কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার ধলঘাটা ইউনিয়নের ৫ শতাধিক বসতবাড়ি সাগরে তলিয়ে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত ইউনিয়নের সাপমারার ডেইল এলাকার লবণ চাষি মো. ইসমাইলকে ত্রাণ দেওয়ার জন্য তালিকাভুক্ত করে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ। গতকাল মঙ্গলবার সকালে ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনামন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার উপস্থিতিতে তাকে ত্রাণ নেওয়ার
জন্য ডাকা হয়েছিল। কিন্তু তিনি মন্ত্রীকে সাফ এই কথাটিই জানিয়ে দেন। তার মতো অনেকে জানান একই কথা।
রোয়ানুর তাণ্ডবে পটুয়াখালীর ১৩টি পোল্ডারের ১৫ কিলোমিটারসহ মোট ৮১৫ কিলোমিটার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বেড়িবাঁধ বিধ্বস্ত রয়েছে। এতে পুরো উপকূল এলাকা অরক্ষিত হয়ে পড়ায় উদ্বিগ্ন ও উৎকণ্ঠার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন উপকূলের কয়েক লাখ মানুষ। তাদের মধ্যে কলাপাড়ার লালুয়া ও মহিপুর এলাকার মিজানুর রহমান, ফারুক হোসেন, গোলাম মোস্তফা, সালেহা বিবি, মরিয়ম বেগম, আলেয়া বেগম ও জয়নব বিবি সমকালকে বলেন, ‘মোরা ত্রাণ চাই না, চাই মজবুত বেড়িবাঁধ। হেইডা না হইলে মোরা আর বাঁচুম না। বানের পানিতে মোগোরে ভাসাইয়া লইয়া যাইবো গাঙ্গে। ভাঙোল দিয়া জোবার পানি ঢুইকা মোগো ঘরবাড়ি-জমিজমা ও রাস্তাঘাট হগোল তলাইয়া যাইতাছে। বিগ্ন হইয়া যাইতাছে ক্ষ্যাতের ফসলাদি। এহোন যে বান-বর্ষার দিন আইছে, হ্যাতে হইবো মোগো মরণদশা। আমনেরা স্যারেগো কইয়া-বুইল্লা দ্যাহেন মোগো এলাকায় মজবুত ও শক্ত বেড়িবাঁধ কইরা দিবুনি। হেডা না হইলে মোগো এহানে বাস করণ যাইবো না।’
গতকাল সকালে ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনামন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া মহেশখালী উপজেলার ধলঘাটা ও মাতারবাড়ি এলাকা পরিদর্শন করেন। সেখানেও তিনি ত্রাণ বিতরণ করেন। কিন্তু ক্ষতিগ্রস্তরা মন্ত্রীকে কাছে পেয়ে দাবি তোলেন_ ‘ত্রাণ নয়, বর্ষার আগেই যেন ক্ষতিগ্রস্ত বেড়িবাঁধের মেরামত হয়।’
মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া তাদের বলেন, ‘উপকূলের মানুষ অসীম সাহসী। দুর্যোগ বিপদে লড়াই করে তারা টিকে থাকে। তারা ত্রাণ চায় না, তারা চায় ন্যায্য অধিকার।’ অরক্ষিত উপকূল রক্ষায় বেড়িবাঁধ নির্মাণ অতি জরুরি স্বীকার করে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীকে জানানো হবে। প্রয়োজনে আন্তঃমন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয় করে সভার আয়োজন করা হবে।’
ধলাঘাটা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান কামরুল হাসান জানান, ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে তার ইউনিয়নে সর্বাধিক লবণ ও চিংড়িঘের ক্ষতি হয়েছে। বিধ্বস্ত হয়েছে গ্রামীণ সড়ক। মন্ত্রী মহেশখালীর ক্ষতিগ্রস্ত তিনটি সড়ক দ্রুত মেরামতের জন্য ৫০ লাখ টাকা জরুরিভাবে বরাদ্দ দেওয়ার ঘোষণা দেন।
সোমবার রাতে কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের সম্মেলন কক্ষে ত্রাণমন্ত্রীর উপস্থিতিতে আয়োজিত সভায় বিভিন্ন বক্তা দাবি জানান, এই মুহূর্তে উপকূলীয় এলাকায় জরুরিভিত্তিতে প্রয়োজন বেড়িবাঁধ। সভায় কক্সবাজার-৪ আসনের সাংসদ আবদুর রহমান বদি বলেন, ‘প্রতিবছর বাঁধ মেরামতের নামে বর্ষার আগে কিছু বরাদ্দ দেওয়া হয়। বরাদ্দকৃত এই অর্থ চলে যায় কিছু কর্মকর্তার পকেটে।’ তিনি বলেন, ‘যেখানে বাঁধই হয়নি। সেখানে সংস্কার মেরামতের নামে বরাদ্দ কেন?’
এদিকে কক্সবাজারে ক্ষতিগ্রস্তরা আশ্রয়কেন্দ্র থেকে ফিরলেও তারা আকাশের নিচে মানবেতর দিন কাটচ্ছেন। কুতুবদিয়ায় অন্তত ১৩ হাজার পরিবার গৃহহারা হয়েছে। নৌবাহিনীর সহায়তায় প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাদের মধ্যে শুকনো খাবার, চাল ও কিছু নগদ অর্থ বিতরণ করা হলেও বেড়িবাঁধ না থাকায় প্রতিদিন জোয়ারে তলিয়ে যাচ্ছে তাদের বসতভিটা।
পাউবোর পটুয়াখালী ও কলাপাড়া কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, পটুয়াখালী পাউবোর অধীনে ৮০০ কিলোমিটার এবং কলাপাড়া পাউবোর অধীনে ৫০০ কিলোমিটার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ রয়েছে। রোয়ানুর তাণ্ডবে রাঙ্গাবালী উপজেলার খালিফার চর, আন্ডার চর ও চর মোন্তাজ, কলাপাড়া উপজেলার দেবপুর, লালুয়া ও নিজামপুর এবং গলাচিপা উপজেলার বন্যাতলী ও চর কাজল এলাকার ১৩টি পোল্ডারের ১৫ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ বিধ্বস্ত হয়। বিধ্বস্ত বাঁধ সংস্কারে সাড়ে ১৩ কোটি টাকা প্রয়োজন। পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে ইতিমধ্যে এই অর্থের চাহিদাপত্র সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত বেড়িবাঁধ হচ্ছে জেলার কলাপাড়ার নিজামপুর, লালুয়া, চম্পাপুর ও ধানখালী ইউনিয়নে। বর্তমানে এসব এলাকার চৌধুরীপাড়া, ছোট পাঁচ নং, বড় পাঁচ নং, মুন্সীপাড়া, হাসনাপাড়া, মঞ্জুপাড়া, চান্দুপাড়া, কালাউপাড়া, এগারো নম্বর হাওলা, ধনজুপাড়া, বানাতিপাড়া, চাড়িপাড়াসহ অন্তত ২৪টি গ্রাম, রাঙ্গাবালী উপজেলার চর মোন্তাজ, খলিফার চর ও আন্ডার চর এলাকার ১২টি গ্রাম এবং গলাচিপা উপজেলার রতনদী তালতলী ও চর কাজল এলাকার ৫টি গ্রামসহ ৪১টি গ্রাম এখন অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে। এ ছাড়া জেলার দশমিনা উপজেলার রনগোপালদি ইউনিয়নের তেঁতুলিয়া নদীর পাড়ে ৫৫/বি-২ডি পোল্ডারের দেড় কিলোমিটার বেড়িবাঁধ বিধ্বস্ত হওয়ায় আলিপুর, জৌতা, খালিশাখালী, পূর্ব আলিপুর এবং দশমিনা ও রনগোপালদি (আংশিক), সদর উপজেলার আউলিয়াপুর ইউনিয়নে বাঁধ বিধ্বস্ত হওয়ায় পুরো উপকূলই অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে। তাই এ মুহূর্তে বড় ধরনের কোনো ঝড় ও জলোচ্ছ্বাস হলে পুরো উপকূলই তলিয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
কলাপাড়া উপজেলার নিজামপুরের কৃষক মো. নূরুল ইসলাম বলেন, ‘এমনিতেই মোগো এই এলাকার বাঁধের অবস্থা বেশি ভালো না। হের উপর রোয়ানুর তাণ্ডবে মোগো মরণদশা হইছে। এতদিন বউ-পোলাপান লইয়া কোন রহমে চলছিলাম। রোয়ানু হগোল শ্যাষ কইরা দিছে। এহোন মোগো কোথাও যাওয়নেরও জায়গা নাই।’
কলাপাড়ার নিজামপুর এলাকার ইউপি চেয়ারম্যান আবদুস সালাম আকন বলেন, ‘যেভাবে বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাতে উপকূলে বসবাস অনুপযোগী হয়ে উঠছে। প্রতিদিন জোয়ারের পানি ঢুকে উপকূলের বিস্তীর্ণ জনপদ তলিয়ে যাচ্ছে। আগের বিধ্বস্ত বেড়িবাঁধ মেরামত করা হয়েছিল, কিন্তু রোয়ানুর আঘাতে সেটুকুও বিলীন হয়ে গেছে। এখন পুরো এলাকাই অরক্ষিত’।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের কলাপাড়া সার্কেলের নির্বাহী প্রকৌশলী আবুল খায়ের জানান, বরাদ্দ এলেই বিধ্বস্ত বেড়িবাঁধ মেরামত করা হবে।