রিজার্ভ চুরির ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটি চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছে। ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সম্পৃক্ততা ছিল বলে সাবেক গভর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের নেতৃত্বে গঠিত কমিটির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। জড়িতদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি দেয়ার সুপারিশ করেছে তদন্ত কমিটি। জড়িত কর্মকর্তাদের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড বাজেটিং ডিপার্টমেন্টের অধীন ‘ব্যাক অফিস অব দ্য ডিলিং রুম’ শাখার একজন, উপ-পরিচালক চারজন ও গভর্নর সচিবালয় বিভাগের একজনের নাম উল্লেখ করা
রয়েছে। তাদের দায়িত্বজ্ঞানহীনতার কারণে হ্যাকিংয়ের ঘটনাটি সম্পন্ন হতে সহায়তা করেছে বলে তদন্তে তুলে ধরা হয়েছে। এ ছাড়া এদের মধ্যে দুজনের ইউজার আইডি ও পাসওয়ার্ড অপরাধীদের হাতে দিয়েছিলেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র নিশ্চিত করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা বলেন, প্রতিবেদনে যাদের নাম এসেছে অচিরেই তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। তিনি বলেন, প্রথমে সাময়িক বরখাস্ত করা হবে। তারপর তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র শুভঙ্কর সাহা এ বিষয়ে কোনো কিছু বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের অর্থ চুরি নিয়ে গঠিত কমিটি তাদের পূর্ণাঙ্গ তদন্ত প্রতিবদেন গতকাল অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের কাছে জমা দিয়েছেন। আগামী ১৫ থেকে ২০ দিনের মধ্যে এ তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করা হবে বলে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। এ সময় কমিটির প্রধান ফরাসউদ্দিন জানান, রিজার্ভ চুরির ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে।
ঘটনার পর ১৫ই মার্চ ড. ফরাসউদ্দিনকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে সরকার। কমিটিকে ৩০ দিনের মধ্যে অন্তর্বর্তীকালীন ও ৭৫ দিনের মধ্যে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়।
গত ৪ঠা ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক থেকে সুইফট কোডের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রায় ১০১ মিলিয়ন ডলার চুরি করে নেয় হ্যাকাররা। এর মধ্যে ২০ মিলিয়ন ডলার চলে যায় শ্রীলঙ্কা ও ৮১ মিলিয়ন ডলার চলে যায় ফিলিপাইনে।
ফরাসউদ্দিনের পূর্ণাঙ্গ তদন্ত প্রতিবদেন অনুযায়ী, সুইফট সার্ভারের পাসওয়ার্ড নকল করতে অপরাধীদের সহায়তা করেছেন অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড বাজেটিং ডিপার্টমেন্টের দুই কর্মকর্তা। তবে হ্যাকাররা রিজার্ভের ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার চুরি করতে একই বিভাগের আরেক কর্মকর্তার আইডি ও পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে। হ্যাক হওয়ার আগে সর্বশেষ সার্ভারটি ব্যবহার করেছিলেন এদের একজন, তাই হ্যাকাররা রেকনিসেন্স ও ভেরিফিকেশন করে তাদের আইডি পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে অর্থ হাতিয়ে নেয়। এতে বলা হয়েছে, রিজার্ভ চুরির ঘটনায় ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউ ইয়র্ক, সুইফট ও ফিলিপাইনের রিজাল ব্যাংকেরও দায় রয়েছে।
গত বছর নভেম্বরে সুইফটের প্রতিনিধি হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকে আসেন নিলাভান্নান। তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, নিলাভান্নান ছিলেন সুইফটের ভুয়া প্রতিনিধি। তিনি এসে সুইফট সার্ভার ব্যবহারকারীদের আইডি ও পাসওয়ার্ড নকল করে নেন। রিজার্ভ চুরির ঘটনায় নিলাভান্নানকে প্রধানতম অপরাধী বলে চিহ্নিত করেছে তদন্ত কমিটি।
তবে চুরির ঘটনা সরকারের কাছে গোপন রাখার কোনো যুক্তি খুঁজে পায়নি ড. ফরাসউদ্দিনের নেতৃত্বে করা তদন্ত কমিটি। গোপন করার বিষয়টিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের তদানীন্তন গভর্নর, ডেপুটি গভর্নরগণ গর্হিত অপরাধ করেছেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
চুরি হওয়া অর্থ উদ্ধারের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও কূটনৈতিক কৌশলী তৎপরতার সাহায্যে অত্যন্ত যোগ্য আইনি পদক্ষেপের মাধ্যমে সমন্বিত উদ্যোগ নেয়ার পরামর্শ দিয়া হয়েছে কমিটির পক্ষ থেকে।
এদিকে বিবিসি বাংলাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ফরাসউদ্দিন বলেছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকেরই অল্প কিছু লোক জেনেই হোক আর অজান্তেই হোক সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। তিনি বলেন, এটার ব্যাপারেই আরো অনুসন্ধান হচ্ছে যে এই দু-একজন কি জেনে কাজটা করেছে নাকি বোকমি করেছে। তিনি ইঙ্গিত দেন যে, এদের চিহ্নিত করা হয়েছে। তবে তারা উচ্চপদের কেউ কি-না তা বলতে রাজি হননি।
তদন্ত কমিটির প্রধান ফরাসউদ্দিন বলেন, ওই ঘটনার জন্য সুইফট-সহ দেশের বাইরের কিছু প্রতিষ্ঠান এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তার সম্পৃক্ততার প্রমাণ পেয়েছেন তারা। তিনি বলেন, সুইফটের গাফিলতি আছে। তাদের ইঞ্জিনিয়াররা সুইফট ও আরটিজিএস নামে দুটি আন্তঃব্যাংক অর্থ লেনদেনের ব্যবস্থাকে সংযুক্ত করে দিয়েছে, যার কোনো দরকার ছিল না।
মূল সমস্যা হচ্ছে আরটিজিএসের সঙ্গে সুইফটের কানেকশন এবং ওই সংযোগের সুরক্ষাকবচ উঠিয়ে দেয়া। এটা না হলে ওই ঘটনা ঘটতো না। সুইফটের অনুরোধেই এটা করার হয় এবং করার সময় কিছু সুরক্ষা ফিচার নষ্ট করে ফেলে দেয়া হয়। এটা দেখেই আন্তর্জাতিক সাইবার অপরাধীরা প্ল্যান করে এই চুরিটা সংঘটিত করে।
ফরাসউদ্দিন বলেন, যে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে আমরা দায়ী বলে মনে করেছিলাম, তাদের দায় কমেছে বলে মনে হয় না। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের কিছু লোকের সম্পৃক্ততা আমরা পেয়েছি।
এই যে বাইরের সাইবার ক্রিমিনালরা এই চুরি করেছে, এতে বাংলাদেশ ব্যাংকের কিছু লোক জেনে হোক বা অজান্তেই হোক তা ‘ফ্যাসিলিটেট’ করেছে। সেটারই আরো অনুসন্ধান হচ্ছে যে, তারা জেনে করেছে নাকি বোকামি হিসেবে করেছে।
এদিকে চুরির ঘটনায় দায়ের করা মামলার তদন্তেও বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মীদের সম্পৃক্ততার বিষয়টি ধরা পড়ার কথা জানিয়েছে সিআইডি। তাদের পক্ষ থেকে প্রাপ্ত তথ্য যাচাই-বাছাই চলছে।