দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক জোরদারে ঢাকা-রিয়াদ আলোচনা

Slider জাতীয়

 

17190_f2

 

 

 

 

ঢাকা-রিয়াদ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক এবং পারস্পরিক সহযোগিতার সম্ভাবনার বিভিন্ন খাত নিয়ে সৌদি বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজ আল সৌদের সঙ্গে আলোচনা করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বৈঠকে সামপ্রতিক আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক বিভিন্ন ইস্যুও তাদের পর্যালোচনায় স্থান পেয়েছে। সৌদি আরবের রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা সৌদি নিউজ এজেন্সি বৈঠকের পর এ খবর প্রকাশ করেছে। বাদশাহর আমন্ত্রণে দ্বিপক্ষীয় সফরে গত শুক্রবার থেকে দেশটিতে রয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গত শনি ও রোববার দেশটির সরকারের মন্ত্রী ও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেন। গতকাল স্থানীয় সময় দুপুর ১টায় জেদ্দার রাজদরবার আল সালাম প্যালেসে বাদশাহ ও প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন দুই দেশের প্রতিনিধি দলের আনুষ্ঠানিক বৈঠক হয়।

সৌদি প্রেস এজেন্সির রিপোর্টে জানানো হয়, ওই বৈঠকে সৌদি বাদশাহর সঙ্গে তার উপদেষ্টা ও মক্কার গভর্নর প্রিন্স খালিদ আল ফয়সল, প্রিন্স মানসুর বিন মিতাব বিন আবদুল আজিজ, ক্রাউন প্রিন্স মুহাম্মদ বিন নায়েফ বিন আবুল আজিজ, মন্ত্রী পরিষদের অন্যতম সদস্য ড. মোশাহেদ বিন মুহাম্মেদ আল এইবান, অর্থমন্ত্রী ড. ইব্রাহিম বিন আবদুল আজিজ আল-আশশাফ, সংস্কৃতি ও তথ্যমন্ত্রী ড. আদেল বিন জাঈদ আল-তোরাইফি, পররাষ্ট্রমন্ত্রী আদেল বিন আহমেদ আল-জুবায়ের এবং বাংলাদেশে নিযুক্ত সৌদি রাষ্ট্রদূত আবদুল্লাহ বিন হাজার আল মুতাইরী উপস্থিত ছিলেন। ওই রিপোর্ট মতে, বাংলাদেশের পক্ষে শেখ হাসিনার সঙ্গে তার ছোট বোন শেখ রেহানা, পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব আবুল কালাম আজাদ, সৌদিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত গোলাম মসীহ অংশ নেন।

সৌদি প্রেস এজেন্সির রিপোর্টে আরো বলা হয়, শেখ হাসিনা ওয়াজেদকে পবিত্র দুটি মসজিদের রক্ষণাবেক্ষণকারী বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজ আল সৌদ স্বাগত জানান এবং সৌদি আরবে তার অবস্থান আনন্দঘন হওয়ার আশা করেন। জবাবে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাকে আমন্ত্রণ জানানো, উষ্ণ অভ্যর্থনা এবং অবস্থানকালীন আতিথেয়তা জন্য বাদশাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। এদিকে প্রধানমন্ত্রীর হাই প্রোফাইল ওই সফরে দেশটিতে বাংলাদেশি পুরুষ কর্মীদের ভিসা উন্মুক্তকরণ, সৌদি নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট নিয়ে আলোচনা ছাড়াও পররাষ্ট্র, সংস্কৃতি এবং তথ্য ও প্রযুক্তি খাতে ৩টি পৃথক চুক্তি সইয়ের কথা আগেই জানিয়েছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলী। তবে সেই আলোচনা বা চুক্তি সই হয়েছে কি-না সেটি গতরাতে এ রিপোর্টং লেখা পর্যন্ত নিশ্চিত হওয়া যায়নি। আজ সকালে প্রধানমন্ত্রী বিমানে মদিনার উদ্দেশে জেদ্দা ত্যাগ করবেন এবং মদিনায় তিনি মদিনা হিলটন হোটেলে অবস্থান করবেন। প্রধানমন্ত্রী মসজিদে নববিতে আসর এবং মাগরিবের নামাজ আদায় করবেন এবং হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর রওজা মোবারক জিয়ারত করবেন। কাল সন্ধ্যায় তার দেশে ফেরার কথা রয়েছে।
রিয়াদে বাংলাদেশের দূতাবাস ভবন ও রাষ্ট্রদূতের বাসভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার রাতে জেদ্দা কনফারেন্স প্যালেসে এক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে ওই ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন তিনি। সেখানে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিশ্বব্যাপী কূটনৈতিক সম্পর্ক থাকা প্রতিটি দেশেই বাংলাদেশ মিশনের নিজস্ব ভবন হবে। দূতাবাসগুলোর এই নিজস্ব ভবন বহির্বিশ্বে ‘স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতীক’ হয়ে উঠবে বলেও মন্তব্য করেন শেখ হাসিনা। গত মাসের শেষের দিকে জাপান সফরের সময় টোকিওতে বাংলাদেশ দূতাবাসের নিজস্ব ভবনের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী। জেদ্দার অনুষ্ঠানে তিনি জানান, যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ দূতাবাসের নিজস্ব ভবন তৈরি হয়েছে। ভারত এবং পাকিস্তানেও কাজ চলছে। সৌদি আরবকে মুসলিম উম্মাহর জন্য গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, পরবর্তীতে  জেদ্দাতেও বাংলাদেশ মিশনের নিজস্ব ভবন হবে। হজযাত্রীদের সুবিধার জন্য হজ অফিস জেদ্দা থেকে মক্কায় স্থানান্তর করার চিন্তার কথাও জানান প্রধানমন্ত্রী। তিনি তার সংক্ষিপ্ত বক্তৃতায় প্রবাসী বাংলাদেশিদের সুযোগ-সুবিধা দেখার জন্য দূতাবাস কর্মকর্তাদের আন্তরিকভাবে কাজ করার নির্দেশ দেন।
কৃষি থেকে শিল্পে যাচ্ছি, আপনারা আসুন: বাংলাদেশ এখন কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি  থেকে শিল্পের দিকে যাচ্ছে জানিয়ে এদেশে বিনিয়োগের জন্য সৌদি ব্যবসায়ীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গতকাল সৌদি সময় সকালে  জেদ্দা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে এ আহ্বান জানান তিনি। বৈঠক শেষে প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন। বাংলাদেশকে ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয় এবং ২০৪১ সালে উন্নত দেশে উপনীত হওয়ার লক্ষ্যের কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, আমরা ইতিমধ্যেই নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছি। লক্ষ্য অর্জনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। সৌদি বিনিয়োগকারী ও উদ্যোক্তা নেতাদের আমাদের দেশে বিনিয়োগ, ব্যবসা-বাণিজ্য, সমৃদ্ধি এবং লভ্যাংশের অংশীদার হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি। সম্মিলিত উদ্যোগের মাধ্যমেই কোটি মানুষের জীবনমানের পরিবর্তন আসবে বলে মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রী। বাংলাদেশের উদীয়মান শিল্প খাত যেমন- বস্ত্র, চামড়া শিল্প, পাট, সিরামিক,  পেট্রোকেমিক্যাল, ফার্মাসিউটিক্যালস, শিপ বিল্ডিং, কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ, প্লাস্টিক পণ্য, হালকা প্রকৌশল ও ইলেকট্রনিকস,  টেলিযোগাযোগ ও তথ্য-প্রযুক্তি, বিদ্যুৎ-জ্বালানি ও সমুদ্র সম্পদসহ বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগের আহ্বান জানান তিনি। দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ ‘সবচেয়ে উদার’ বিনিয়োগ নীতির দেশ মন্তব্য করে শেখ হাসিনা বলেন, আইন করে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের নিরাপত্তা, ট্যাক্স হলিডে, যন্ত্রপাতি আমদানিতে কর রেয়াত, রয়্যালটির রেমিট্যান্স, অনিয়ন্ত্রিত প্রত্যাহার নীতি এবং লভ্যাংশ ও পুঁজি দেশে ফিরিয়ে নেয়াসহ অনেক সুযোগ-সুবিধা দেয়া হচ্ছে। এছাড়া, তরুণ, পরিশ্রমী এবং তুলনামূলক স্বল্প  বেতনে প্রশিক্ষিত জনশক্তি, স্বল্প খরচে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ভারত, জাপান ও নিউজিল্যান্ডের বাজারে পণ্যের শুল্কমুক্ত ও কোটামুক্ত প্রবেশ সুবিধার কথা তুলে ধরেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, শিল্পসমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে তার সরকার দেশের বিভিন্ন স্থানে ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (এসইজেড) প্রতিষ্ঠা করছে এবং তথ্য-প্রযুক্তি শিল্পের জন্য একাধিক হাইটেক পার্ক নির্মাণ করা হচ্ছে। এসইজেড ও হাইটেক পার্কে বিনিয়োগকারীদের জন্য বিশেষ প্রণোদনা প্যাকেজ  দেয়া হচ্ছে বলেও জানান তিনি। দেশের অর্থনীতির অগ্রগতি তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জীবন-জীবিকার প্রয়োজননির্ভর কৃষিভিত্তিক রাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশ এখন একটি যন্ত্রনির্ভর, প্রক্রিয়াজাতকরণ,  বৈচিত্র্য ও মূল্য সংযোজনের  দেশে পরিণত হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে বাংলাদেশ থেকে প্রকৌশলী, স্থপতির মতো দক্ষ মানবসম্পদ রপ্তানির লক্ষ্যে  সৌদি আরবভিত্তিক বাওয়ানি গ্রুপ এবং বাংলাদেশের  সেনাকল্যাণ সংস্থার মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক সই হয়। এতে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব আবুল কালাম আজাদ ও বাওয়ানি গ্রুপের মহাব্যবস্থাপক ফাকের এ আল-শাওয়াফ নিজ নিজ পক্ষে চুক্তিতে সই করেন।  বৈঠকে অন্যদের মধ্যে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছাড়াও বাংলাদেশের শিল্পোদ্যোক্তা সালমান এফ রহমানের  নেতৃত্বে এফবিসিসিআই সভাপতি আব্দুল মাতলুব আহমাদসহ অন্য ব্যবসায়ী  নেতারা উপস্থিত ছিলেন।  সৌদি বাদশাহ সালমান দায়িত্ব নেয়ার পর মধ্যপ্রাচ্যের এই তেলসমৃদ্ধ  দেশে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর এটাই প্রথম সফর। সর্বশেষ ২০১৩ সালের নভেম্বরে ওমরাহ করতে সৌদি আরবে গিয়েছিলেন শেখ হাসিনা।
আইডিবিকে প্রতিযোগিতামূলক করার অনুরোধ প্রধানমন্ত্রীর: দেশের তেল আমদানিতে  দেয়া ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক (আইডিবি)’র স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ট্রেড ফাইন্যান্স করপোরেশন (আইটিএফসি)’র সুদের হার আরো হ্রাস করে তা ‘প্রতিযোগিতামূলক’ করার জন্য আইডিবি’র প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রতিষ্ঠানটির ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট ড. আহমেদ তিকতিক শনিবার সন্ধ্যায় রয়েল কনফারেন্স প্যালেসে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এলে প্রধানমন্ত্রী এ অনুরোধ জানান। বৈঠকের পরে পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক এবং প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম সাংবাদিকদের এ কথা জানান।
বাংলাদেশের সাফল্য মুসলিম বিশ্বে তুলে ধরতে চায় ওআইসি: এনজিও, নারীর ক্ষমতায়ন এবং সামষ্টিক অর্থনীতিতে বাংলাদেশের অভূতপূর্ব সাফল্যের চিত্র বিশ্বের অন্যান্য মুসলিম দেশের কাছে তুলে ধরতে চায় অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কো-অপারেশন (ওআইসি)। জেদ্দা সফররত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাতে সংস্থার মহাসচিব আইয়াদ বিন আমিন মাদানী এ বিষয়ে বাংলাদেশের সহযোগিতা কামনা করেন। শনিবার সন্ধ্যার ওই সাক্ষাৎ শেষে পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হক এবং প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন। ব্রিফিংয়ে বলা হয়, প্রধানমন্ত্রী ওআইসি মহাসচিবের অনুরোধের জবাবে বলেন, ওআইসি এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব পাঠালে বাংলাদেশ এ বিষয়ে সহযোগিতায় প্রস্তুত রয়েছে।  বৈশ্বিক উন্নয়নে বাংলাদেশের অগ্রণী ভূমিকার ভূয়সী প্রশংসা করে ওআইসি মহাসচিব বলেন, বাংলাদেশের অগ্রগতিতে আশান্বিত হয়ে তার সংস্থা এ বিষয়ে নতুন করে পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। মহাসচিব প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়নেরও প্রশংসা করেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *