রমজান মাসকে কেন্দ্র করে প্রতি বছরই বেড়ে যায় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম। এর মধ্যে চাহিদার শীর্ষে থাকা ছোলা, চিনি, পিয়াজ, খেজুর, বেগুন ও রসুনের দাম বাড়ে বেশি। তবে বাজার বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গত রমজান থেকে এবারের রমজানের আগ পর্যন্ত পণ্যভেদে দাম বেড়েছে ১০০ ভাগ পর্যন্ত। সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) পরিসংখ্যান ও রাজধানীর বাজার ঘুরে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। ব্যবসায়ীরা জানান, রমজান সামনে রেখে পাইকারি বাজারে দাম বাড়ার কারণে খুচরা বাজারে প্রভাব পড়ছে। আর অসাধু ব্যবসায়ীরা কৌশল অবলম্বন করে রমজানের প্রায় দেড় মাস আগেই পণ্যগুলোর দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। কাওরানবাজার, মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেট, টাউন হল, নিউ মার্কেট, শান্তিনগর, হাতিরপুল, মিরপুর শাহ আলী কাঁচাবাজার, মোহাম্মদপুর টাউন হল মার্কেটসহ রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে ক্রেতা, খুচরা বিক্রেতা, পাইকারি ব্যবসায়ী ও আড়তদারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ছোলা, চিনি, মসুর ডাল, মাংসসহ কিছু পণ্যের দাম আরো আগেই বেড়েছে। একই সঙ্গে বেগুন ও অন্য সবজির দামও বেড়েছে। দাম বাড়ার জন্য খুচরা ব্যবসায়ীরা দুষছেন পাইকারি ও আড়তদারদের। আবার পাইকারি ব্যবসায়ী ও আড়তদাররা অভিযোগ অস্বীকার করে দুষছেন খুচরা ব্যবসায়ী, মিল মালিক ও সরবরাহকারীদের।
টিসিবির তথ্য অনুযায়ী, গত এক মাসের ব্যবধানে ভোক্তা পর্যায়ে ছোলার দাম বেড়েছে ৫০ ভাগ। প্রতিষ্ঠানটির তথ্যে দেখা যায়, গত মাসে ছোলা প্রতিকেজি বিক্রি হয়েছে ৭৮ থেকে ৮৪ টাকা। বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ৮৫ থেকে ১০০ টাকায়। আর গত বছর রমজানের আগে প্রতিকেজি ছোলার দাম ছিল ৬০ থেকে ৬৫ টাকা। অর্থাৎ টিসিবির হিসাব অনুযায়ী এক বছরে ছোলার দাম প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। ছোলার দাম বৃদ্ধির বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ বলতে পারছেন না তারা। তবে রমজানকে সামনে রেখে অসাধু ব্যবসায়ীরা ফায়দা লুটছে বলে অনেকেই জানান। সূত্র জানায়, প্রতি মাসে দেশে ছোলার চাহিদা প্রায় ১২ হাজার টন। রমজান মাসে বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৬৫ থেকে ৭০ হাজার টনে। মিরপুর শাহ আলী কাঁচাবাজারে ভালো মানের প্রতি কেজি ছোলা ৯৫ থেকে ১০০ টাকায় বিক্রি করতে দেখা গেছে গতকাল। ক্রেতারা বলছেন, গত বছরের রমজানে যে ছোলা তালা ৬০ থেকে ৭০ টাকায় কিনেছিলেন, এ বছরের রমজানে একই ছোলা প্রায় ৪০ টাকা বেশি দামে কিনছেন। একই সঙ্গে রসুন কিনছেন দ্বিগুণেরও বেশি দাম দিয়ে। এদিকে মাত্র দুদিনের ব্যবধানে চিনির দামও কেজিতে ২ থেকে ৫ টাকা বেড়েছে বলে জানালেন ক্রেতারা।
গত এক মাস ধরেই অস্থির রয়েছে ডাল জাতীয় পণ্যের দর। এক বছরে মসুর ডালের দাম কেজিতে বেড়েছে ২০ থেকে ৩০ টাকা। টিসিবির তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে প্রতি কেজি মসুর ডাল ১০০ থেকে ১৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এক বছর আগের রমজানে একই সময়ে এর প্রতিকেজি দর ছিল ৯০ থেকে ১১০ টাকা। অর্থাৎ এক বছরে বেড়েছে ২০ থেকে ৩০ টাকা। এর মধ্যে তুরস্ক-কানাডার (বড় দানা) মসুর ডাল প্রতিকেজি বেড়েছে ১৫ থেকে ২০ টাকা। তুরস্ক-কানাডার (মাঝারি) মসুর ডাল প্রতিকেজি বেড়েছে ১৩ থেকে ১৮ টাকা। দেশি মসুর ডাল প্রতিকেজি বেড়েছে ২৫ থেকে ৩০ টাকা। আর নেপালি মসুর ডাল প্রতিকেজি বেড়েছে ২০ থেকে ২৫ টাকা।
এদিকে বাজারে প্রতিকেজি মসুর ডাল (দেশি) বিক্রি হচ্ছে ১৪০ টাকা থেকে ১৪৫ টাকায়, নেপালি মসুর ডাল বিক্রি হচ্ছে ১৪৫ টাকা থেকে ১৫০ টাকায়। কানাডার বড় দানার মসুর বিক্রি হচ্ছে ৯০ থেকে ৯৫ টাকায়। অস্ট্রেলিয়ান ছোট দানার মসুর বিক্রি হচ্ছে ১০০ থেকে ১১০ টাকা। মটর ডাল বিক্রি হচ্ছে ৪২ থেকে ৪৩ টাকা। মিরপুর শাহ আলী কাঁচাবাজারের রাসেল ভ্যারাইটিজ স্টোরের মালিক মো. আবুল হোসেন জানান, সব ধরনের ডালের দাম কেজিতে ৪০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। এর মধ্যে খেসারি ডালের দাম ৪০-৪৫ টাকা থেকে বেড়ে ৮০ টাকায় ঠেকেছে।
বর্তমানে খুচরা বাজারে প্রতিকেজি চিনি বিক্রি হচ্ছে ৫৮ টাকা থেকে ৬২ টাকায়, যা গত সপ্তাহে বিক্রি হয়েছিল ৫৫ টাকা থেকে ৫৮ টাকা। এক মাস আগেও চিনি বিক্রি হয়েছে ৫০ থেকে ৫৫ টাকা। অন্যদিকে টিসিবির হিসাবে দেখা যায়, গত বছর রমজানের আগে চিনির কেজিপ্রতি দর ছিল ৪০ থেকে ৪২ টাকা। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানটির হিসাবেই কেজিতে প্রায় ৫০ ভাগ দর বেড়েছে।
মিরপুর শাহ আলী কাঁচাবাজার ও মোহাম্মদপুর টাউন হল কাঁচাবাজারে ৫৮ থেকে ৬০ টাকা দরে চিনি বিক্রি করেছেন বিক্রেতারা। যদিও ক্রেতা ও খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, বাজারে চিনির যথেষ্ট মজুদ ও সরবরাহ থাকার পরও চিনির দাম বাড়ার কোনই কারণ নেই। তবে সরবরাহকারীরা বলছেন, মিল মালিকরা হঠাৎ করেই চিনির সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছেন। এতে বাধ্য হয়ে তারা বেশি দামে চিনি কিনছেন। যার প্রভাব পড়েছে খুচরা বাজারে। মিরপুর শাহ আলী কাঁচাবাজারের পাইকারি চিনি বিক্রেতা হযরত শাহজালাল ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী মো. বাবু জানান, প্রতি বস্তা (৫০ কেজি) চিনিতে হঠাৎ করেই ১০০ টাকা বাড়িয়ে দিয়েছেন মিল মালিকরা। যে কারণে খুচরা বাজারে কেজিতে ২ টাকা বেড়ে গেছে। মিল মালিকরা নানা অজুহাতে চিনি সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছেন। যার প্রভাব পড়েছে বাজারে। তবে রোজার আগেই সরবরাহ বেড়ে গেলে দাম ঠিক হয়ে যাবে বলে জানান তিনি।
বাজারে দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে কেজিপ্রতি ৩৫ থেকে ৪৫ টাকা। গত সপ্তাহে এটি বিক্রি হয়েছে ৩৮ থেকে ৪০ টাকা কেজি দরে। আর আমদানি করা পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ২৮ থেকে ৩৫ টাকা কেজি দরে। এটিও গত সপ্তাহ থেকে কেজিপ্রতি ২/৩ টাকা হারে বেড়েছে। তবে টিসিবির হিসাবে, বছরওয়ারি পণ্যটির দাম না বাড়লেও মাসিক ভিত্তিতে বেড়েছে ১৫ থেকে ২০ টাকা। গত মাসে আমদানি করা পেঁয়াজে কেজিতে বেড়েছে ১৫ থেকে ২০ টাকা। আর গত বছর রমজানের আগে পণ্যটির কেজিপ্রতি দাম ছিল ৩০ থেকে ৪০ টাকা।
উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে আমদানি করা রসুনের দাম। একই সঙ্গে বেড়েছে দেশি রসুনের দামও। টিসিবির হিসাবে, এক বছরে পণ্যটির দাম বেড়েছে ১০০ ভাগের বেশি। গত বছর রমজানের আগে প্রতিকেজি দেশি রসুন বিক্রি হয়েছিল ৬০ থেকে ৮০ টাকা। আর একই সময়ে আমদানি করা রসুন প্রতিকেজির দাম ছিল ৯০ থেকে ১০০ টাকা। অর্থাৎ দেশি রসুন কেজিতে বেড়েছে ৬৭ টাকা। আর আমদানি করা রসুন কেজিতে বেড়েছে ১১৫ টাকা। বাজারে বর্তমানে দেশি রসুন বিক্রি হচ্ছে কেজিপ্রতি ১০০ থেকে ১৫০ টাকা। গত মাসে এটি বিক্রি হয়েছে ৮০ থেকে ২০০ টাকা কেজি দরে। অর্থাৎ টিসিবির হিসাবে, এক মাসে পণ্যটির কেজিতে বেড়েছে ৩০ থেকে ৪০ টাকা। আর আমদানি করা রসুন বিক্রি হচ্ছে ১৯০ থেকে ২২০ টাকা কেজি দরে। এটিও গত মাসে কেজিপ্রতি বিক্রি হয়েছে ১৭০ থেকে ১৯০ টাকায়।
রমজানে ইফতারে অত্যাবশ্যক পণ্য বেগুন। কিন্তু প্রতি রোজাতেই বেগুনের দাম হয় আকাশচুম্বী। রমজান আসতে বেশ কিছুদিন বাকি থাকলেও গতকাল রাজধানীর মিরপুর ও মোহাম্মদপুর এলাকার কাঁচাবাজারগুলোতে দেখা গেছে, বেগুনের দাম ইতিমধ্যে বাড়া শুরু হয়েছে। অন্য সবজিও ৪০ থেকে ৬০ টাকার নিচে মিলছে না। মোহাম্মদপুর টাউন হল কাঁচাবাজারে গতকাল প্রতি কেজি লম্বা বেগুন বিক্রি হয়েছে ৫০ টাকা করে। এছাড়া খয়েরি ও সবুজ রংয়ের গোল বেগুন বিক্রি হয়েছে যথাক্রমে ৭০ ও ৬০ টাকা করে। সবজির দাম বাড়ার কারণ জানতে চাইলে কয়েকজন সবজি ব্যবসায়ী বৃষ্টি ও বর্ষাকালের বিষয়টি উল্লেখ করেন। এই বাজারের সবজি ব্যবসায়ী রাশেদ বলেন, রোজা সামনে রেখে বাজারে বেগুন আসতে শুরু করেছে। কিন্তু আড়তদার ও সরবরাহকারীদের কাছ থেকে বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। তারা বাজারে সরবরাহও করছে কম। যে কারণে আমাদের বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। এ অবস্থা রমজানেও বহাল থাকতে পারে বলে জানান রাশেদসহ বেশ কয়েকজন সবজি বিক্রেতা।
মিরপুর ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক হাজী আতিকুর রহমান মানবজমিনকে বলেন, ইতিমধ্যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ ৮টি সংস্থার সঙ্গে আমাদের বৈঠক হয়েছে। রমজানে ভোক্তারা যাতে ন্যায্যমূল্যে ভোগ্যপণ্য কিনতে পারেন সেজন্য ব্যবসায়ী সমিতি থেকে উদ্যোগ নেয়া হবে। অসাধু ব্যবসায়ীরা যাতে কারসাজি করে পণ্যের দাম বাড়াতে না পারে সেজন্য বাজার মনিটরিংয়ে ব্যবসায়ী সমিতি বিভিন্ন সংস্থাকে সহযোগিতা করবে।