বাংলাদেশ কি আইসিসের পরবর্তী প্রাণকেন্দ্র হয়ে উঠছে?

Slider সারাবিশ্ব

19605_Cnn

 

বাংলাদেশে অনেকগুলো বিষয় আছে। এর অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। যুব সমাজ সমৃদ্ধ জনসংখ্যার এ দেশে রয়েছে গণতন্ত্র। আশীর্বাদ হিসেবে আছে উর্বর জমি। এ দেশটিতে প্রায় ১৫ কোটি মুসলিম। সাম্প্রতিক সময়ের পূর্ব পর্যন্ত এটি ছিল উগ্রপন্থার বাইরে। উগ্রপন্থা বাকি বিশ্বে মহামারী হিসেবে দেখা দিয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে এক্ষেত্রেও বাংলাদেশে অশুভ ইঙ্গিত মিলিছে। এখানেও পরিস্থিতি পরিবর্তন হচ্ছে।
দু’বছরেরও বেশি সময় ধরে ক্রমবর্ধমান নৃশংস হত্যাকা- দক্ষিণ এশিয়ার এ দেশটিকে নাড়িয়ে দিয়েছে। প্রথম দিকে হত্যাকা-গুলোর একটি পরিষ্কার ধরণ ছিল। সে সময় রাজধানী ঢাকায় সুপরিচিত ধর্মনিরপেক্ষ লেখকদের টার্গেট করা হয়। ওই হামলাগুলো দৃশ্যত ইসলামের সমালোচকদের কণ্ঠ স্তব্ধ করে দেয়ার জন্য করা হয়েছিল। এসব হত্যাকা-ের মধ্যে সবচেয়ে হাই প্রোফাইল হত্যার শিকার হন ২০১৪ সালে বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত এক মার্কিন লেখক অভিজিৎ রায়। তাকে ঢাকায় অমর একুশে গ্রন্থমেলার বাইরে হত্যা করা হয়। এরপর এ বছর এপ্রিলে নিজের বাসায় হত্যা করা হয় একজন সুপরিচিত এলজিবিটি অধিকারকর্মী ও তার বন্ধুকে।
সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে এ হামলা সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। ঘন ঘন এমন হামলা হচ্ছে। এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর থেকে শুরু করে হিন্দু, খিস্ট্রান, বৌদ্ধ, এমনকি সুফি মুসলিমদের নির্বাচিতদের টার্গেট করা হয়েছে। এ যাবত এমন হত্যার ঘটনা ৪০।
আইসিসের হাত?
নৃশংস ও মধ্যযুগীয় এসব হত্যায় একটি সম্পর্ক আছে। তাহলো চাপাতি দিয়ে হত্যা। কিন্তু প্রশ্ন হলো এসব হত্যাকা-ের মূল হোতা কে? নিজস্ব মিডিয়ার মাধ্যমে এসব হত্যাকা-ের অনেকগুলোর দায় স্বীকার করেছে তথাকথিত ইসলামিক স্টেট (আইসিস)। কিন্তু অব্যাহতভাবে দেশে কোন আইসিসের উপস্থিতি নেই বলে দাবি করে যাচ্ছে বাংলাদেশ সরকার। অন্য হামলাগুলোর দায় স্বীকার করেছে স্থানীয় ইসলামপন্থি গ্রুপগুলো। পুলিশ বলেছে, এসব হামলার বেশির ভাগের জন্য দায়ী ইসলামি নিষিদ্ধ ঘোষিত গ্রুপ জামায়াতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ বা জেএমপির সদস্যরা। এমন দাবির পক্ষে সুস্পষ্ট সর্বসম্মতি মেলে নি। এমনকি এ অঞ্চলের সন্ত্রাস বিষয়ে যেসব বিশেষজ্ঞ বিশ্লেষণ করেন তাদের কাছ থেকেও এ দাবির সত্যতা মেলে নি। সাউথ এশিয়া টেরোরিজম পোর্টালের নির্বাহী পরিচালক অজয় সাহনি বলেছেন, প্রকাশ্য স্থানে কাউকে হত্যা করতে যাবে না আইসিস। আইসিস সংশ্লিষ্ট মিডিয়া হয়তো কিছু হামলার দায় স্বীকার করতে পারে এ জন্য যে, তারা তাদের গ্রুপকে বড় করে দেখাতে চায়। তারা বিশ্বব্যাপী তাদের বিস্তার চায়। কিন্তু যদি আইসিস এসব হামলায় জড়িত হতো তাহলে তাদের আসল অস্ত্র কোথায়? তাদের প্রশিক্ষিত ও যুদ্ধ-মনোভাবাপন্ন যোদ্ধারা কোথায়?
কিন্তু এশিয়া-প্যাসিফিক ফাউন্ডেশনের সন্ত্রাস বিষয়ক বিশেষজ্ঞ সাজ্জান গোহেল বলেছেন, জেএমবিকে এখন আইসিসের ঘনিষ্ঠ হিসেবে দেখা যেতে পারে। তিনি বলেন, জেএমপি বিদেশী, প্রফেসর ও শিক্ষাবিদদের টার্গেট করেছে। অন্যদিকে স্থানীয় সন্ত্রাসী গ্রুপ আনসারুল বাংলা টিম বা এবিটি বেশির ভাগই টার্গেট করেছে ব্লগার ও নাস্তিকদের। গোহেল আনসারুল বাংলা টিমকে দেখছেন সম্প্রতি চালু হওয়া আল কায়েদা ইন দ্য ইন্ডিয়ান সাব কন্টিনেন্ট (একিউআইএস)-এর ঘনিষ্ঠ হিসেবে।
যদি গোহেল সঠিক হন তাহলে আইসিস এবং আল কায়েদার মধ্যে প্রক্সি যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হতে পারে বাংলাদেশ অথবা এরই মধ্যে তা হয়ে গেছে। তাদের উদ্দেশ্য পরিষ্কার। তারা বিশ্বের চতুর্থ বৃহৎ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে তাদের অবস্থান পোক্ত করতে চায়। এ দেশটির সঙ্গে ভারতের বিশাল একটি সীমান্ত রয়েছে।
পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। সাজ্জান গোহেল সম্প্রতি আইসিসের অনলাইন প্রচারণামুলক ম্যাগাজিন দাবিক’কে ক্লু হিসেবে তুলে ধরেন। তিনি বলেন, বিশেষ করে আইসিস এতে বলেছে, তারা বাংলাদেশে আরও হাই প্রোফাইল হামলা চালাতে চায়। এর পরের ধারাটি হতে পারে আরও বৃহৎ ও আইসিসের দিক থেকে ভাল। গোহেল বলেন, বাংলাদেশ সরকার পুরোপুরি অস্বীকার করার অবস্থানে রয়েছে।
চাপাতি কেন?
সাজ্জান গোহেল বলেন, ছুরিকাঘাত ও কুপিয়ে হত্যা নতুন কিছু নয়। সুনির্দিষ্ট কিছু পরিমাপকে বাংলাদেশে আছে নিম্ন মানের সহিংসতার রাজনৈতিক সংস্কৃতি। কিন্তু এখন তা আরও বৃহৎ আকার ধারণ করেছে। ঠিকভাবে হোক বা ভুলভাবে হোক এতে আইসিসের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে।
হামলা যত ছোটই হোক তার পরিণাম আছে।
সাজ্জান গোহেল বলেন, সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর জন্য যেকোন হামলার একটি মূল আছে। প্রচারণায় এটাই তাদের কাছে অক্সিজেনের মতো। এটাই তাদেরকে শক্তি যোগায়। সিএনএনের সন্ত্রাস বিশ্লেষক পিটার বারগেনের মতে, তালেবানের সাবেক সদস্যরা নিজেদেরকে আইসিস হিসেবে চিহ্নিত করে, যদিও আইসিসের সঙ্গে তাদের বাস্তব কোন সম্পর্ক নেই। আইসিস সম্পর্ক তাদেরকে বড় একটি পরিচয় দেয়।
রাজনীতি ও অঙ্গুলি নির্দেশনা
যদি আপনি সরকারকে জিজ্ঞেস করেন তাহলে এসব হত্যাকা-ের পিছনে পরিষ্কার উদ্দেশ্য আছে এবং এগুলো অপরাধীরা করেছে বলে বক্তব্য মিলবে। গত মাসে সিএনএসের সঙ্গে কথা বলেছেন বাংলাদেশের তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু। এ সময় তিনি খোলামেলাভাবে আঙ্গুল তোলেন বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ও তার মিত্র জামায়াতে ইসলামীর দিকে। কিন্তু এ মাসের শুরুর দিকে তিনি যখন আবার সিএনএনের সঙ্গে কথা বলেন, তখন তিনি তার অভিযোগ নিয়ে যান একটি ছবির উপমার কাছে। চলমান হামলার মূলহোতা কারা এমন এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছেন, উত্তর খুবই সাধারন। এর প্রযোজক হলো বিএনপি। পরিচালক জামায়াতে ইসলামী। মাঠপর্যায়ে ছোট ছোট অভিনেতা হলো আনসারুল বাংলা টিম, জেএমবি ও ইসলামপন্থি অন্যান্য নেটওয়ার্ক। আইসিস এসব হামলার দায় স্বীকারের কথাকে তিনি মিথ্যা ও কল্পিত বলে উল্লেখ করেন। উল্টো তিনি অভিযোগ করেন, বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করতে এসব করছে বিরোধী দল বিএনপি। তবে বিএনপির মুখপাত্র এ অভিযোগ সম্পূর্ণত অস্বীকার করেছেন। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভি বলেছেন, আমরা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও আদর্শ সম্পন্ন একটি রাজনৈতিক দল। সরকারের প্রধান লক্ষ্য হলো বিএনপিকে নিঃশ্বেষ করা। তারা (সরকার) চায় বাংলাদেশে একদলীয় রাজনৈতিক কাঠামো প্রতিষ্ঠা করতে।
দৃশ্যত বিএনপিকে ধ্বংস করা যাবে না।
রিজভির হিসাব অনুযায়ী হত্যাকা- বন্ধের নামে সরকার যে অভিযান চালিয়েছে তাতে জুনে বিএনপির ২৭ শতাধিক নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সব মিলেয়ে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ১৪ হাজারেরও বেশি। বিশেষজ্ঞরা বলেন, এর মধ্যে মাত্র দু’একশ জঙ্গি। গত সপ্তাহে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এসব গ্রেপ্তারকে খেয়ালখুশি মতো বলে আখ্যায়িত করেছে এবং বলেছে, অপরাধের যথাযথ প্রমাণ ছাড়া এসব গ্রেপ্তার করা হয়েছে। হিউম্যান রাইট ওয়াচের তেজশ্রী থাপা বলেছেন, আপনি মাত্র ৫ দিনের মধ্যে ১৪০০০ মানুষকে গ্রেপ্তার করতে পারেন না। এই গ্রেপ্তারকে বৈধও বলতে পারেন না। তিনি আরও বলেছেন, কেন তাদেরকে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজির করা হয় নি? কেন তাদেরকে রিমান্ডে নেয়া হয় নি? বিএনপির অনেক শীর্ষ নেতা দেশ ছেড়েছেন। তারা ভীতসন্ত্রস্ত।
দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব
বাংলাদেশ নিয়ে যারা পর্যবেক্ষণ করেন তারা শুধু ব্যাপকভাবে ক্ষমতার অপব্যবহার নিয়েই উদ্বিগ্ন নন। একই সঙ্গে তারা দুর্বল হয়ে পড়া বিরোধী দলের প্রভাব নিয়েও শঙ্কিত। বাংলাদেশে ১৯৯০ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ছিলেন উইলিয়াম বি মাইলাম। তিনি সম্প্রতি ঢাকা সফর করে ফিরে গেছেন। তিনি বলেছেন, বিএনপি পুরোপুরি বিশৃংখল হয়ে পড়েছে। তারা নিজেদেরকে নির্দোষ ও সরকারকে দায়ী করেই তাদের সময় পাড় করছে। দুর্বল হয়ে পড়া বিরোধী দল দৃশ্যত একদলীয় ব্যবস্থার দিকে ধাবিত হওয়ার পথে অবদান রাখছে।
দুর্নীতি, গত বছর বিক্ষোভের সময় বাসে পেট্রোল বোমা হামলার ষড়যন্ত্রে জড়িত থাকার মতো অভিযোগের মোকাবিলা করছেন বিএনপি নেত্রী ও দু’বারের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। তবে খালেদা জিয়ার দাবি, তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যমুলকভাবে। বাংলাদেশে পরবর্তী জাতীয় নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে ২০১৯ সালে। উইলিয়াম বি মাইলাম বলেছেন, যা ঘটছে তা বাস্তবেই বিষাদময়। কোন কারণ ছাড়াই মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে।

রবি আগরওয়াল সিএনএনের নয়া দিল্লি ব্যুরো প্রধান।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *