জাহিদ হাসান/আনোয়ার হোসেন, গাজীপুর থেকে ফিরে: গাজীপুর জেলায় ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগ শক্তিশালী। দৃশ্যত কোন কোন্দল নেই। কিন্তু ভেতরে ভেতরে একের মধ্যে তিন। তিন আর চার যাই হউক, মশকারী করে এগিয়ে দিয়ে পতন ঘটানোর পর আবার উত্থান হওয়ায় গাজীপুর মহানগর আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদককে নিয়ে সিনিয়র নেতারা ঝুঁকিতে রয়েছেন। কখন জাহাঙ্গীর আলম মেয়র, এমপি বা মন্ত্রী পরিষদে প্রবেশ করে যায় এই জন্য সিনিয়র নেতাদের মধ্যে উত্থানের ঝুঁকি দিন দিন বাড়ছে। একই ধরণের ঝুঁকি আছে জেলা আওয়ামীলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ইকবাল হোসেন সবুজকে নিয়ে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, গাজীপুর জেলায় বর্তমানে ৫জন এমপি রয়েছেন তারা সকলেই ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগের। ৫জনের মধ্যে দুই জন মন্ত্রী পরিষদের সদস্য। একজন পূর্ন মন্ত্রী ও অপরজন প্রতিমন্ত্রী। আর একজন মন্ত্রী পরিষদের সাবেক সদস্য। একজন রয়েছেন সাবেক স্বরাষ্ট্রপ্রতিমন্ত্রীর ভাই। মহানগরের সভাপতি এড. আজমত উল্লাহ খান ও সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলমের মধ্যে রাজনৈতিক মিল আছে কিন্তু পারস্পরিক মিল নেই। মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকির মধ্যে একই অবস্থা। অনেকটা প্রকাশ্যে বিরোধ আছে মন্ত্রী মোজাম্মেল হক ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী এড. রহমত আলীর মধ্যে। বলা যায় শ্রীপুর আওয়ামীলীগ দুই ভাগেই বিভক্ত। কাপাসিয়ার এমপি সিমিন হোসেন রিমি যেন কোন ফাঁকে মন্ত্রী পরিষদে ঢুকে না যায় সে জন্য একটি ভয় বর্তমান মন্ত্রী পরিষদ সদস্যদের রয়েছে।
এ ছাড়া কাপাসিয়ায় আওয়ামীলীগ প্রকাশ্যেই দুই ভাগে ভাগ হয়ে আছে। এমপি গ্রুপ আর এমপির অপছন্দনীয় আওয়ামীলীগ গ্রুপ। ফলে গাজীপুর জেলা আওয়ামীলীগে একের ভেতরে তিন বা চারও আছে। এই কারণে সারা জেলায় কোথাও ক্ষমতাসীন দলের কোন কোন নেতা কর্মী জেল জুলুম খাটছেন। আবার এর চেয়ে কম পদ পদবীর নেতা ও কর্মীরা সাদা পাঞ্জাবী ইস্ত্রি করে মুজিব কোট পরিধান করার পর নিজের প্রাইভেট গাড়িতে উঠছেন। সুতরাং আভ্যন্তরীন কোন্দলে আওয়ামীলীগের মধ্যে প্রায়ই ঝগড়া বিবাদ খুন খারাপি হয়ে থাকে।
প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রিয় নেতা ছিলেন জাহাঙ্গীর আলম। তাকে জেলা আওয়ামীলীগের সিনিয়র নেতারা মূল্যায়ন করতেন অনেক। টাকা পয়সারও অনেক মালিক হওয়ায় জাহাঙ্গীর আলম আওয়ামীলীগের রাজনীতিতে একটি ভাল অবস্থান তৈরী করেন। গাজীপুর মহানগর সহ প্রায় সারা জেলায় জাহাঙ্গীর আলম বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অনুদান দিয়ে আলোচনায় চলে আসেন। এক সময় সারা জেলায় হৈ চৈ পড়ে যায় জাহাঙ্গীর ভবিষৎ কি হবেন এই নিয়ে।
জাহাঙ্গীর আলম ২০০৯ সালে গাজীপুর সদর উপজেলা থেকে ভাইসচেয়ারম্যান পদে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের সকল ভাইসচেয়ারম্যান থেকে বেশী ভোট পান। আর এই বিজয়ের মধ্য দিয়ে তিনি চলে আসেন আলোচনার কেন্দ্র বিন্দুতে। পরবর্তি সময় জাহাঙ্গীর আলম ভাইসচেয়ারম্যান পদ থেকে পদত্যাগ করে গাজীপুর সিটিকরপোরেশনে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্ধিতা করেন। দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে তিনি স্বতন্ত্র নির্বাচন করেন। অতপর আনারস প্রতীক নিয়ে মাঠে যাওযার সঙ্গে সঙ্গে আওয়ামীলীগ টঙ্গী থেকে জাহাঙ্গীরকে তুলে নিয়ে যায় অজ্ঞাত স্থানে। এরপর নানা নাটকীয়তার মধ্য দিয়ে জাহাঙ্গীর আলমকে আওয়ামীলীগের মনোনয়ন প্রাপ্ত মেয়র প্রার্থী এড. আজমত উল্লাহ খানের পক্ষে কাজ করানো হয়। কিন্তু মহানগরের ভোটাররা জাহাঙ্গীর আলমকে প্রতীক দিয়েও আওয়ামীলীগ তাকে কেন নির্বাচন করতে না দিয়ে আজমত উল্লাহ খানের পক্ষে জোর করে নিলেন এর প্রতিবাদ করেন মহাসড়ক অবরোধ করে। কিন্তু নীরব বিপ্লব হয়ে যায় তখন যখন আজমত উল্লাহ খান বিপুল ভোটে বিএনপির অধ্যাপক এম এ মান্নানের কাছে হেরে যান। এতে দলীয় মনোনয়ন নিশ্চিত হওয়ার আগ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রী মোজাম্মেল হক জাহাঙ্গীরের পক্ষে ছিলেন ও পরে আজমত উল্লাহ খানের পক্ষে চলে যান।
এরপর শুরু হয় গাজীপুর আওয়ামীলীগে নতুন মেরু করণ। নির্বাচনের পর জাহাঙ্গীর আলমকে পরাজয়ের জন্য দোষী করে তাকে দলীয় কোন অনুষ্ঠানে পর্যন্ত ডাকে নি গাজীপুর আওয়ামীলীগ। পরবর্তি সময় গাজীপুর মহানগর আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক পদে দলীয় সভানেত্রী জাহাঙ্গীর আলমকে নিয়োগ দেন। ফলে জাহাঙ্গীর আলম আবার চলে আসেন জনসমক্ষে। এখন তিনি গাজীপুর আওয়ামীলীগের জনপ্রিয় নেতা। জাহাঙ্গীর আলম ভবিষৎ গাজীপুর সিটিকরপোরেশনের মেয়র বা কোন আসনের এমপি প্রার্থী এতে কারো কোন সন্দেহ নেই। এই স্তর থেকে জাহাঙ্গীর আলম মন্ত্রী পরিষদে যাবেন এমনটিও মনে করেন স্থানীয় আওয়ামীলীগ। ফলে গাজীপুর জেলা আওয়ামীলীগের সিনিয়র নেতারা ভবিষৎতে জাহাঙ্গীরকে নিয়ে পদ প্রতিযোগীতায় বড়ই ঝুঁকিতে আছেন।
দলীয় কোন্দলের জের ধরে জাহাঙ্গীর নাটকের মতই আরো একটি নাটক শ্রীপুরে মঞ্চস্থ করে গাজীপুর জেলা আওয়ামীলীগ। মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রী পন্থী গাজীপুর জেলা আওয়ামীলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও শ্রীপুর উপজেলা চেয়ারম্যান ইকবাল হোসেন সবুজ কে দ্বিতীয় বারের চলমান নির্বাচন থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। কারণ স্থানীয় এমপি ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী এড. রহমত আলী সমর্থন দিয়েছিলেন আঃ জলিল নামে এক আওয়ামীলীগ নেতাকে। তাই মন্ত্রীর লোক সবুজকে রাজনৈতিক বলি দিয়ে জলিলকে চেয়ারম্যান করেন এমপি । বর্তমানে ইকবাল হোসেন সবুজ গাজীপুর-৩(শ্রীপুর) আসনে আওয়ামীলীগের দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশা করে এমপি প্রার্থী হবেন এটা পরিস্কার।
কালিয়াকৈর উপজেলা চেয়ারম্যান পদেও দলীয় কোন্দলে নাটক হয়েছে। দলীয়ভাবে সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিন শিকদার মনোনয়ন পাননি। এই নিয়ে কালিয়কৈরে দলীয় কোন্দল রয়েছে চরমে। চলমান ইউপি নির্বাচনে আপন ভাইয়ের পক্ষে কাজ করায় কামাল উদ্দিন শিকদার তার স্বদলীয় প্রতিপক্ষ বর্তমান কালিয়াকৈর উপজেলা চেয়ারম্যান রেজাউল করিম রাসেলকে দল থেকে বহিস্কারও করেছেন।
সব মিলিয়ে গাজীপুর জেলা আওয়ামীলীগের দলীয় কোন্দল চরমে থাকলেও প্রকাশ্যে প্রদর্শন হয় না। তবে রাজনৈতিক মাঠে এর বিরুপ প্রভাব বিদ্যমান। বিশেষ করে দলীয় প্রধান ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে ডেকে নিয়ে গোপন সমঝোতা করে জাহাঙ্গীর আলম ও ইকবাল হোসেন সবুজকে চলমান নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে নির্দেশ দেন। আর তারা দলীয় প্রধানের নির্দেশে নির্বাচনে প্রতীক নিয়েও আওয়ামীলীগের দলীয় মনোনয়ন প্রাপ্তদের পক্ষে কাজ করে নিজেদের রাজনৈতিকভাবে বিসর্জন দেন। এর ফলাফলে দেখা যায় দলীয় প্রধান জাহাঙ্গীর আলমকে ডেকে নিয়ে গাজীপুর মহানগর আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক করেন। আর দলীয় নেত্রীর প্রতিশ্রুত পুরস্কারের অপেক্ষায় আছেন ইকবাল হোসেন সবুজ। ফলে সবুজ ও জাহাঙ্গীর গাজীপুর জেলা আওয়ামীলীগের সিনিয়র নেতাদের মাথা ব্যাথার কারণ হয়ে রয়েছেন। কারণ কখন দলীয় প্রধানের নির্দেশে সবুজ ও জাহাঙ্গীর কোন পদ বা মনোনয়ন পেয়ে যান ওই আতঙ্কে।