সরকারের তিন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী, ১ সংসদ সদস্য এবং ৩০ জন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি জঙ্গি হামলার হুমকিতে রয়েছেন। বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে কবি, সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, সাংস্কৃতিক কর্মী, ব্লগার ও নিম্ন আদালতের বিচারক রয়েছেন। এসব ব্যক্তির চলাচলে সতর্কতা পালন করতে সরকারের পক্ষ থেকে এরই মধ্যে পরামর্শ দেয়া হয়েছে। দেশের শীর্ষ এক গোয়েন্দা সংস্থা থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের ওপর সম্ভাব্য হামলা সংক্রান্ত নিরাপত্তাবিষয়ক বিশেষ প্রতিবেদনে এসব কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ওই প্রতিবেদনে মৌলবাদী উগ্র জঙ্গি সংগঠন কর্তৃক স্বাধীনতার পক্ষের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব, কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের ওপর সম্ভাব্য হামলার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ, ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম, সংসদ সদস্য ইকবালুর রহিম, সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ জাফর ইকবাল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মুনতাসীর উদ্দিন খান মামুন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি ড. একে আজাদ চৌধুরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ড. আআমস আরেফিন সিদ্দিক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কাবেরী গায়েন, অধ্যাপক আরাফাত রহমান, অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন, ঢাকার সাবেক চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) বিকাশ কুমার সাহা, সাংবাদিক আবেদ খান, শ্যামল দত্ত, মুন্নি সাহা, অঞ্জন রায়, নবনিতা চৌধুরী ও মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল, ভাস্কর ফেরদৌস প্রিয়ভাষিণী, ৭১-এর ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবীর, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু, রামেন্দু মজুমদার ও সৈয়দ হাসান ইমাম, গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ডা. ইমরান এইচ সরকার, গণজাগরণ মঞ্চের একাংশের সভাপতি কামাল পাশা, ব্লগার শাহিন রেজা, মাহমুদুল হক মুন্সি বাঁধন, আরিফ জেবতিক, কানিজ আকলিমা সুলতানা, এফএম শাহীন, সঙ্গীতা ইমাম এবং ছাত্রমৈত্রীর সভাপতি বাপ্পাদিত্য বসুর জীবননাশের হুমকি রয়েছে বলে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। বিশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটিয়ে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো অপতৎপরতা অব্যাহত রেখেছে। দেশি-বিদেশি স্বার্থান্বেষী মহল, উগ্র মৌলবাদী সংগঠন কর্তৃক হত্যাকাণ্ডসহ বিভিন্ন অপতৎপরতা অব্যাহত রাখার বিষয়টি আলোচনায় রয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে ব্লগার আহমেদ হায়দার রাজিবকে হত্যার পর ডক্টর অভিজিৎ রায়, নিলাদ্রি চ্যাটার্জি ওরফে নিলয়, আশিকুর রহমান বাবু, অনন্ত বিজয় দাসসহ সারা দেশে বেশকিছু মুক্তচিন্তক, ব্লগার, বিদেশি নাগরিক এবং ধর্মীয় যাজক, পুরোহিতকে হত্যা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে হামলা চালানো হয়। সম্প্রতি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর এএফএম রেজাউল করিম সিদ্দিকী এবং ঢাকায় কলাবাগানে সমকামীদের অধিকার আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত জুলহাজ মান্নান ও মাহবুব তনয়কে হত্যা করা হয়েছে। এসব ঘটনায় আনসারুল্লাহ বাংলা টিমসহ উগ্র মৌলবাদী জঙ্গি সংগঠনের সম্পৃক্ততা প্রকাশ পেয়েছে। বিগত সময়ে উগ্র মৌলবাদী জঙ্গিগোষ্ঠী বিভিন্ন সংগঠনের নামে দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তি, মুক্তচিন্তক, কবি-সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে আসছে। সম্প্রতি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঢাকায় কলাবাগানে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের পর সারা দেশে ক্ষোভ ও আতঙ্ক রয়েছে। সম্ভাব্য হামলার ধরন সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দুষ্কৃতকারীরা অপারেশন চালানোর আগে বেশ কিছুদিন ধরে ভিকটিমদের গতিবিধি রেকি করে থাকে। ভিকটিমের বাসায়, অফিসে প্রবেশ করে বা ভিকটিম বাসা থেকে বের হওয়ার সময় বা বাসায় ফেরার সময় আবাসস্থলের কাছে আক্রমণের শিকার হয়েছেন। তবে ড. অভিজিৎ রায়কে বইমেলায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ৩ নং গেটের কাছে হামলা চালিয়ে হত্যা করা হয়েছিল। জঙ্গিগোষ্ঠী টার্গেট কিলিং হিসেবে তাদের অপারেশন পরিচালনা করে আসছে। কিলিং অপারেশনে অংশ নেয়া ব্যক্তিরা উন্নতমানের ছোট আগ্নেয়াস্ত্র ও বোমা বহন করলেও প্রায় সবক্ষেত্রে ধারালো চাপাতি ব্যবহার করে ভিকটিমকে ঘাড়ে ও মাথায় আঘাত করার প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়। ঘটনাস্থল থেকে পালানোর সময় বাধা পেলে আগ্নেয়াস্ত্র/বোমা ব্যবহার করতে দেখা গেছে। ঘটনার সময় তারা সাধারণত প্যান্ট, শার্ট, টি-শার্ট পরিধান এবং ছোট ব্যাগ বহন করতে দেখা গেছে। সংঘটিত ঘটনাবলী পর্যবেক্ষণের সময় দেখা যায়, গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নিরাপত্তা সতর্কতার কারণে বর্তমান সময়ে অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা হামলার শিকার হচ্ছেন। বিশেষ প্রতিবেদনে পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, বর্তমানে স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ বিরাজ করছে এবং ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড অব্যাহত রয়েছে। এ পরিস্থিতিতে গণতান্ত্রিক সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ব্যাহত করতে এবং দেশে-বিদেশে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে স্বার্থ হাসিলের জন্য স্বার্থান্বেষী মহল টার্গেট কিলিংয়ের মাধ্যমে গুপ্তহত্যা চালাচ্ছে। দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বজায় রাখতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সতর্ক ভাবে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানোসহ জনগণকে সম্পৃক্ত করার উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। প্রতিবেদনে ১৬টি সুপারিশ উল্লেখ করে বলা হয়েছে, জঙ্গিগোষ্ঠীর কাছ থেকে প্রাণনাশের হুমকি পাওয়া এবং হামলার শিকার সম্ভাব্য ব্যক্তিদের নিরাপত্তা জোরদার করা প্রয়োজন। হামলার শিকার হওয়ার সম্ভাব্য ব্যক্তিদের বাসভবন/কর্মস্থল, বাসভবন/কর্মস্থল থেকে বের হওয়া ও ফিরে আসার সময়, অনুষ্ঠানস্থলে অবস্থানকালীন সময়ে এবং চলাচলের পথে পর্যাপ্ত নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা রাখা দরকার। এছাড়া, ঢাকা মহানগরীতে বসবাসরত হামলার শিকার হওয়া সম্ভাব্য ব্যক্তিদের তালিকা সংশ্লিষ্ট থানায় সংরক্ষণ করে তাদের নিরাপত্তায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া যায়। জঙ্গি সংগঠনগুলোর আর্থিক সহায়তা দেয়া প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তি ও রাজনৈতিক দল এবং সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া যায়। প্রতিবেদনে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য আলেম-ওলামাদের মাধ্যমে ধর্মের বিধি- বিধানের সঠিক ব্যাখ্যা, করণীয় ও বর্জনীয় বিষয়গুলো ব্যাপকভাবে প্রচারের উদ্যোগ নেয়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। এছাড়া, জঙ্গিবাদবিরোধী জনসচেতনতা গড়ে তুলতে জুমার নামাজের খুতবার আগে বক্তব্য দেয়া এবং মাদরাসা ও অন্যান্য ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের মাধ্যমে জঙ্গিবাদের কুফল সংক্রান্ত পাঠদান চালু করা যায়। একই সঙ্গে বিভিন্ন মিডিয়া, সামাজিক সংগঠন ও বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে জঙ্গিবাদবিরোধী সচেতনতা গড়ে তুলতে সারা দেশে গণজাগরণ সৃষ্টি করা যায়। প্রতিবেদনে বলা হয়, ধর্মপ্রাণ মানুষের অনুভূতিতে আঘাত দিয়ে কথিত প্রগতিশীল, মুক্তমনা ও সুশীল নামধারী কিছু ব্যক্তিকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে ধর্ম এবং ধর্মীয় নেতাদের বিরুদ্ধে অশালীন, কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য, ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশ ও ধর্ম এবং দেশের প্রচলিত আইনবিরোধী কর্মকাণ্ড থেকে বিরত রাখার ব্যবস্থা রাখতে হবে। প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া যায়। এছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সব উগ্রপন্থিদের ধর্মীয় অপপ্রচাররোধে সার্বক্ষণিক মনিটরিং ব্যবস্থা চালু রেখে অপব্যবহারকারীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া যায়। একই সঙ্গে প্রশাসনে জঙ্গিবাদ সংশ্লিষ্ট মনোভাবাপন্ন ব্যক্তিদের অবস্থান ও অনুপ্রবেশ সংক্রান্ত সচেতনতা এবং সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর গোপন তথ্য চুরি ও হ্যাকিং হওয়ার বিষয়ে সর্বোচ্চ সতর্কতা নিশ্চিত করা দরকার। গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহে সাইবার ইন্টিলিজেন্সকে গুরুত্ব দিয়ে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করার পাশাপাশি বিশ্বস্ত এজেন্ট ও সোর্স নিয়োগ করা প্রয়োজন। বিশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকা মহানগরীর গুরুত্বপূর্ণ এলাকা ও রাস্তাগুলো সিসিটিভি’র আওতায় এনে মনিটরিং করার ব্যবস্থা করতে হবে। একই সঙ্গে বিভিন্ন সোসাইটি ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে সিসিটিভি স্থাপন করে নিজস্ব নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সবাইকে উদ্বুদ্ধ করা যায়। এছাড়া জঙ্গি কর্মকাণ্ডে রুজু হওয়া মামলাগুলোর দ্রুত নিষ্পত্তির ব্যবস্থা এবং পলাতক ও জড়িত জঙ্গি সদস্যদের গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত রাখা যায়। পাশাপাশি প্রশিক্ষিত টিম দিয়ে গ্রেপ্তারকৃত জঙ্গিদের জিজ্ঞাসাবাদ করার ব্যবস্থা করতে হবে। জঙ্গিদের জেলখানায় ও আদালতে আনা-নেয়ার পথে পর্যাপ্ত নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। জেলখানায় আটক থাকা জঙ্গি সদস্যদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসা ব্যক্তিদের তালিকা সংরক্ষণসহ সাক্ষাৎ পরবর্তী সময়ে তাদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে।