শঙ্খ নদীতে রিভার সাফারি

Slider কৃষি, পরিবেশ ও প্রকৃতি

cruise
মো. মনির হোসেন# ‘শঙ্খ’ নদী, আরেক নামে যাকে ডাকা হয় ‘সাঙ্গু’ বলে। তবে মারমা আদিবাসীরা একে ‘রিগ্রাই খিয়াং’ বা ‘স্বচ্ছ নদী’ নামে আদিকাল থেকে ডেকে আসছে। উৎপত্তিস্থল থেকে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত নদীটির দৈর্ঘ্য প্রায় ১৭০ কিলোমিটার।

সকাল ৭টা। বান্দরবান পুরোপুরি জেগে ওঠেনি। আমরা উঠে বসলাম বাজার ব্রিজের নিচে নোঙ্গর করে রাখা ফ্লোরা ক্রুজ রেস্টুরেন্টে। আধুনিক সুযোগ সুবিধা সম্পন্ন একটি বোট, শীততাপ নিয়ন্ত্রিত। খাবার রান্না করারও সু-ব্যবস্থা আছে।এবারের যাত্রার উদ্দেশ্য বান্দরবান শহর থেকে নদীপথেই রুমা যাওয়ার ।সেই লক্ষ্যেই রুমার উদ্দেশে নদী পরিব্রাজক দলের যাত্রা শুরু। লক্ষ্য একটাই, ঘুরে ঘুরে নদী দেখা। একটি বাঁক পেরিয়ে আরেকটি মানেই নতুন করে সৌন্দর্য্যরে সংজ্ঞা খোঁজা। মনে হবে যেন নদীর গতিপথ এখানেই শেষ তবে সেটি নিছক মরীচিকা। আরেকটি বাঁক নিয়ে যাবে নিরুদ্দেশের দিকে।

এটিই ‘শঙ্খ’ নদী, আরেক নামে যাকে ডাকা হয় ‘সাঙ্গু’ বলে। তবে মারমা আদিবাসীরা একে ‘রিগ্রাই খিয়াং’ বা ‘স্বচ্ছ নদী’ নামে আদিকাল থেকে ডেকে আসছে। বাংলাদেশের বেশির ভাগ নদ-নদী উত্তর থেকে দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে মিশেছে। কিন্তু শঙ্খ বান্দরবানের দক্ষিণাঞ্চলে সৃষ্টি হয়ে উত্তর দিকে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে শেষ হয়েছে। মিয়ানমার সীমান্তবর্তী বাংলাদেশের বান্দরবানের মদক এলাকার পাহাড়ে এ নদীর জন্ম। উৎপত্তিস্থল থেকে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত নদীটির দৈর্ঘ্য প্রায় ১৭০ কিলোমিটার। এটি চট্টগ্রাম বিভাগের দ্বিতীয় বৃহত্তম নদী। নদীর দুই পাড়ে বসবাসকারী প্রায় ৯০ শতাংশই মারমা নৃগোষ্ঠী। তাদের জীবন-জীবিকার সঙ্গে শঙ্খ নদী ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

আমাদের নৌকা চলছে ধীরে ধীরে। নদীতে পানি কম। নদীর দুই পাড়ে জুম চাষে ব্যস্ত চাষীরা। জুম চাষের কারণে নদীর পাড় দুটো সবুজে মোড়ানো কার্পেটের মতোই মনে হয়। যেতে যেতে দেখা গেল একটি বাজার। তাই উঠে গেলাম বাজারটিতে। বাজারটির নাম বেতছড়া। বাজারটির পাশেই সেনাবাহিনীর একটি চেকপোস্ট। নৌপথে বান্দরবান থেকে রুমা যেতে এ চেকপোস্টে নাম নিবন্ধন করতে হয়। তার একটু দূরেই দেখা গেল একটি ছড়া। ঢুকে পড়লাম সেখানে। স্থানীয় আদিবাসীদের কাছ থেকে জানতে পারলাম ছড়াটির নাম কেউচ্যারাং ছড়া। আশ্চর্য হওয়ার মতো বিষয় হচ্ছে, ছড়াটির কোনো কোনো অংশে পানির গভীরতা ১০-১২ ফুট। অসংখ্য ছোট-বড় ঝরনা থেকে সৃষ্টি হওয়া পাহাড়ি নদী বা ছড়া মিশেছে শঙ্খ নদীতে। এগুলোর মধ্যে পাইন ছড়া, সুয়ালক ছড়া এবং বান্দরবান-চন্দনাইশ সীমান্তের দুপাছড়ি ছড়া, রোয়াংছড়ি উপজেলার ঘেরাও ছড়া, পালং ছড়া, বেতছড়া, তারাছা ছড়া, কেউক্যাচাং ছড়া, চেমাছড়া, পানতলা ছড়া, রুমা খাল, ক্যারাং ছড়া, খুনিম ছড়া অন্যতম।

এর পর আবার নদীতে। ততক্ষণে প্রায় দুপুর। আমরাপৌছেগেলাম রুমা বাজারে। আমাদের চোখে শঙ্খ নদী হচ্ছে মৎস্যসম্পদ, কৃষি, যোগাযোগ, অর্থনীতি, পর্যটন ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব সব মিলিয়ে একটি সমৃদ্ধ উপন্যাস, যার প্রতিটি বাঁক একেকটি অধ্যায়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ যেখানে কোটি কোটি ডলার খরচ করে রিভার সাফারির ব্যবস্থা করে, সেখানে আমাদের শঙ্খ নদী প্রাকৃতিকভাবেই রিভার সাফারির জন্য প্রস্তুত। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের একটু আদুরে ছোঁয়ায় শঙ্খ হতে পারে নদী ও প্রকৃতি পর্যবেক্ষণের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। আকৃষ্ট করতে পারে দেশী-বিদেশী পর্যটক। সরকারি কোষাগার ভরে যেতে পারে শঙ্খের রাজস্বে।

বোটেই দুপুরের খাবার খেলাম আমরা। তারপরছোটবোট নিয়ে রওয়ানা করলাম রিজুক ঝর্ণা অভিমুখে। নৌকা চলছে এঁকেবেঁকে নদীর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। নদীটির সৌন্দর্য খুবই ধাঁধা লাগানো। নদীর একটি বাঁক পেরিয়ে আরেকটি বাঁকে যাওয়া মানে নতুন রূপের ঝলকানি। পাহাড়, বন আর ঝরনাধারায় এ নদী মনের গভীরে অন্য রকম ভালো লাগা তৈরি করে। হৃদয় নেচে ওঠে অজানা সুখে। দুঃখ, কষ্ট নিরুদ্দেশ হয়ে মন চলে যায় যেন স্বর্গরাজ্যে। নদীর একটি বাঁক থেকে ঠিক সামনের দিকে তাকালে মনে হয় নদীটি শেষ হয়ে গেছে; কিন্তু তা নয়। পৌঁছার পর দেখা যায়, ঠিক ওখান থেকে আরেকটি বাঁকের সৃষ্টি। মনে হবে, পাহাড়ের খাঁজ কেটে কেটে নদীটি কৃত্রিমভাবে তৈরি করা হয়েছে।নৌকা চলছে আর দুই পাড়ের নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখে আমরা মুগ্ধ হচ্ছি।

৩০-৪০ মিনিট নৌকা চলার পর হঠাৎ কানে আসছে শোঁ শোঁ শব্দ। আমাদের গাইড নুরু মিয়া দেখালেন, ওই যে রিজুক ছড়া। দূর থেকে জলপ্রপাতের পানি নীল মনে হচ্ছে। কাছে এসে রিজুক জলপ্রপাতের মায়ায় মজে গেলাম। জলের ঝাপটা প্রায় ২০০ ফুট এলাকা পর্যন্ত এদিক-ওদিক বিস্তৃত হচ্ছে। মনে হচ্ছে, ঝিরিঝিরি বৃষ্টির মধ্যে আমরা অবস্থান করছি। প্রায় ৩০০ ফুট উঁচু থেকে ঝরে পড়া জলপ্রপাতের রিমঝিম সুরের মূর্ছনা আপনাকে নিয়ে যাবে অন্য এক জগতে।
যেভাবে যাবেন

ঢাকার ফকিরাপুল বা আরামবাগ থেকে শ্যামলী, মামুন, ডলফিন ও হানিফ পরিবহনে বান্দরবান যেতে পারবেন। ভাড়া ননএসি ৬২০ টাকা, এসি ৯০০ টাকা। বাসস্ট্যান্ড থেকে অটোতে ক্যাচিংঘাটা ট্রলার ঘাট। আর সেখানে গেলেই পাবেন রঙবেরঙের ট্রলার। ট্রলারে বান্দরবান থেকে রুমা, রুমা থেকে থানচি আবার থানচি থেকে নাফাকুমও যেতে পারেন।

যারা আরামপ্রিয় তারা বেছে নিতে পারেন ফ্লোরা ক্রুজ রেস্টুরেন্ট কে। সকালের নাস্তা,দুপুরের খাবার আর বিকেলের কফিসহ রুমা আসা যাওয়া খরচ প্রতিজন ২০০০ টাকা। ফ্লোরাতে আসন সংখ্যা ২৪ জন।

কোথায় থাকবেন
বান্দরবান শহর ও রুমা বাজারে ৬০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকার মধ্যে হোটেলকক্ষ পাবেন। ইচ্ছা থাকলে আরো ব্যয়বহুল হোটেলেও যাপন করতে পারেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *