সাবেক গভর্নর ও বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ৮০০ কোটি টাকা চুরির ঘটনায় সরকার গঠিত বিশেষ তদন্ত কমিটির প্রধান ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বলেছেন, ২০১৩ সালে দেশ থেকে ৯ বিলিয়ন (৯০০ কোটি ডলার যা স্থানীয় মুদ্রায় ৭২ হাজার কোটি টাকা) ডলার পাচার হয়েছে। তখনকার হিসেবে এটি দিয়ে তিনটি পদ্মা সেতু নির্মাণ করা যেত। তিনি বলেছেন, এটি পাচার করেছে আমাদের দেশেরই মানুষ ও বাইরের কিছু দুষ্টচক্র। টাকা পাচারকারীদের চিহ্নিত করা ও এটি প্রতিরোধ করার ক্ষমতা আমাদের আমলাদের রয়েছে। এটি করার জন্য মিডিয়ার সহযোগিতা প্রয়োজন। মিডিয়াকর্মীদের ক্ষুরধার লেখনী ও ইনভেস্টিগেশনের মাধ্যমে এটি করা সম্ভব। এটি হলে দেশের স্বার্থ রক্ষা হতো, বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বাড়ত।
গতকাল বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটে (পিআইবি) ‘বাজেটবিষয়ক রিপোর্টিং প্রশিণের’ সমাপনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন। পিআইবির সহযোগিতায় তিন দিনের এই প্রশিণ কর্মশালার আয়োজন করে অর্থনীতিবিষয়ক সাংবাদিকদের সংগঠন ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ)। প্রশিণ কর্মশালায় দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমের সংবাদকর্মীরা অংশ নেন।
বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ানোর বিষয়ে ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বলেন, বেসরকারি খাতকে বিনিয়োগে উৎসাহিত করার প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব সরকারের। সরকার তার নীতি-কৌশল পরিবর্তন করে সুযোগ-সুবিধা দিয়ে দেশের স্বার্থ বিশেষ করে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর স্বার্থকে অক্ষুণ্ন রেখে বিনিয়োগকারীদের আনতে পারে। তা না করতে পারাটাই সরকারের ব্যর্থতা; তবে এটি পারা উচিত, সরকারের পক্ষে তা করা সম্ভব বলে তিনি মনে করেন।
ড. ফরাসউদ্দিন বলেন, বিওআইকে বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ডেভেলপমেন্ট অথরিটি করা হয়েছে। এটিকে বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট প্রমোশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অথরিটি করার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, এটিকে অনেক শক্তিশালী করতে ভালো কর্মকর্তাদের নিয়োগ দিতে হবে। এখানে সপ্তাহে পাঁচ দিনই ওয়ান স্টপ সার্ভিস দিতে হবে। এই অথরিটির কাছে কিছুটা বিদ্যুৎ-গ্যাস সংযোগের মতা দেয়া হলে দেশে বিনিয়োগ আরো বাড়বে।
অর্থবছরের সময়সীমা পরিবর্তনের ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক এই গভর্নর বলেন, দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বার্থে জুলাই-জুন অর্থবছরের পরিবর্তে জানুয়ারি-ডিসেম্বর অর্থবছর চালু করা প্রয়োজন। আমাদের এ অঞ্চলে একসময় এটি কার্যকর ছিল। কিন্তু পাকিস্তান আমলে জুলাই-জুন অর্থবছর চালু হয়; যা এখনো চলছে। তিনি বলেন, উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাস্তবায়নের জন্য জানুয়ারিতে অর্থবছর শুরু হওয়া ভালো। ওই সময় বৃষ্টি-বাদল নেই, মানুষের মন প্রফুল্ল থাকে। মে-জুন মাসে মাটির কাজ শুরু করলাম, পানির নিচে চলে গেলে। বিল করলাম, টাকা তুললাম; এটি বড় ধরনের লুট। এতে সুবিধাবাদীরাই এটির বিরোধিতা করে। এটির পরিবর্তন না হওয়া শুধু রাজনৈতিক ব্যাপার নয়, ব্যবসায়িক স্বার্থও অনেক বেশি বলে তিনি মনে করেন।
তিনি সাপ্তাহিক ছুটির বিষয়ে বলেন, আমাদের দেশে সাপ্তাহিক ছুটি শুক্র ও শনিবার। অন্য দেশগুলোতে রোববার ছুটির দিন থাকায় আন্তর্জাতিক বাজারের সাথে সপ্তাহে মাত্র চারটি কার্যদিবস পাই আমরা। পৃথিবীর সব দেশে পাঁচ দিনে সপ্তাহ হলেও শুধু আমরাই সেটি পাই না। এটি ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য অনেক তিকর। এটি পরিবর্তন হওয়া প্রয়োজন। ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে সপ্তাহে পাঁচ দিন কার্যদিবস আটকে রাখা হচ্ছে বলে তিনি মনে করেন। তিনি বলেন, শুধু মালয়েশিয়া নয়, মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশেও শুক্রবার কার্যদিবস রয়েছে।
দেশের ব্যাংকিং খাত সম্পর্কে সাবেক এই গভর্নর বলেন, সরকারি ব্যাংকগুলো বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেয়া উচিত। তবে সরকারের ট্রেজারি হিসেবে সোনালী ব্যাংক রেখে বাকিগুলো ধাপে ধাপে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেয়া উচিত। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর বিষয়ে ড. ফরাসউদ্দিন বলেন, দেশের বেসরকারি ব্যাংকগুলো স্পেড মানে না। এসব ব্যাংকের কস্ট অব ফান্ড সাড়ে ৩ শতাংশ। এর সাথে সাড়ে ৩ শতাংশ স্পেড যোগ করেও তাদের ঋণের সুদহার ৮ শতাংশের বেশি হওয়া উচিত না। কিন্তু কয়েকটি ব্যাংক এ রেটে লোন দেয়। আমি বেসরকারি ব্যাংকের বিরোধী নই, তবে ফেয়ারনেস চাই।
ই-কমার্স সেক্টরকে করের আওতায় আনার আহ্বান জানিয়ে ড. ফরাসউদ্দিন বলেন, সবাই এখন এ দিকে ঝুঁকছে। ঘরে বসেই কেনাকাটা করতে চাচ্ছে। কিন্তু এর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই, কোনো ভ্যাট দিতে হয় না। কত বিক্রি হলো, কত প্রবৃদ্ধি হলো তার কোনো হিসাব নেই। আমি বলব এ খাতকে করের আওতায় আনেন, অনেক রেভিনিউ আসবে।
আমাদের দেশের কোনো কাজেই স্বচ্ছতা নেই উল্লেখ করে ফরাসউদ্দিন বলেন, দেশে যেকোনো বড় প্রকল্প নেয়ার আগে এর সম্ভাব্যতা যাচাই করে নিতে হবে। শুধু একজন বা দু’জন অথবা ক্যাবিনেটের সিদ্ধান্তে কোনো বড় প্রকল্প নেয়া উচিত না। জাতীয় সংসদে অনাস্থা প্রস্তাব ও জাতীয় বাজেট পাস ছাড়া বাকি সব ক্ষেত্রে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদটি বাদ দেয়া উচিত বলে তিনি মনে করেন।
অর্থ বিভাগের কাজের গতি ও সমন্বয় আনার প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করে সাবেক এই গভর্নর বলেন, দেশের উন্নয়ন ও অর্থনীতির স্বার্থে অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় একজনের হাতে থাকা উচিত। তিনি বলেন, বর্তমানে অর্থমন্ত্রী ও পরিকল্পনামন্ত্রীর মধ্যে বিভিন্ন সময় যে বাদানুবাদ হয় তা আমাদের ভালো লাগে না। তিনি বলেন, অতীতেও একই ব্যক্তির হাতে অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় ছিল। সেটিই ভালো।
সেমিনারে ইআরএফের সভাপতি সাইফ ইসলাম দিলাল, সাধারণ সম্পাদক জিয়াউর রহমান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
– See more at: http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/122493#sthash.UJ5SUfW5.dpuf