নূরজাহান বেগম। ১৯৪৭ থেকে ২০১৬ দীর্ঘ ৬৯ বছর একটানা ‘বেগম’ পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে তিনি পেছনে রেখে গেলেন এমন একটি ইতিহাস, যা এ অঞ্চলের অগণিত নারীকে স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে শিখিয়েছে, প্রেরণা যুগিয়েছে। নারী শিক্ষা, নারী জাগরণ, নারী সাহিত্য এবং নারীর মেধা ও মননের বিকাশে নূরজাহান বেগম অসামান্য ভূমিকা পালন করে গেছেন এক সময়ে আলোড়নসৃষ্টিকারী ‘বেগম’ পত্রিকার মাধ্যমে।
উপমহাদেশের প্রথম নারী সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘বেগম’ প্রতিষ্ঠা করেন কিংবদন্তি সাংবাদিক সওগাত সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন। তারই একমাত্র মেয়ে নূরজাহান বেগম। বাবার দেখানো পথেই শেষ পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করে গেছেন নূরজাহান বেগম। ১৯৪৭ সালে ২০ জুলাই কলকাতা থেকে প্রথম প্রকাশিত হয় সাপ্তাহিক ‘বেগম’। সেই থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত একটানা এ পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করে এক গৌরবময় ইতিহাস সৃষ্টি করে গেছেন নূরজাহান। দায়িত্ব পালন করেছেন সওগাত পত্রিকার সম্পাদক হিসেবেও। বাবার উত্তরসূরি হিসেবেই শুধু নয়, নিজের মেধা, যোগ্যতা এবং সাহসের বলেই তিনি বেগমকে এ পর্যন্ত টেনে এনেছেন এবং তার কালের সাক্ষী হিসেবে অনুসরণীয় গৌরবের ইতিহাস রচনা করেছেন।
১৯৪৭ সালে যখন মেয়েদের ছবি তোলার বিষয়ে অনেকের আপত্তি ছিল সেই সময় বেগম নারীদের একটি সচিত্র ম্যাগাজিন হিসেবে প্রকাশিত হয়ে সমাজে আলোড়ন সৃষ্টি করে। বেগম পত্রিকা একসময় এ অঞ্চলে এতই জনপ্রিয় ছিল যে গেল শতকের ৭০-এর দশকেও এটি প্রতি সংখ্যায় ২৫ হাজার করে প্রকাশিত হতো। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ডাকযোগে পৌঁছে যেত এ পত্রিকা। শিক্ষিত নারী সমাজে চিন্তা এবং বিনোদনের অন্যতম একটি মাধ্যম ছিল এ ‘বেগম’। সারা তৈফুর, শামসুন্নাহার মাহমুদ, আশালতা সেন, আনোয়ারা বাহার চৌধুরী, তাহমিনা বানু, প্রতিভা গাঙ্গুলি, রাবেয়া খাতুন, সৈয়দা সুফিয়া সাহিত্যরত্ন, আশাপূর্ণা দেবী, নীলিমা ইব্রাহীম, জুবাইদা গুলশান আরা, মকবুলা মঞ্জুর, রিজিয়া রহমান প্রমুখ তখন বেগমে লেখক বা বেগম-ক্লাবের সাথে যুক্ত ছিলেন।
নারী সাহিত্য চর্চা, নারীদের লেখালেখিতে উৎসাহিত করা, নারীদের পাঠাভ্যাস গড়ে তোলা, নারীশিক্ষা, নারী জাগরণ, নারীদের গোঁড়ামি কুসংস্কার থেকে বের করে আনা প্রভৃতি উদ্দেশে নাসিরউদ্দীন ‘বেগম’ পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। বাবার সে আকাক্সক্ষা পূরণে শতভাগ সফল হয়েছেন নূরজাহান বেগম। সুদীর্ঘকাল ‘বেগম’ নারীজাগরণে এ অঞ্চলে ভূমিকা পালন করে গেছে। নূরজাহান বেগম এক সাক্ষাৎকারে বলে গেছেন- ‘বেগমের বাইরে আমি কোনো দিনই কোনো কিছু করার চেষ্টা করিনি। বেগমই তো আমার সারা জীবনের কাজ।’ ৫০’র দশকে বেগম পত্রিকা তৎকালীন সমাজে শিক্ষিত মুসলিম নারী লেখকদের একটি প্লাটফর্ম হিসেবে গড়ে ওঠে।
নাসিরউদ্দীন প্রথমে বেগমের সম্পাদক নিযুক্ত করেন কবি সুফিয়া কামালকে। সদ্য বিএ পাস নূরজাহান বেগম হন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক। চার মাসের মাথায় কবি সুফিয়া কামাল ঢাকায় চলে আসায় নূরজাহান পত্রিকাটির সম্পাদক হন। বেগম প্রকাশের মাত্র এক মাসের মধ্যে দেশ ভাগ হলে ১৯৫০ সালে বর্তমান পুরান ঢাকার পাটুয়াটুলীতে স্থানান্তর হয় বেগমের অফিস। সেই থেকে আজ অবধি সেখানেই রয়েছে সওগাত প্রেস ও বেগম অফিস। প্রথমে পত্রিকাটি সাপ্তাহিক হিসেবে প্রকাশিত হলেও পরে নানা প্রতিকূলতার কারণে এটিকে মাসিক করা হয়।
চাঁদপুরের চালিতাতলীতে ১৯২৫ সালের ৪ জুন নূরজাহান বেগম জন্মগ্রহণ করেন। নূরজাহান বেগমের মায়ের নাম ফাতেমা বেগম। তার পরিবার ১৯২৯ সালে গ্রাম ছেড়ে কলকাতা যায়। ‘সওগাত’ পত্রিকার দফতর ১১ নম্বর ওয়েলসলি স্ট্রিটের দোতলা বাড়িতেই তারা থাকতেন। নিচে পত্রিকা অফিস আর উপরে বসবাস করতেন তারা। এই অফিসেই নিয়মিত সাহিত্য মজলিসের আয়োজন করেছিলেন মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন। যেখানে কাজী নজরুল ইসলাম, খান মোহাম্মদ মঈনুদ্দীন, আবুল মনসুর আহমদ, আবুল কালাম শামসুদ্দিন, মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী, হবীবুল্লাহ বাহার, ইব্রাহীম খাঁ, কাজী মোতাহার হোসেনসহ অনেক খ্যাতিমান ব্যক্তিত্ব অংশ নিতেন। নূরজাহান বেগম তখন শিশু। শিশু বয়স থেকেই এই সাহিত্য মজলিসের নিয়মিত শ্রোতা হয়ে ওঠেন নূরজাহান বেগম নূরী। তারা তাকে নূরী বলেই ডাকতেন।
নূরজাহান বেগম ১৯৪২ সালে সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। বেগম রোকেয়া তখন তার স্কুলের জন্য বাড়ি বাড়ি গিয়ে শিক্ষার্থীদের খুঁজে আনতেন। সওগাত সম্পাদকের সাথে ভালো পরিচয় ছিল বেগম রোকেয়ার। সেই সূত্রে বেগম রোকেয়ার অনুরোধে মাত্র চার বছর বয়সেই স্কুলে ভর্তি হন নূরজাহান। ১৯৪৪ সালে কলকাতার লেডি ব্রেবোর্ন কলেজ থেকে তিনি আইএ এবং ১৯৪৬ সালে একই কলেজ থেকে বিএ পাস করেন। ১৯৫২ সালে তার বিয়ে হয় সাংবাদিক সাহিত্যিক রোকনুজ্জামান খানের সাথে। কেন্দ্রীয় কচি-কাঁচার আসরের প্রতিষ্ঠাতা রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই নামে সমধিক পরিচিত।
বেগম প্রকাশের স্মৃতিচারণ করে দুই বছর আগে নূরজাহান বেগম লিখেছেন, ১৯১৮ সালে তার বাবার সওগাত পত্রিকা প্রকাশিত হয়। তার বাবা নারীদের কথা চিন্তা করে বছরে তখন একটি মহিলা সংখ্যা বের করতেন। কবি সুফিয়া কামাল ১৯২৬ সাল থেকে সওগাতে নিয়মিত লিখতেন। ১৯২৯ সালে প্রথম মহিলা সংখ্যা বের হয় সওগাতে কিন্তু তখনো কুসংস্কার এবং গোঁড়ামীর কারণে কবি সুফিয়া কামাল তার ছবি ছাপতে পারেননি। ১৯৩০ সালে প্রথম সওগাতে তার ছবিসহ লেখা প্রকাশিত হয়। আর নূরজাহান বেগম ১৫ বছর বয়সে প্রথমে সওগাতের মাধ্যমে লেখালেখি শুরু করেন। পরে তার বাবা মেয়েদের লেখালেখিতে আরো সুযোগ করে দেয়ার জন্য আলাদা করে ‘বেগম’ প্রকাশের উদ্যোগ নেন।
ড. এ কে এম রিপন আনসারী
এডিটর ইনচীফ
গ্রামবাংলানিউজটোয়েন্টিফোরডটকম