গ্যাসলাইনে ময়লা আসছে। হুমকির মুখে পড়েছে বিদ্যুৎকেন্দ্র। নষ্ট হওয়ার ঝুঁকিতে কোটি কোটি টাকা মূল্যের যন্ত্রপাতি। বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বিদ্যুৎ উৎপাদন। বিশেষ করে নারায়ণগঞ্জের হরিপুরে অবস্থিত সরকারি-বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে সমস্যাটি প্রকট। লাইনের মুখে থাকা ফিল্টার মাসে একাধিকবার পরিষ্কার করেও পরিস্থিতি সামলানো যাচ্ছে না। এ এলাকার গ্যাসচালিত মোট ৮০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার বড় দুই বিদ্যুৎকেন্দ্র যে কোনো সময় বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা করছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর পক্ষ থেকে সঞ্চালন ও বিতরণ কোম্পানিগুলোকে বারবার বলার পরও সমস্যার স্থায়ী সমাধান হচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে।
ময়লার কারণ সম্পর্কে বুয়েটের অধ্যাপক ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ম. তামিম বলেন, উৎস হতে পারে দুটি। প্রথমত, গ্যাসক্ষেত্র থেকে সঠিকভাবে গ্যাস প্রক্রিয়াকরণ না করে লাইনে দেওয়া হলে এমনটি হতে পারে। অথবা লাইনের নিজস্ব সমস্যার কারণে ময়লা আসতে পারে। তিনি বলেন, আমাদের লাইনগুলো সঠিকভাবে ও নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ করা হয় না, ফলে ভেতরে ময়লা জমে থাকতে পারে।
ময়লা কি গ্যাসক্ষেত্র থেকে আসছে, না লাইনের সমস্যা_ তা জানা নেই গ্যাস কোম্পানিগুলোর। আবার সমস্যাটি সঞ্চালন অংশে, না বিতরণ অংশে_ তাও নিয়ে রয়েছে বিতর্ক। সঞ্চালন কর্তৃপক্ষ গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি (জিটিসিএল) ও বিতরণ কর্তৃপক্ষ তিতাস গ্যাস (টিজিটিডিসিএল) একে অপরকে দায়ী করছে।
হরিপুরে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান ইলেকট্রিসিটি জেনারেশন কোম্পানির (ইজিসিবি) ৪১২ মেগাওয়াটের একটি কেন্দ্র রয়েছে। এ কেন্দ্রের ৩০ ইঞ্চি মোটা গ্যাস সরবরাহ পাইপলাইনে গত জানুয়ারি থেকে ময়লা আসছে। জিটিসিএল ২৬ জানুয়ারি থেকে ১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এ পাইপলাইনটি পরিষ্কার করে। কিন্তু গ্যাসের ময়লার পরিমাণ এত বেশি যে, কয়েক দিনের মধ্যে বিদ্যুৎকেন্দ্রের ফুয়েল গ্যাস কম্প্রেসরের স্ট্রেইনার ও ফিল্টার ব্লক হয়ে যায়। বাধ্য হয়ে কর্তৃপক্ষ গত ১৯ ফেব্রুয়ারি বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রেখে স্ট্রেইনার ও ফিল্টার পরিষ্কার করে। কিন্তু একদিনের মধ্যে আবার স্ট্রেইনার ও ফিল্টার ব্লক হয়ে যায়। পরে ৪ মার্চ বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রেখে
আবার এগুলো পরিষ্কার করা হয়। বিষয়টি সম্পর্কে নিজেদের আশঙ্কার কথা জানিয়ে জিটিসিএল ও তিতাস কর্তৃপক্ষে কয়েক দফা চিঠি লেখে ইজিসিবি। সর্বশেষ গত ২৩ মার্চ এক চিঠিতে ইজিসিবি জানায়, গ্যাসলাইনের ময়লা কম্প্রেসর ও গ্যাস টারবাইনের জন্য ক্ষতিকর এবং যে কোনো সময় বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। চিঠিতে আরও বলা হয়, বর্তমান বিদ্যুৎ ঘাটতির কথা বিবেচনা করে ক্ষতিকর জেনেও ময়লাযুক্ত (বালুসহ) গ্যাস দ্বারা বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু রাখা হয়েছে। গ্যাসের ময়লার বিষয়ে দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করা ছাড়া উপায় থাকবে না বলে জানিয়েছে ইজিসিবি।
এ বিষয়ে ইজিসিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ টি এম জহিরুল ইসলাম মজুমদার বলেন, ময়লার কারণে আমাদের প্ল্যান্টটি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। আমরা সংশ্লিষ্টদের অনেকবার বিষয়টি জানিয়েছি। জিটিসিএল ও তিতাসের লোকজন এসে বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করেছে। পরীক্ষার জন্য ময়লার নমুনা নিয়ে গেছে। কিন্তু এখনও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
হরিপুরেই অবস্থিত মালয়েশিয়ান কোম্পানি পাওয়ারটেকের হরিপুর ৩৬০ মেগাওয়াটের বেসরকারি কেন্দ্রটিও একই সমস্যায় ভুগছে। ইজিসিবির প্ল্যান্টে নিজস্ব ফিল্টার ব্যবস্থা থাকায় ঝুঁকি কিছুটা কম হলেও পাওয়ারটেকের প্ল্যান্টের নিজস্ব ফিল্টারিং ব্যবস্থা নেই।
কোম্পানির সূত্রে জানা গেছে, গত ডিসেম্বর থেকে পাইপলাইনে গ্যাস আসার বিষয়টি ধরা পড়ে। এ সময় ৩০ ইঞ্চি মোটা পাইপলাইনে গ্যাস দেওয়া হতো, যার সংযোগ কিছুদিন আগেই দেওয়া হয়েছিল। আগে এ প্ল্যান্টে ২০ ইঞ্চি লাইনে গ্যাস দেওয়া হতো। বিষয়টি তিতাসকে জানানো হলে গত ৮ ফেব্রুয়ারি আগের ২০ ইঞ্চি পাইপলাইনের সঙ্গে পুনঃসংযোগ দেওয়া হয়। এর পরও গ্যাসে ময়লা আসা বন্ধ হয়নি। গত ৪ মে থেকে ময়লা আসার পরিমাণ এত বেড়েছে যে, আগে যেখানে দুই/তিন সপ্তাহ পরপর ফুয়েল গ্যাস কম্প্রেসরের ফিল্টার পরিষ্কার করতে হতো, এখন কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তা ব্লক হয়ে যাচ্ছে। বিষয়টি তিতাসকে জানানোর পর ৫ ও ৬ মে তাদের একটি রক্ষণাবেক্ষণকারী দল সরবরাহ লাইনের আরএমএসের (রিমোট মনিটরিং অ্যান্ড অ্যাসিস্ট্যান্স সিস্টেম) ফিল্টার খুলে দেখে, তা ময়লা দিয়ে পুরো ভরে গেছে। অবস্থা এতই খারাপ ছিল যে, পর্যবেক্ষণকারী দল সঙ্গে সঙ্গে ফিল্টার পরিষ্কার করে স্থানীয় যন্ত্রাংশ দিয়ে তা সংস্কার করে। তবে এতেও পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়ায় ৮ মে পাওয়ারটেকের বাংলাদেশের কান্ট্রি ম্যানেজার আহমদ সুলায়মান জিটিসিএলকে চিঠি দেন। এতে তিনি দ্রুত পরিষ্কার গ্যাস সরবরাহের অনুরোধ জানিয়ে বলেন, ময়লাযুক্ত গ্যাসের কারণে কেন্দ্রের কোনো ক্ষতি হলে গ্যাস সরবরাহ চুক্তি (জিএসএ) অনুসারে সব দায়ভার তিতাসকে নিতে হবে।
জানতে চাইলে তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মীর মসিউর রহমান বলেন, আমাদের অংশে সমস্যা নেই। ময়লা আসছে জিটিসিএলের লাইন থেকে।
এ বিষয়ে জিটিসিএলের পরিচালক (অপারেশন) জানান, আমরা কাউকে দোষী করতে চাই না। বিষয়টি পরীক্ষা করে দেখা হবে। তার পর বলা সম্ভব হবে, ময়লা কোথা থেকে আসছে। তিনি বলেন, গ্যাসলাইন পরিষ্কার করার জন্য একবার দরপত্র ডাকা হলেও আগ্রহী কোম্পানি পাওয়া যায়নি। নতুন করে আবার দরপত্র আহ্বানের প্রস্তুতি চলছে।
সঞ্চালন লাইনের রক্ষণাবেক্ষণ সম্পর্কে জিটিসিএলের এই কর্মকর্তা বলেন, এটি নিয়মিত করা হয়।