নৌপথে ভারতের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে ট্রানজিট শুরু হচ্ছে ১৬ জুন। নৌ প্রটোকল চুক্তি অনুযায়ী দু’দেশের মধ্যে এটি হবে নিয়মিত বা স্থায়ী ট্রানজিট। ট্রানজিটের বিনিময়ে বাংলাদেশ পাবে মাশুলসহ অন্যান্য চার্জ। অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, নৌ ট্রানজিট কার্যকরের ফলে দু’দেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ক নতুন মাত্রা পাবে। ব্যবসায়ীদের মতে, এর ফলে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য আরও বাড়বে।
জানা গেছে, এর আগেও দু-একটি ক্ষেত্রে নৌ ট্রানজিট দেওয়া হয়েছিল ভারতকে। তবে সেটা ছিল অনানুষ্ঠানিক। আনুষ্ঠানিকভাবে মাশুলের বিনিময়ে ভারতের পণ্যবাহী জাহাজ বাংলাদেশের নৌ সীমানায় প্রবেশ করেছে এবারই প্রথম। আজকালের মধ্যে পণ্যবাহী ভারতীয় জাহাজটি আশুগঞ্জ বন্দরে ভিড়বে। উদ্বোধনের পর জাহাজের পণ্য খালাস করা হবে।
এর মধ্যে এক হাজার টন স্টিলশিট (রড) নিয়ে একটি জাহাজ ভারতের কলকাতা বন্দর ছেড়ে বাংলাদেশের সীমানায় পেঁৗছেছে। মাশুল আরোপের পর বাণিজ্যিকভাবে এটিই হলো ট্রানজিটের প্রথম চালান। জাহাজটি বাংলাদেশের আশুগঞ্জ বন্দরে পেঁৗছাবে। সেখানে পণ্য খালাস শেষে বাংলাদেশের সড়কপথ দিয়ে সে পণ্য যাবে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে। অর্থাৎ ভারতের এক রাজ্যের পণ্য বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করে ভারতের অপর রাজ্যে যাবে।
সূত্র জানায়, আশুগঞ্জ বন্দরের মাধ্যমে স্থায়ী ট্রানজিট চালু হলেও এই বন্দরের অবকাঠামো মোটেই ভালো নয়। ভারতীয় ঋণ সহায়তায় এ বন্দর উন্নয়ন কাজ করার কথা ছিল। কিন্তু ওই ঋণ এখনও পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া রয়েছে জমি অধিগ্রহণের সমস্যা। এসব কারণে বন্দরের সংস্কার আটকে আছে। এদিকে আশুগঞ্জ থেকে ভারতের ত্রিপুরা পর্যন্ত সড়কও ভারী পণ্য পরিবহনের জন্য উপযুক্ত নয় বলে জানা গেছে।
ট্রানজিটের পণ্য পরিবহনে এই বন্দর এবং সড়ক আদৌ সক্ষম হবে কি-না তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে. একটি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ট্রানজিট শুরুর কার্যক্রম উদ্বোধন করা হবে। এ জন্য আশুগুঞ্জ বন্দরে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় ১৬ জুন বৃহস্পতিবার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। নৌ পরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান এমপি, প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিকবিষয়ক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান, নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব অশোক মাধব রায়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব হেদায়েতুল আল মামুন, এনবিআরের চেয়ারম্যান নজিবুর রহমান, বাংলাদেশ ইনল্যান্ড ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআইডবি্লউটিএ) ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ও বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার হর্ষবর্ধন শ্রিংলা অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন।
যোগাযোগ করা হলে নৌ পরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান বলেন, গত বছরের জুনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশ সফরের সময় দু’দেশের মধ্যে নৌ প্রটোকল চুক্তি সই হয়েছিল। তারই ফলে নদীপথে ট্রানজিটের প্রথম চালান এসেছে। এর মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে দু’দেশের মধ্যে ট্রানজিট চালু হচ্ছে। মন্ত্রী বলেন, এর ফলে বাংলাদেশ লাভবান হবে। পাশাপাশি ভারতের ব্যবসায়ীরা উপকৃত হবেন। কারণ পণ্য পরিবহনে তাদের সময় ও খরচ কমে যাবে। মন্ত্রী আরও জানান, আশুগঞ্জ বন্দরে পণ্য খালাসের পর আখাউড়া হয়ে ত্রিপুরার আগরতলা পর্যন্ত সড়কেপথে আমাদের দেশের ট্রাক ব্যবহার করে পণ্য নিয়ে যাওয়া হবে। এতে করে আমাদের শ্রমিকদের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে। তাছাড়া ট্রানজিটের বিনিময়ে মাশুল, বিভিন্ন ধরনের চার্জ পাওয়া যাবে।
বিআইডবি্লউটিএর ট্রাফিক বিভাগের পরিচালক মফিজুর রহমান বলেন, এখন থেকে আশুগঞ্জ বন্দর সবার জন্য উন্মুক্ত থাকবে। যারা এই বন্দর দিয়ে পণ্য পরিবহন করতে চাইবে, নিয়ম-কানুন প্রতিপালন সাপেক্ষে তাদের অনুমতি দেওয়া হবে।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বর্তমানে ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের ৯০ ভাগই স্থলপথে। স্থায়ীভাবে নৌ ট্রানজ্রিট চালু হলে সমুদ্রপথে বাণিজ্য বৃদ্ধির ব্যাপক সম্ভাবনা তৈরি হবে।
কার্গো পরিবহন ব্যবসায়ী এস কে মাহফুজ বলেন, ভারতের সঙ্গে পুরোপুরি নৌ ট্রানজিট চালু হলে পণ্য পরিবহনে সময় ও খরচ বর্তমানের চেয়ে কমপক্ষে দুই-তৃতীয়াংশ কমে আসবে। তখন উভয় দেশের ব্যবসায়ীরা নৌপথে পণ্য পরিবহনে উৎসাহিত হবেন। ফলে লাভবান হবে দু’দেশই।
সূত্র জানায়, পণ্যভর্তি যে জাহাজটি কলকাতা বন্দর ছেড়ে বাংলাদেশের নৌ সীমানায় এসেছে তার নাম এমভি নিউটেক-৬। আনবিস ডেভেলপমেন্ট নামে বাংলাদেশি জাহাজ অপারেটর ট্রানজিটের প্রথম চালান আনার ঠিকাদারি কাজ পেয়েছে। গতকাল জাহাজটি বরিশাল টার্মিনাল ছেড়ে চাঁদপুরে রওনা দিয়েছে। মেঘনাঘাট হয়ে আজকালের মধ্যে গন্তব্যস্থল আশুগঞ্জ বন্দরে পেঁৗছাবে। জাহাজটি আশুগঞ্জ বন্দরে আসার পর দু’দেশের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে ট্রানজিটের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম উদ্বোধন করা হবে। মালপত্র খালাস শেষে ট্রাকে করে বাংলাদেশের ভেতরে সড়কপথ দিয়ে পেঁৗছে দেওয়া হবে ত্রিপুরার আগরতলা সীমান্তে। আশুগঞ্জ থেকে আগরতলা পর্যন্ত সড়কপথের দৈর্ঘ্য ৫১ কিলোমিটার। জানা গেছে, প্রথম চালানে যে পরিমাণ মালপত্র এসেছে তাতে আগরতলা ওয়্যারহাউসে ওইসব পণ্য পেঁৗছে দিতে বাংলাদেশি ৫০ থেকে ৬০টি ট্রাক লাগবে।
প্রেক্ষাপট: অনেক আগে থেকেই বাংলাদেশের আশুগঞ্জ বন্দর ব্যবহার করে করে স্থায়ীভাবে ট্রানজিট কার্যকরের আগ্রহ দেখিয়ে আসছে ভারত। কিন্তু নৌ প্রটোকল চুক্তিতে এ বিধান না থাকায় এতদিন তা চালু করা সম্ভব হয়নি। দীর্ঘ আলোচনার পর ভারতের প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে বিদ্যমান চুক্তিটি সংশোধন করেছে বাংলাদেশ, যা গত বছরের জুনে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরের সময় অন্যান্য চুক্তির সঙ্গে এই চুক্তিটিও স্বাক্ষরিত হয়। সংশোধিত নৌ প্রটোকল চুক্তিতে নৌপথে তৃতীয় দেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করে পরস্পর দেশগুলোর মধ্যে পণ্য পরিবহনের সুযোগ রাখা হয়েছে। ফলে উভয় দেশের মধ্যে স্থায়ীভাবে ট্রানজিট করতে এখন আর কোন বাধা নেই। তারই ধারাবাহিকতায় মাশুল নির্ধারণের বিষয়টি চূড়ান্ত করা হয় গত বছরের নভেম্বরে নয়াদিলি্লতে অনুষ্ঠিত সচিব পর্যায়ের বৈঠকে।
ওই বৈঠকে সমঝোতার ভিত্তিতে নৌ ট্রানজিটের আওতায় মাশুল বা ফি নির্ধারণ করা হয় টনপ্রতি ১৯২ টাকা ২২ পয়সা। এর আগে আশুগঞ্জ বন্দরকে ‘পোর্ট অব কল’ (ট্রান্সশিপমেন্ট পয়েন্ট) ঘোষণা করে বাংলাদেশ সরকার। একই সঙ্গে রুট নির্ধারণ করা হয়। সরকারি পর্যায়ে মাশুল নির্ধারণের পর কলকাতা থেকে পণ্যভর্তি জাহাজের প্রথম চালান বাংলাদেশে এসেছে। বিআইডবি্লউটিএ অফিস সূত্রে জানা গেছে, আনবিস ছাড়াও আরও একটি প্রতিষ্ঠান ট্রানজিট চালানের অনুমতির জন্য আবেদন করেছে।
আগের অনানুষ্ঠানিক ট্রানজিট: তিন বছর আগে নৌ প্রটোকলের আওতায় কলকাতা-আশুগঞ্জ-আখাউড়া-আগরতলা পথে কোনো ধরনের মাশুল ছাড়াই একটি পরীক্ষামূলক চালানে লোহার চালান আগরতলায় গিয়েছিল। এ ছাড়া এ পথটি ব্যবহার করে ত্রিপুরা গেছে পালাটানা বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভারী যন্ত্রাংশ এবং ১০ হাজার টন চাল। ভারত সরকারের বিশেষ অনুরোধে বাংলাদেশ সরকার মানবিক কারণে এই অনুমতি দিয়েছিল। তখন মালপত্র পরিবহন করা হলেও তার বিনিময়ে কোনো ফি বা মাশুল নেয়নি বাংলাদেশ। এখন থেকে নৌপথে পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বন্দর ব্যবহার করলে তার বিনিময়ে নির্ধারিত মাশুল আদায় করবে বাংলাদেশ সরকার।
মাশুল ও চার্জ: ট্রানজিট কার্যকরের আগে নাব্যের কারণে কখনও কখনও ভারতীয় পণ্যবাহী জাহাজ অনুমতি নিয়ে বাংলাদেশের জলসীমায় ঢুকেছে। এ জন্য ভারতকে বছরে ১০ কোটি টাকা থোক বরাদ্দ হিসেবে বাংলাদেশকে দিতে হতো। এখন শুল্ক বিভাগ, বিআইডবি্লউটিএ ও সড়ক বিভাগকে প্রতি টনে মোট ১৯২ টাকা ২২ পয়সা মাশুল দিতে হবে। এর মধ্যে ১৩০ টাকা পাবে শুল্ক কর্তৃপক্ষ। সড়ক বিভাগকে প্রতি টনে ৫২ টাকা, আর ১০ টাকা পাবে বিআইডবিল্গউটিএ। এর বাইরে ট্রানজিট পণ্য পরিবহনকারী প্রতিষ্ঠান যদি পণ্যের নিরাপত্তা চায়, তবে প্রতি টনে আরও ৫০ টাকা ‘এসকর্ট’ ফি গুনতে হবে। এ ছাড়া পণ্য ওঠানো-নামানোর ক্ষেত্রে নৌ প্রটোকলের আওতায় অন্য যেসব চার্জ আছে, যেমন বার্থিং, লেবার হ্যান্ডলিং, ল্যান্ডিং, পাইলটেজ এবং কনজারভেন্সি চার্জ দিতে হবে। বিআইডবি্লউটিএ সূত্রে জানা গেছে, এসব চার্জ আদায় করা হলে টনপ্রতি বাড়তি একশ’ থেকে দেড়শ’ টাকা পাওয়া যাবে।
সড়ক ও রেলপথে অনিশ্চিত: গত বছরের জুনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশ সফরের সময় বাণিজ্য চুক্তি সই হয়েছিল। তাতে নৌপথের পাশাপাশি সড়ক ও রেলপথে ট্রানজিট চালুর বিধান রাখা হয়। এ ছাড়া বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত ও নেপাল (বিবিআইএন) এই চার দেশের যান চলাচল চুক্তিতেও একই বিধান রাখা হয়। জানা গেছে, বাংলাদেশ, ভারত ও নেপাল মোটরযান চলাচল চুক্তি অনুমোদন দিলেও ভুটানের সংসদে এটি অনুমোদন পায়নি। ভারত ও নেপাল সম্পর্কে টানাপড়েন চলছে। এসব কারণে সড়কপথে ট্রানজিট ব্যবস্থা থেমে আছে। সড়ক পরিবহন সচিব এমএ সিদ্দিক জানান, আগামী মাসে ভুটানের সংসদে বিবিআইএন অনুসমর্থন পেতে পারে। ভুটানের সমর্থনের পর পরই বাকি কাজগুলো দ্রুত করা যাবে। আর রেলপথে ট্রানজিটের জন্য অবকাঠামো নির্মাণ বেশ সময়সাপেক্ষ বলে মন্তব্য করেন তিনি।