সন্তানের জননী রোজিনা। গত ৮ই মার্চ গৃহকর্মীর কাজ নিয়ে গিয়েছিলেন সৌদি আরব। কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখেন ভিন্নচিত্র। বাসাবাড়িতে কাজে দেয়নি দালালরা। তাকে দিয়ে অসামাজিক কার্যকলাপ করতে চাপ প্রয়োগ করা হয়। এসব কাজে অস্বীকৃতি জানিয়ে তিনি বাড়িতে ফিরতে চান। এরপরও তাকে আটকে রাখা হয়। অবশেষে পরিবারে লোকজন জানতে পেরে সংশ্লিষ্ট অফিসে গিয়ে চাপ প্রয়োগ করলে তাকে ফেরত পাঠায় সংশ্লিষ্ট এজেন্সি। রোজিনার মা জানান, গৃহকর্মীর কথা বলে তার মেয়েকে নিয়ে গেলেও ওই কাজ দেয়া হয়নি। তাকে একটি অফিসে আটকে রাখে। দালালরা তাকে অন্য জায়গায় বিক্রি করে দেয়। অপকর্ম করাতে চায়। কিন্তু মেয়ে কান্নাকাটি করে তাদের হাত থেকে রেহাই পেয়েছে। রোজিনার মা আরো জানান, এ খবর জানার পর আমরা লোকজন নিয়ে ফকিরাপুলের অফিসে গেলে তারা ফেরত আনতে বাধ্য হয়। গত ২৩শে এপ্রিল তিনি ফেরত আসেন। ফেরত আসা আরো কয়েকজন জানান, তারা যে ক্যাম্পে ছিল সেখানে এখনো অনেকে বাংলাদেশি নারীকর্মী অবস্থান করছেন। তাদের অনেকের ওপরই নির্যাতন করা হয় বলে ফেরত আসা কর্মীরা জানান। তারা সবাই ফেরত আসতে চান। এদের অনেকের কাছ থেকেই এজেন্সি বিপুল পরিমাণ টাকা নিয়ে বিদেশে পাঠিয়েছে।
সূত্র জানায়, গত ৪ঠা এপ্রিল একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের একজন সাংবাদিক দেশটিতে আটক ৯৫ নারীকর্মী উদ্ধার প্রসঙ্গে ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের মহাপরিচালকের কাছে একটি আবেদন করেন। ওই আবেদনে তিনি উল্লেখ করেন, সৌদি আরবের দাম্মাম শহর থেকে ২৫-৩০ কিলোমিটার দূরে মরুভূমির মীনা পোর্টের বিপরীতে মীনা পেট্রোমিন এলাকার ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড কন্সট্রাকশন কন্ট্রাক্টিং ইস্ট. আলম হার্ডওয়্যারের পেছনে হলুদ রংয়ের পাশাপাশি তিনটি ভবনের দুটিতে ৯৫ জন নারীকে আটকে রাখা হয়েছে। একটি দালালচক্র তাদের যৌনকর্মে বাধ্য করে এবং সপ্তাহ-চুক্তিতে ভাড়া দিচ্ছে। ওই আবেদনে তিনি সেখানে থাকা ২ জন নারী কর্মীর নাম্বারও সংযুক্ত করেন। এ আবেদনের প্রেক্ষিতে গত ৭ই এপ্রিল দূতাবাস এক চিঠিতে জানায়, ৬ই এপ্রিল দূতাবাসের একজন ব্যক্তি সৌদির মেগা রিক্রুটিং কোম্পানি মেসার্স ইসাদ কোম্পানির (ইএসএডি) ক্যাম্প পরিদর্শন করেন। কোম্পানিটির হাউজ মেইড ক্যাম্প দাম্মামস্থ কিং আবদুল আজিজ পোর্ট এলাকার সালমান আল ফারসি রোডের নিকটে অবস্থিত। পরিদর্শনকালে কোম্পানির অপারেশন অ্যান্ড আইটি ডিপার্টমেন্টের প্রধান রাঘু রামা রাজু জানান, তাদের কোম্পানি এ পর্যন্ত হাউজ মেইড পেশায় ৩০ জন নাইজেরিয়ান, ৬০ জন ইন্দোনেশিয়ান, ১৫ জন শ্রীলঙ্কান, ৩ জন ফিলিপিনো এবং ৮৮২ জন বাংলাদেশি নাগরিককে সৌদি আরবে নিয়োগ দিয়েছেন। বাংলাদেশি ছাড়া অন্যান্য দেশের নাগরিক হাউজ মেইডে কর্মরত আছেন। তাদের কোনো সমস্যা নেই। বাংলাদেশি ৮৮২ জনের মধ্যে ৪৫ জনকে কাজ করতে অনীহা এবং শারীরিক সমস্যার কারণে বিগত ৩ মাসের মধ্যে ফেরত পাঠানো হয়েছে। ৭৭৭ তাদের স্পন্সরশিপে আছেন, তাদের কোনো সমস্যা নেই। বাকি একশ’ বাংলাদেশি গৃহকর্মী কাজ করতে অনীহা প্রকাশ করেছেন। তারা কোম্পানির এ ক্যাম্পে বিগত চার মাস যাবৎ কোনো কাজ ছাড়াই অবস্থান করছেন। কোম্পানি থেকে তাদের কাজে যাওয়ার জন্য বোঝানো হলেও তারা কোনো কাজ করতে ইচ্ছুক নন। তাদের নিয়মিত খাবার এবং প্রয়োজন অনুসারে চিকিৎসা সেবা দেয়া হচ্ছে। দূতাবাস জানায়, বাংলাদেশি সুপারভাইজারদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, কাজ করতে অনিচ্ছুক কর্মীরা কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ ছাড়াই কাজ করছেন না। কয়েকদিন কাজ করে বন্ধ করে দিয়েছেন তারা। দূতাবাস দেশে ফিরতে চান এমন কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানায়, মুন্সীগঞ্জের সালমা আড়াই মাস আগে এজেন্সিকে ৮০ হাজার টাকা নিয়ে সৌদি গমন করেন। ইতিমধ্যে তিনি ৫টি বাসায় কাজ করেছেন। কিন্তু কোনো ভালো বাসা না পাওয়ায় তিনি দেশে ফিরতে চান। সালমার মতো অনেকেই এজেন্সিকে বিপুল অঙ্কের টাকা দিয়ে সৌদি গেছেন কিন্তু তারা নানা কারণে সেখানে কাজ করতে চান না। এদের কেউ দেশেই মেডিকেল আনফিট ছিলেন, এজেন্সি তদবির করে সৌদি পাঠিয়েছে। আবার কাউকে কাজ ভালো না লাগলে তিন মাসের মধ্যে দেশে পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। দূতাবাস যৌন নির্যাতনের মতো কোনো অভিযোগ পাননি বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করে। তবে ফিরে আসা কয়েকজন নারীকর্মী জানান, তাদের বিভিন্ন অসামাজিক কাজ করতে চাপ দেয়া হচ্ছিল। তাই তারা ফেরত এসেছেন। এদিকে দূতাবাস সুপারিশ করেছে, তিন মাস পর চলে যাওয়ার আশ্বাস প্রদানকারী, কর্মবিমুখ ও অসুস্থ গৃহকর্মী প্রেরণকারী এবং প্রেরণের জন্য অর্থ গ্রহণের অভিযোগে তদন্তসাপেক্ষে অভিযুক্ত রিক্রুটিং এজেন্সির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। জানা যায়, কোম্পানিটি আউট সোর্সিংয়ের মাধ্যমে নারীকর্মীদের সেখানে গৃহকর্মীর কাজ দেয়। কিন্তু এদের অনেকেরই ঠিকমতো বেতন দেয় না তারা। বিনা বেতনে কাজ না করতে চাইলে তাদের মারধর করতো। এছাড়া অসামাজিক কাজ করারও ইঙ্গিত দিতো। এক মাস আগে ফিরে আসা পিয়া নামে এ কর্মী জানান, তাকে দিয়ে তিন মাস কাজ করানোর পরও এক টাকাও দেয়া হয়নি। সেখানে থাকা মনির নামে বাংলাদেশি দালাল বেতন চাইলেই মারধর করতো। পরিবারের কাছে জানালে নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে যায়। তিনি বলেন, আমার মাথার ওপরে বাড়ি দেয়। এছাড়া বিভিন্ন সময় তারা অশ্লীল ইঙ্গিত দিতো। সেই সব কাজে রাজি না হওয়ায় মারধর করেছে। পিয়া বলেন, রেহেনা নামে আরেক মেয়েকে ইস্ত্রির হিট দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে। আরেক মেয়েকে জোর করে হারপিক খাইয়েছে। সালমা নামের আরেক নারী কর্মীকেও খুব মারধর করে দালালরা। তিনি আরো বলেন, যেদিন বাড়ি আসবো সেদিন মজুমদার নামে একজন তাকে ফোন করে বলেছে বাড়ি ফেরার কথা কেউ যেন না জানে। তাই ওই সময় ভয়ে কাউকে জানাতে পারিনি। বলেন, এ ধরনের নির্যাতনের শিকার আরো অনেকেই সেখান থেকে দেশে ফিরতে চান। কয়েকজন ইতিমধ্যেই ফিরে এসেছেন বলেও পিয়া জানান। তাদেরও গোপনে ফেরত আনা হয়েছে।