্থনৈতিক লাভের আশায়। বলা হচ্ছে তরুণ প্রজন্ম ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকার পক্ষে। তবে ভোটের ফল যতক্ষণ না পূর্ণাঙ্গভাবে বিশ্লেষণ করা যাবে ততক্ষণ বোঝা যাবে না কত শতাংশ বয়স্ক আর কত শতাংশ তরুণ পক্ষে বা বিপক্ষে ভোট দিয়েছে।