তিনি শুধু অভিনয়ই করেননি। অভিনয়ের সঙ্গে সমন্বয় ঘটিয়েছিলেন মেধা এবং বুদ্ধির। আর এ কারণেই তার অভিনয়ে পাওয়া যায় স্বতন্ত্র এক ধারা। যে ধারা অসাধারণ ঔজ্জ্বল্যে ভরপুর। তিনি শক্তিমান অভিনেতা হুমায়ুন ফরীদি। ২০১২ সালের ১৩ই ফেব্রুয়ারি আমরা তাকে হারিয়েছি চিরতরে। কিন্তু দুর্দান্ত নানা কর্ম আর তার অসাধারণ সব সৃষ্টিতে তিনি আছেন চির অমলিন হয়ে। তার দাপুটে অভিনয় তাকে বাঁচিয়ে রাখবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। আজ এই কিংবদন্তির জন্মদিন। ১৯৫২ সালের এই দিনে ভোর ৫টা ৩০ মিনিটে ঢাকার নারিন্দায় জন্মগ্রহণ করেন হুমায়ুন ফরীদি। অভিনয়ের সঙ্গে তার পরিচয় শৈশব থেকে। যদিও এর আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তঃনাট্য প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে। এখানে তিনি ‘আত্মস্থ ও হিরণ¥য়ীদের বৃত্তান্ত’ নামে একটি নাটক লিখেন, নির্দেশনা দেন এবং অভিনয় করেন।
এ নাটকটি পাঁচটি নাটকের মধ্যে সেরা নির্বাচিত হয় বিচারকদের কাছে। এ নাটকের সুবাদে পরিচয় ঘটে ঢাকা থিয়েটারের নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুর সঙ্গে। মূলত এখান থেকে হুমায়ুন ফরীদির অভিনয় যাত্রা শুরু। সেলিম আল দীনের ‘চরকাঁকড়ার ডকুমেন্টারি’ নাটকের প্রোডাকশনে কাজ করেন প্রথম। এরপর একই দলের একই লেখক ও নির্দেশকের ‘সংবাদ কার্টুন’-এ ছোট্ট একটি চরিত্রে সুযোগ পান। তারপর ‘শকুন্তলা’। শকুন্তলার পর ‘ফণীমনসা’, ‘কীত্তনখোলা’, ‘কেরামতমঙ্গল’, ‘মুনতাসীর ফ্যান্টাসি’ এবং ১৯৯০ সালে ‘ভূত’ দিয়ে শেষ হয় হুমায়ুন ফরীদির ঢাকা থিয়েটার জীবন। আর এই ভূতের নির্দেশক ছিলেন তিনি নিজে। মূলত বন্ধু-অভিনেতা আফজাল হোসেনের সাহস এবং উৎসাহে হুমায়ুন ফরীদির টেলিভিশন যাত্রা শুরু হয়। আফজাল হোসেন বন্ধুর কথা ভেবে পর পর অনেক নাটক লেখেন। যদিও টেলিভিশনে অভিষেকটা ঘটে আতিকুল হক চৌধুরীর মাধ্যমে। সেটাও অবশ্য আফজাল হোসেন ও রাইসুল ইসলাম আসাদের সুবাদে। সেলিম আল দীনের রচনা এবং নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুর নির্দেশনায় ধারাবাহিক নাটক ‘ভাঙনের শব্দ শুনি’ দিয়ে বেশ আলোচনায় আসেন ফরীদি। হুমায়ুন ফরীদি টিভি নাটকে প্রথম অভিনয় করেন আতিকুল হক চৌধুরীর প্রযোজনায় ‘নিখোঁজ সংবাদ’-এ।
তার অভিনীত উল্লেখযোগ্য টিভি নাটকের মধ্যে রয়েছে ‘নীল আকাশের সন্ধানে’, ‘দূরবীন দিয়ে দেখুন’, ‘ভাঙনের শব্দ শুনি’, ‘বকুলপুর কতদূর’, ‘মহুয়ার মন’, ‘সাত আসমানের সিঁড়ি’, ‘একদিন হঠাৎ’, ‘চাঁনমিয়ার নেগেটিভ পজেটিভ’, ‘অযাত্রা’, ‘পাথর সময়’, ‘দুই ভাই’, ‘শীতের পাখি’, ‘সংশপ্তক’, ‘কোথাও কেউ নেই’, ‘সমুদ্রে গাঙচিল’, তিনি একজন’, ‘চন্দ্রগ্রস্ত’, ‘কাছের মানুষ’, ‘মোহনা’, ‘বিষকাঁটা’, ‘ভবের হাট’ ও ‘শৃঙ্খল’। প্রথম মঞ্চনাটক কিশোরগঞ্জে মহল্লার নাটকে ১৯৬৪ সালে। প্রথম মঞ্চনাটক নির্দেশনা দেন স্কুলজীবনে রাজস্থানের লোককথা অবলম্বনে ‘ভূত’। প্রথম চলচ্চিত্র অভিনয় তানভীর মোকাম্মেলের ‘হুলিয়া’। এ ছাড়া উল্লেখযোগ্য কয়েকটি ছবি হচ্ছে ‘ভণ্ড’, ‘সন্ত্রাস’, ‘ব্যাচেলর’, ‘জয়যাত্রা’, ‘শ্যামলছায়া’, ‘একাত্তরের যীশু’, ‘মায়ের মর্যাদা’, ‘বিশ্বপ্রেমিক’ ও ‘পালাবি কোথায়’। উল্লেখযোগ্য মঞ্চনাটক ‘মুনতাসীর ফ্যান্টাসি’, ‘ফণীমনসা’, ‘শকুন্তলা’, ‘কীত্তনখোলা’, ‘কেরামত মঙ্গল’ প্রভৃতি। টিভি নাটক অথবা মঞ্চে সেলিম আল দীন এবং নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু জুটির বাইরে হুমায়ুন ফরীদির সর্বাধিক সংখ্যক এবং সর্বাধিক সফল কাজ ছিল হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে।
আর ‘সংশপ্তক’ ধারাবাহিকে তার অভিনীত চরিত্র কান কাটা রমজানের কথা নতুন করে বলার কিছু নেই। ১৯৯০ থেকে শুরু করেন চলচ্চিত্রে যাত্রা। শহীদুল ইসলাম খোকনের ‘সন্ত্রাস’ ছবির মাধ্যমে খলনায়ক চরিত্র শুরু হয় তার। তবে চলচ্চিত্রে অভিনয় ছেড়ে দেয়ার চেষ্টা করেছেন ২০০৩ সাল থেকে। অবশ্য পুরোদমে ছাড়া হয়নি। তিনি ‘মাতৃত্ব’ ছবির জন্য সেরা অভিনেতা শাখায় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন ২০০৪ সালে। নিয়মিত টিভি অভিনয়ের পাশাপাশি হুমায়ুন ফরীদি তেমন একটা লিখতেন না। তবে কিছু টেলিফিল্ম, ধারাবাহিক ও এক ঘণ্টার নাটক নির্মাণ করেছেন। প্রথম স্ত্রী মিনুর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে যাওয়ার পর হুমায়ুন ফরীদি আরেক কিংবদন্তি অভিনেত্রী সুবর্ণা মুস্তাফার সঙ্গে বিয়েবন্ধনে আবদ্ধ হন। বেশ ক’বছর সংসার করার পর ২০০৮ সালে সুবর্ণার সঙ্গেও বিচ্ছেদ হয়ে যায় তার।