অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছেন, ২০১৬-১৭ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা উচ্চাভিলাষী। তবে রাজস্ব আয়ের এ লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা সম্ভব। এজন্য আগামী মাস থেকেই রাজস্ব আদায়ে বিশেষ কার্যক্রম শুরু করা হবে। গতকাল বিকালে রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরের বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী এ কথা বলেন। এ বিষয়ে মুহিত বলেন, ‘ইয়েস আমি নিজেই বলেছি রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা উচ্চাভিলাষী। গত কয়েক বছরের মতো এদিনও সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দপ্তরের চারজন মন্ত্রী মুহিতের সঙ্গে মঞ্চে ছিলেন। মুহিতের ডানপাশে ছিলেন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ ও পরিকল্পনা মন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। আর বাঁ পাশে ছিলেন কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, অর্থ প্রতিমন্ত্রী আবদুল মান্নান। অর্থ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মাহবুব আহমেদ, এনবিআর চেয়ারম্যান নজিবুর রহমানসহ সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা এ সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন।
প্রস্তাবিত বাজেট অনুযায়ী রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা যাবে কি-না সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, গত বছরে রাজস্ব আদায় ছিল নিম্নমুখী। কিন্তু আপনারা যদি আগের বছরে দেখেন সেটা সব সময় দুই ডিজিটের বেশি ছিল। গতবারে কম হয়েছে। আমি সাত বছর ধরে এই মন্ত্রণালয়ে আছি। গত সাত বছরে রাজস্ব আদায়ের সক্ষমতা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করা হয়েছে। নতুন নতুন অফিস হয়েছে, জনবল নিয়োগ দেয়া হয়েছে। প্রত্যেক উপজেলায় অফিস হবে। ৩৫ শতাংশ অতিরিক্ত কর আদায়ের প্রস্তাব করেছি। কালো টাকা সাদা করার বিধান বাজেটে কতদিন থাকবে?- সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, এই সরকার যতদিন আছে ততদিন অপ্রদর্শিত আয় সাদা করার আইন বলবৎ থাকবে। বর্তমানে নির্দিষ্ট পরিমাণ জরিমানা দিয়ে অপ্রদর্শিত অর্থ প্রদর্শনের সুযোগ রয়েছে। এটা নিয়ে অহেতুক প্রশ্ন করার কোনো প্রয়োজন নেই। এটা সাধারণ নিয়মে পরিণত হয়েছে। রাজস্ব আদায়ে বিশ্বের সব দেশ থেকেই বাংলাদেশ তুলনামূলক পিছিয়ে মন্তব্য করে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, আমাদের হ্যাবিটটা চেঞ্জ করা দরকার। রাজস্বের দিকে নজর দিতে হবে। কারণ আমরা সব সময় সরকার কী সেবা দিল তা নিয়ে হৈ চৈ করি, দাবি করি। কিন্তু সরকার সেবা দিতে গেলে যে রাজস্ব প্রয়োজন সেটা নিয়ে মোটেই মাথা ঘামাই না। তাই একটু রাজস্ব বেশি দিলে মন্দ হয় না। অর্থমন্ত্রী বলেন, আমরা পৃথিবীর সব দেশের চেয়ে কম রাজস্ব আদায় করি। একটি না দুটি দেশ আমাদের নিচে আছে। মোবাইল ফোনে কথা বলার ওপর ট্যাক্স কমানো হবে কি?- এমন প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, এই খাত থেকে আগে যেমন ট্যাক্স আসতো, এখন তেমন আসছে না। তবে মোবাইল ফোনে যারা কথা বলেন, তাদের জন্য এ বৃদ্ধি তেমন কিছু না বলে আমি মনে করি। এতে তাদের জন্য অতিরিক্ত কোনো প্রভাব পড়বে না। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলসহ অনেকেই বলছেন, বর্তমান বাজেট প্রতিক্রিয়াশীল। একজন অর্থনীতিবিদ হিসেবে বর্তমান বাজেটকে কি আপনি প্রতিক্রিয়াশীল মনে করেন?- এমন প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, বাজেটের ব্যাপারে সাধারণত দুই ধরনের বিশ্লেষণ পাওয়া যায়। একটি প্রতিক্রিয়াশীল বিশ্লেষণ আরেকটি হচ্ছে প্রগতিশীল বিশ্লেষণ। বিএনপি আগের মতো এবারও বাজেট নিয়ে প্রতিক্রিয়াশীল মন্তব্য করছে। মূলত রাজনীতির প্রতি দায়িত্বশীল আচরণ না থাকার কারণেই তারা এমন মন্তব্য করে আসছে। এদিকে সংবাদ সম্মেলনে অংশ নেয়া বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদও একই ধরনের মন্তব্য করে বলেন, বাজেট নিয়ে বিএনপির প্রতিক্রিয়া সত্যিই দুঃখজনক। বাজেট হয়েছে প্রগতিশীল ধারায় আর বিএনপি মন্তব্য করেছে প্রতিক্রিয়াশীল ধারায়। এই বাজেটটি গণমুখী দাবি করে তোফায়েল আহমেদ বলেন, বিএনপির যিনি বা যে নেত্রী বাজেট নিয়ে এমন মন্তব্য করেছেন, তিনি হয়তো বাজেট বক্তৃতা শোনেননি অথবা পড়েননি। অনেকেই বলেন, বাজেট উচ্চাভিলাষী। বাস্তব কথা হচ্ছে উচ্চাভিলাষী না হলে উপরে ওঠা যায় না। যেমন, বঙ্গবন্ধু দেশ স্বাধীনের স্বপ্ন দেখেছিলেন বলেই বাংলাদেশ পেয়েছি। তখন অনেকেই বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নকে উচ্চাভিলাষী বলে মন্তব্য করেছিলেন। এক সাংবাদিকের প্রশ্নে অর্থমন্ত্রী স্বীকার করেন, সরকার গত ৬ বছরে কর্মক্ষম সবাইকে চাকরি দিতে পারেনি। তবে বর্তমান সরকারের সময় কর্মসংস্থানের তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরে পরিকল্পনামন্ত্রী অ হ ম মোস্তফা কামাল বলেন, মনে হয় কর্মসংস্থানে আমরা টার্গেট অনুযায়ী পিছিয়ে নেই। অর্থমন্ত্রী বলেন, বাজেট একটি প্রস্তাব। বাস্তবায়নের সময় অনেক কিছুই সংযোজন-বিয়োজন করতে হয়। একটি ছোট বাজেট দিয়ে তা পুরোপুরি বাস্তবায়নের মধ্যে কোনো সার্থকতা নেই। বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল বলেন, স্বাধীনতার পর সাড়ে সাতশ কোটি টাকার বাজেট দেয়া হয়েছিল। আজ ৩ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। স্বপ্ন দেখেই এগুতে হয়। বিনিয়োগ নিয়ে অর্থমন্ত্রী মুহিত বলেন, আমরা গত দেড় বছরে দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগে বড় একটি ধাক্কা পেয়েছি। এ সময় প্রায় দুই বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ অর্থের বিদেশি বিনিয়োগের প্রস্তাব পেয়েছি। বেসরকারি খাতও এগিয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, আমার মনে হচ্ছে দেড় বছরে পরিস্থিতি অনেক পরিবর্তন হয়েছে। যাতে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থা বেড়েছে। তারা বুঝতে পেরেছে- এদেশের মানুষ স্ট্রাইক (হরতাল) বা ধর্মঘট আর চায় না। এখানকার শ্রমিকরা অহেতুক ছুটি কাটায় না। তারা নির্বিঘ্নে কাজ করতে চায়। এটাই আমাদের বিনিয়োগে আশাবাদী করে তুলেছে। জেলা বাজেট নিয়ে তিনি বলেন, এটা একটা রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয়। উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন, প্রণয়নের ক্ষেত্রে স্থানীয় সরকারকে ভূমিকা রাখতে হবে। এ ব্যাপারে আমরা প্রস্তুতি গ্রহণ করছি। অভিজ্ঞতাও ভালো। তেলের দাম প্রসঙ্গে তিনি বলেন, জ্বালানি তেলের দাম সামান্য কমানো হয়েছে। এক্ষেত্রে আমাদের একটু সাবধানতা অবলম্বন করে দাম সমন্বয় করতে হবে। কেননা, বিশ্ববাজারে ইতিমধ্যে তেলের দাম আবার ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে গেছে। তবে দেশে তেলের দাম সমন্বয়ের প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর দিকনির্দেশনা অনুসারে কাজ করা হবে। কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী বলেন, আমরা মধ্য আয়ের দেশের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। যে সমালোচনাই করা হোক- এই বাজেট বাস্তবসম্মত।
তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেন, আমরা যুদ্ধাপরাধী নিধন করেছি, জঙ্গিবাদও নিরসন করতে পারবো। আমাদের এই অগ্রযাত্রা থামানোর জন্য বিএনপি গুপ্তহত্যা চালাচ্ছে। আমরা উন্নয়নের মহাসড়কে আছি। এর আগে গত বৃহস্পতিবার ৭ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে জাতীয় সংসদে ২০১৬-১৭ অর্থবছরের জন্য ৩ লাখ ৪০ হাজার ৬০৫ কোটি টাকার প্রস্তাবিত বাজেট উপস্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, যা জিডিপির ১৭ দশমিক ৪ শতাংশ এবং মোট রাজস্ব আয় প্রাক্কলন করা হয়েছে ২ লাখ ৪২ হাজার কোটি টাকা, যা জিডিপির ১২ দশমিক ৪ শতাংশ। এতে ঘাটতি ধরা হয়েছে ৯৭ হাজার ৮৫৩ কোটি টাকা।
মানবজমিনের রিপোর্ট নিয়ে অর্থমন্ত্রীর প্রশ্ন: বাজেট নিয়ে মানবজমিনে প্রকাশিত একটি রিপোর্ট নিয়ে সংবাদ সম্মেলনের শুরুতেই প্রশ্ন তোলেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। এ সময় তিনি আরো একটি জাতীয় দৈনিকের একটি সংবাদের সমালোচনা করেন। সংবাদ সম্মেলনের শুরুতেই অর্থমন্ত্রী বলেন, সংসদে ৯০ পৃষ্ঠা (বাজেট বক্তৃতা) পড়ার পর আর বক্তৃতা দেয়া উচিত নয়। যারা প্রশ্ন করতে চান তাদের কাছে ছেড়ে দিতে চাই। তার আগে দুটি পত্রিকার বিষয়ে আমার কথা আছে। মানবজমিন ১০ম পাতায় ‘নারীর উন্নয়নে জিডিপি’র ৪.৭৩% বরাদ্দ’ শিরোনামে একটি রিপোর্ট করেছে। এটি একজন নির্বোধের রিপোর্ট।
রিপোর্টটি নিয়ে অর্থমন্ত্রী প্রশ্ন তুললেও রিপোর্টের পুরো তথ্য প্রস্তাবিত বাজেট ডকুমেন্ট থেকেই নেয়া। এখানে রিপোর্টার বা অন্য কারো কোনো ভাষ্য ছিল না।
বাজেটে ডকুমেন্টে ‘জেন্ডার বাজেট প্রতিবেদন ২০১৬-১৭’ শীর্ষক পৃথক প্রকাশনার সপ্তম পৃষ্ঠায় জেন্ডার বাজেটের বর্ণনা দিয়ে বলা হয়, ২০০৯-১০ অর্থবছরে নারী উন্নয়নে মোট বাজেট বরাদ্দ ছিল ২৭,২৪৮ কোটি টাকা, যা ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ৭১,৮৭২ কোটি টাকায়। ২০১১-১২ হতে ২০১৫-১৬ মোট পাঁচ অর্থবছরে গড়ে প্রায় ১৭ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। মোট জাতীয় বাজেট বরাদ্দের তুলনায় নারী উন্নয়নে বরাদ্দ হয়েছে গড়ে প্রায় ২৭ শতাংশ। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে নারী উন্নয়নে বরাদ্দ হয়েছে ৯২,৭৬৫ কোটি টাকা, যা মোট বাজেট বরাদ্দের ২৭.৫ শতাংশ এবং জিডিপির ৪.৭৩ শতাংশ। একই পৃষ্ঠায় অর্থ বিভাগের আরসিজিপি ডাটাবেজভিত্তিক সারণিতেও একই তথ্য উল্লেখ করা হয়।