ভারতীয় ঋণে ছয় বছর আগে রেলওয়ের কুলাউড়া থেকে শাহবাজপুর সেকশন পুনর্বাসন প্রকল্প নেয় রেলপথ মন্ত্রণালয়। চলতি অর্থবছরের মার্চ পর্যন্ত প্রকল্পটির বিপরীতে এক টাকাও ব্যয় হয়নি। ৬৭৮ কোটি ৫১ লাখ টাকা ব্যয়ের এ প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়েছে। আবারও দুই বছর মেয়াদ বাড়িয়ে ২০১৭ সালের জুনের মধ্যে শেষ করার নতুন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু এ সময়ের মধ্যেও এ প্রকল্প বাস্তবায়ন অনিশ্চিত বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
শুধু এ প্রকল্প নয়, ভারতের প্রথম ঋণের আওতায় ২০১০ সালে নেওয়া ১৪টি প্রকল্পের মধ্যে ৭ প্রকল্পে স্থবিরতা বিরাজ করছে। মোট ৮৬ কোটি ২০ লাখ ডলারের মধ্যে ছাড় হয়েছে মাত্র সাড়ে ২৮ কোটি ডলার। এ হিসাবে দুই-তৃতীয়াংশ অর্থ এখনও ছাড় হয়নি। এ পরিপ্রেক্ষিতে প্রত্যেকটি প্রকল্প পর্যালোচনার জন্য দুই দেশের উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে আজ বুধবার। এ বৈঠকে দ্বিতীয় এলওসির ২০০ কোটি ডলারের প্রকল্পের অবস্থাও পর্যালোচনা করা হবে।
রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের এনইসি সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠেয় এ বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষে নেতৃত্ব দেবেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) যুগ্ম সচিব (এশিয়া) জাহাঙ্গীর আলম। ভারতীয় প্রতিনিধি দলের পক্ষে থাকছেন দেশটির যুগ্ম সচিব (উন্নয়ন অংশীদারিত্ব) অজিত বিনায়েক গুপ্ত। এ ছাড়া পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, ভারতীয় হাইকমিশন এবং প্রকল্প পরিচালকরা এ বৈঠকে উপস্থিত থাকবেন।
২০১০ সালে ভারত প্রথম
দফায় ১০০ কোটি ডলার ঋণ দেয় বাংলাদেশকে। তৎকালীন ভারতীয় অর্থমন্ত্রী বর্তমান রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি ওই ঋণের ২০ কোটি ডলার পরে অনুদান হিসেবে ঘোষণা করেন। এ ঋণের আওতায় ১৪টি প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। এসব প্রকল্পের ৬৫ শতাংশের বেশি পণ্য ও সেবা ভারত থেকে নেওয়ার শর্ত রয়েছে। ঋণের সুদ ধরা হয়েছে ২ শতাংশ। গত বছর জুনে ঢাকা সফরকালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আরও ২০০ কোটি ডলার ঋণ দেওয়ার ঘোষণা দেন।
ইআরডি এশিয়া উইংয়ের এক কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, দুটি কারণে ভারতীয় ঋণের প্রকল্পে খারাপ অবস্থা। প্রথমত, ঋণের চুক্তি হওয়ার পর প্রকল্পগুলো চিহ্নিত করা হয়। এ কারণে উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) তৈরি করে অনুমোদন নিতে দেরি হয়ে যায়। আবার অধিকাংশ প্রকল্প রেলপথ মন্ত্রণালয়ের। এ খাতের উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে অদক্ষতা রয়েছে। প্রতি বছরই বড় অঙ্কের অর্থ ফেরত দেওয়া হয়। এর ওপর প্রতিটি ক্ষেত্রে ভারতের অনুমোদন লাগে। আবার ভারতীয় পণ্য ও সেবা ৬৫ থেকে ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত আমদানির শর্ত রয়েছে। ফলে এ প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে ব্যাপক সমস্যা হচ্ছে।
ভারতীয় প্রথম ১০০ কোটি ডলার ঋণের ১৪টি প্রকল্পের মধ্যে বেশিরভাগই রেলওয়ের। ২০১০ সালে শুরু হওয়া রেলওয়ের জন্য ২৬৪টি এমজি কোচ ও দুটি বিজি ইন্সপেকশন কার সংগ্রহ প্রকল্পের ১ শতাংশও বাস্তবায়ন হয়নি। ৪০ কোটি টাকা ব্যয়ের আশুগঞ্জ-আখাউড়া সেকশনের তিনটি স্টেশনের সিগন্যালিং ও ইন্টারলকিং ব্যবস্থার প্রতিস্থাপন ও আধুনিকায়ন প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে মাত্র ২ কোটি টাকা। অথচ প্রকল্পটির মেয়াদ শেষ হচ্ছে চলতি মাসেই।
গত সাত বছরে খুলনা থেকে মংলা বন্দর পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে ১১শ’ কোটি টাকা। প্রকল্প পরিচালক মজিবুর রহমান সমকালকে বলেন, জমি অধিগ্রহণে দেরি হয়েছে। এখনও জমি হস্তান্তর হয়নি। পাশাপাশি পরামর্শক নিয়োগেও ব্যাপক জটিলতা ছিল। তিনি বলেন, অনুমোদনেও কিছুটা সময় লাগে। একবার চিঠি দিয়ে অনুমোদন পেতে দুই মাস লেগে যায়।
রেলওয়ের সংযোগ সড়কসহ দ্বিতীয় ভৈরব এবং দ্বিতীয় তিতাস সেতু নির্মাণ প্রকল্প শুরু হয় ২০১০ সালে। ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে কাজ শেষ করার লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও ৯৫৯ কোটি টাকা ব্যয়ের এ প্রকল্পে অর্ধেক অর্থও ব্যয় হয়নি। এ প্রকল্পের পরিচালক আব্দুল হাই সমকালকে বলেন, একনেকে অনুমোদনের চার বছর পর অর্থ পাওয়া গেছে। এরপর ৩০ মাস সময় বেঁধে দেওয়া হয়। লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী কাজ শেষ করার চেষ্টা চলছে বলে তিনি জানান।
১২০টি ব্রডগেজ যাত্রীবাহী ক্যারেজ সংগ্রহ প্রকল্প ২০১৪ সালের জুলাইয়ে শুরু হয়। ৯৭৬ কোটি টাকা ব্যয়ের প্রকল্পটি দুই-তৃতীয়াংশ অর্থ এখনও ব্যয় হয়নি। অথচ প্রকল্পটি শেষ হতে আর এক বছর বাকি। এ ছাড়া ভারতীয় অর্থায়নে বাস্তবায়নাধীন আশুগঞ্জ নৌবন্দরে অভ্যন্তরীণ কনটেইনার টার্মিনাল স্থাপন প্রকল্পের অবস্থাও ভালো নয়। ২০১১ সালের জানুয়ারিতে শুরু হওয়া প্রকল্পটির সর্বশেষ হিসাব পর্যন্ত ব্যয় মাত্র ৪ লাখ টাকা। যদিও ইতিমধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে নৌ ট্রানজিট শুরু হয়েছে। ভারতীয় পণ্যের প্রথম চালান ইতিমধ্যে এই আশুগঞ্জ বন্দরে খালাস হয়েছে। কিন্তু কবে নাগাদ এখানে কনটেইনার টার্মিনাল স্থাপন হবে তা কেউ বলতে পারছেন না।
জানতে চাইলে রেলপথমন্ত্রী মুজিবুল হক সমকালকে বলেন, ভারতীয় ঋণের কয়েকটি প্রকল্প ভালোভাবে বাস্তবায়ন শেষ হয়েছে। বাকিগুলো দ্রুত বাস্তবায়নের চেষ্টা চলছে। প্রকল্প বাস্তবায়নকারী কর্মকর্তাদের কঠোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যাতে দ্রুত কাজ শেষ করে। এসব প্রকল্প যথাসময়ে বাস্তবায়ন হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব ফিরোজ সালাহ উদ্দিন সমকালকে বলেন, ঠিকারদারদের গাফিলতি, আনুষঙ্গিক কার্যক্রম শেষ করাসহ নানা কারণে কিছু প্রকল্প বাস্তবায়নে কিছুটা সময় লাগছে। তবে এসব প্রকল্পের সমস্যা অনেকটা কেটে গেছে। এখন বাস্তবায়নে সর্বোচ্চ নজর দেওয়া হচ্ছে। বিশেষ করে খুলনা থেকে মংলা রেলপথ নির্মাণ এবং দ্বিতীয় ভৈরব এবং দ্বিতীয় তিতাস সেতু নির্মাণ প্রকল্পটি নতুন অর্থবছরে বড় অঙ্কের অর্থ ব্যয় হবে। ফলে আগামী অর্থবছরে ভারতীয় ঋণের সব প্রকল্পে ব্যাপক দৃশ্যমান অগ্রগতি পাওয়া যাবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
যে প্রকল্পগুলো শেষ হয়েছে, সেগুলো হলো ২৮০টি ডাবল ডেকার ও ৮৮ এসি এবং ৫০টি আর্টিকুলেটেড বাস ক্রয়, রেলের ১০টি মিটারগেজ, ১৬টি ব্রডগেজ, ১২০টি তেলবাহী ব্রডগেজ ট্যাঙ্কার, ১৬০টি মিটার গেজ ট্যাঙ্কার, পণ্যবাহী ১২০ ব্রডগেজ ওয়াগন এবং ৫০টি মিটারগেজ ওয়াগন ক্রয় প্রকল্প।
অনিয়ম-দুর্নীতি :ভারতীয় ঋণের আওতায় বাস্তবায়নাধীন দুটি প্রকল্পে অনিয়ম ও দুর্নীতি পেয়েছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ এবং মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি)। এর মধ্যে দ্বিতীয় ভৈরব এবং দ্বিতীয় তিতাস রেল সেতু নির্মাণে ব্যাপক নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার করার প্রমাণ পেয়েছে সরকারি এ সংস্থাটি। তাদের পরিদর্শন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পুরু পাতের জায়গায় পাতলা এবং ভঙ্গুর পাত ব্যবহার করা হয়েছে। যে বালু ব্যবহার করা হয়েছে তাতে পলির পরিমাণ বেশি। রিটেইনিং ওয়ালের হানিকম্ব এবং এক্সপেনশন জয়েন্টগুলোতে ব্যাপক ত্রুটি রয়েছে। স্টিল শার্টারের জায়গায় কাঠের শার্টার ব্যবহার করা হয়েছে।
আইএমইডির আরেক সরেজমিন পরিদর্শন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ডাবল ডেকার, সিঙ্গেল ডেকার এসি এবং আর্টিকুলেটেড বাস ক্রয় শীর্ষক প্রকল্পেও অনিয়ম পাওয়া গেছে। ভারতীয় ঋণের অর্থে প্রকল্পটির আওতায় অশোক লেল্যান্ড লিমিটেডের কাছ থেকে ৫১ কোটি টাকা ব্যয়ে ৮৮ এসি বাস এবং ৪৯ কোটি টাকায় ৫০টি আর্টিকুলেটেড বাস কেনা হয়। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান আয়ুস্কাল ১২ বছর বললেও দুই বছরের মাথায় জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে বাসগুলো।