পুলিশের কাছে মহিউদ্দিনের দেওয়া বর্ণনামতে, ঘটনার দিন পূর্বপরিচয়ের সূত্র ধরে পানি সরবরাহের জার নিয়ে প্রথমে মহিউদ্দিন ও পরে তার বড় ভাই ইউসুফ ওই বাসায় যান। তাদের চা দেন আরিফা। কাপের চা শেষ না করেই ইউসুফ পেছন দিক থেকে আরিফার গলায় রশি পেঁচিয়ে টান দিয়ে শ্বাসরোধ করে মৃত্যু নিশ্চিত করেন। তাকে সহায়তা করেন মহিউদ্দিন। এরপর তারা বাসা থেকে এক লাখ টাকা ও কিছু স্বর্ণালঙ্কার নিয়ে সটকে পড়েন। পরে দুই ভাই লুট করা টাকা-গহনা সমানভাবে ভাগ করে নেন। সম্প্রতি মহিউদ্দিন বিয়েও করেন।
কদমতলী থানার ওসি কাজী ওয়াজেদ আলী বলেন, আরিফা হত্যাকাণ্ডটি ‘ক্লুলেস’ ঘটনা ছিল। অনেক দিন আগে থেকেই তিনি নিজের বাসায় একা একা বসবাস করতেন। টেলিফোনে পরিচিত ব্যবসায়ী ও হকারদের সঙ্গে যোগাযোগ করে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আনিয়ে নিতেন। এই তথ্যের সূত্র ধরে প্রথমে মহিউদ্দিনকে শনাক্ত করা হয়। এরপর নানা কৌশলে তাকে গ্রেফতার করার পর মূল রহস্য বেরিয়ে এসেছে।
গত ২৭ ডিসেম্বর কদমতলীতে নিজের বাসার বাথরুমের ভেতর থেকে উদ্ধার করা হয় আরিফার মরদেহ। আলামত দেখে পুলিশ জানিয়েছিল, খুনিরা শ্বাসরোধ করে হত্যার পর তার ঘাড় পুরোপুরি ভেঙে দেয়। বাসা থেকে খোয়া গেছে দুই জোড়া স্বর্ণের কানের দুল, একটি চেইন ও এক লাখ টাকা। বাসার মেঝেতে পড়ে ছিল তিনটি চায়ের কাপ। প্রতিটি কাপের তলায় সামান্য একটু চা অবশিষ্ট ছিল। চাঞ্চল্যকর এ ঘটনায় কদমতলী থানায় মামলা হয়।
গ্রেফতার প্রেমিকা সেজে : গ্রেফতার মহিউদ্দিন ও তার বড় ভাই ইউসুফ রাজমিস্ত্রি। ঘটনার মাসতিনেক আগে কাজের সূত্র ধরে মহিউদ্দিনের সঙ্গে আরিফার পরিচয় হয়। এরপর প্রায়ই ওই বাসায় পানীয়জলের জার সরবরাহ করতেন তিনি। ঘটনার পর পুলিশ প্রথমে আরিফার স্বজনকে সন্দেহের তালিকায় রাখলেও পরে তাদের সংশ্লিষ্টতা না পাওয়ায় অন্য কৌশলে তদন্ত শুরু করে। আরিফার বাসায় কারা নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সরবরাহ করতেন তার তালিকা তৈরি করা হয়। তাদের ব্যাপারে তথ্য নেওয়ার পাশাপাশি বাড়ানো হয় গোয়েন্দা নজরদারি। এরই মধ্যে পুলিশের তদন্তে মহিউদ্দিন নামে এক তরুণের নাম উঠে আসে। তিনি সূত্রাপুর এলাকায় বসবাস করতেন। তার গ্রামের বাড়ি পটুয়াখালী। তার ভাই ইউসুফ থাকতেন কেরানীগঞ্জে। ঘটনার পর থেকেই দুই ভাই ঢাকায় অনুপস্থিত জেনে পুলিশের সন্দেহে বাড়তি মাত্রা যুক্ত হয়। পরে মহিউদ্দিনকে গ্রেফতার করতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা ‘প্রেমিকা’ সেজে তার সঙ্গে কয়েক মাস কথোপকথন চালান। এরপর সূত্রাপুর থেকে তাকে গ্রেফতার করে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। প্রথমে তিনি এলোমেলো তথ্য দেন। এ সময় তিনি জানান, আরিফা নামে কোনো নারীকে তিনি চিনতেন না। কখনও জানান, অন্য দুই ব্যক্তি আরিফাকে হত্যা করেছে। দেখে ফেলায় তাকে ২০ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে। এক পর্যায়ে তিনি জানান, তারা দুই ভাই মিলে পরিকল্পিতভাবে আরিফাকে হত্যা করে এক লাখ টাকা ও স্বর্ণালঙ্কার নিয়ে পালিয়েছেন।
১৯৯৫ সালে আরিফা আহম্মেদের স্বামী জীবন বীমা করপোরেশনের সাবেক কর্মকর্তা শাহাবুদ্দিন আহমেদ মারা যান। এরপর আরিফা ছোট দুই মেয়েকে নিয়ে রাজধানীর কদমতলী থানা এলাকার দক্ষিণ মুরাদপুরের হাই স্কুল রোডে ১৫ কাঠার ওপর নির্মিত নিজের বাসায় বসবাস করতেন। তবে দুই মেয়ে সায়েলা আফরোজ সম্পা ও সায়েমা আহাম্মেদ লোপাকে বিয়ে দেওয়ার পর দোতলা বাড়ির একটি কক্ষে সম্পূর্ণ একাই বসবাস করছিলেন আরিফা। স্থানীয় সমিরুন্নেছা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন তিনি। স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি শিক্ষকতা থেকে অবসর নেন। এর পর তিনি আশপাশের লোকজনের সঙ্গে খুব একটা মিশতেন না।
এর আগে ২০১২ সালে রাজধানীর সেগুনবাগিচায় ধনাঢ্য এক বৃদ্ধার হাত-পা ও মুখ বেঁধে রেখে তার মেয়ে নিশাত বানুকে বাসার ভেতরে হত্যা করা হয়। ২০১৫ সালে তদন্ত শেষে ওই মামলার ফাইনাল রিপোর্ট দেয় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। ওই ঘটনায় পুলিশ কোনো আসামিকে শনাক্ত করতে পারেনি।