রোয়ানু : হাজারো মানুষ খোলা আকাশের নিচে

Slider জাতীয় ফুলজান বিবির বাংলা

file (1)

ডেস্ক রিপোর্ট: ঘূর্ণিঝড় রোয়ানুর আঘাতে উপকূলীয় এলাকায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ঘরবাড়ি হারা মানুষ খাদ্য ও পানীয়র অভাবে মারাত্মক বিপদগ্রস্ত। সড়ক ভেঙে বহু এলাকা এখনো যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। কক্সবাজারে বেড়িবাঁধ না থাকার ফলে রোয়ানুর আঘাতে ২০ হাজার পরিবার সর্বস্বান্ত হয়েছে। পটুয়াখালীতে আট শতাধিক ঘর বিধ্বস্ত হয়েছে। নোয়াখালী ও ভোলায় হাজার হাজার মানুষ খোলা আকাশের নিচে বসবাস করছেন। কক্সবাজারের মহেশখালীসহ বিভিন্ন স্থানে ত্রাণ না পেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর মধ্যেও হাহাকার সৃষ্টি হয়েছে।

ভোলা সংবাদদাতা জানান, ঘূর্ণিঝড় রোয়ানুর তিন দিন পেরিয়ে গেলেও এখনো স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেনি ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার মানুষ। আশ্রয়কেন্দ্র থেকে ফিরে অনেকেই তাদের বসতঘরের ভিটের চিহ্ন খুঁজে পাননি। জোয়ারের পানিতে গবাদিপশু ভেসে গেছে। রাস্তাঘাট ভেঙে যাওয়ায় জেলা সদরের সাথে অনেক এলাকা এখনো বিচ্ছিন্ন রয়েছে। অনেক এলাকায় বেড়ি বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় পানি প্রবেশ করছে।

গত শনিবার ভোরে ঘূর্ণিঝড় রোয়ানুর আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দ্বীপ জেলা ভোলার সদর, লালমোহন, চরফ্যাসন, মনপুরা ও তজুমদ্দিনসহ বেশ কয়েকটি এলাকা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে ভোলার তজুমদ্দিন উপজেলার শশীগঞ্জবাজারে কয়েশ দোকান পাট। এর ফলে ব্যবসায়ীরা যেমন হারিয়েছে তাদের মূলধন। ঠিক তেমনি অনেকেই মাথা গোঁজার ঠাঁই টুকু হারিয়ে এখন খোলা আকাশের নিচে বসবাস করছেন।

তজুমদ্দিনের ঘের মালির আ: রশিদ জানান, জোয়ারের পানিতে আমার চারটি মাছের খামারের ১০ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। পানিতে মাছ ভেসে গেছে। এ ছাড়াও বসতঘরটি ভেঙে গেছে।

ক্ষতিগ্রস্ত আরো অনেকেই জানান, ঝড়ের পর থেকে এখন পর্যন্ত কোনো সহযোগিতা পাইনি, কেউ খোঁজ নিতেও আসেনি।

ভোলার জেলা প্রশাসক মো: সেলিম উদ্দিন বলেন, সরকারিভাবে আংশিক ও সম্পর্ণ মিলিয়ে জেলায় সাত লাখ টাকা ও ৫০ টন চাল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। ঝড়ে পাঁচ হাজার ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে।

নোয়াখালী সংবাদদাতা জানান, নোয়াখালীর হাতিয়া ও কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় ঘূর্ণিঝড় রোয়ানুর আঘাতে বিধ্বস্ত হওয়া বাড়িঘরের শত শত পরিবার এখনো খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত চরঈশ্বর, সোনাদিয়া, নলচিরা, সুখচর, তমরুদ্দি নলেরচর নিঝুমদ্বীপের শত শত পরিবার আকাশের নিচে বসবাস করছেন। সরকারি সাহায্য চাহিদার চেয়ে অপ্রতুল হওয়ায় দুর্গত মানুষেরা না খেয়ে জীবন কাটাচ্ছেন। ভুক্তভোগীরা জানান. সরকারিভাবে তাদের কিছু শুকনো খাবার ছাড়া আর কিছুই দেয়া হয়নি। নিঝুমদ্বীপ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো: মেরাজ উদ্দিন জানান. প্রচণ্ড জোয়ার ও ঝড়ে গৃহহারা দুই শতাধিক পরিবার এখনো খোলা আকাশের নিচে। তিনি বলেন, জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত নিঝুমদ্বীপ ইউনিয়নের ৫ ও ৬ নম্বর ওয়ার্ডের কয়েক হাজার মানুষ এখনো পানিবন্দী।

রোয়ানুর আঘাতে জেলার উপকূলীয় উপজেলা হাতিয়ায় সামদ্রিক প্রচণ্ড জোয়ার ও জলোচ্ছ্বাসে হাতিয়ার চার কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ভেঙে ২০ গ্রাম প্লাবিত হয় এবং ঝড়ে পাঁচ হাজারের বেশি বাড়িঘর বিধ্বস্ত হয়।

পটুয়াখালী সংবাদদাতা জানান, ঘূর্ণিঝড় রোয়ানুর প্রভাবে পটুয়াখালীর বিভিন্ন জনপদের সাধারণ মানুষ, কৃষক, মাছচাষি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বসতঘর এবং বিভিন্ন এলাকার বেড়িবাঁধ ভেঙে গেছে।

জেলা প্রশাসকের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ঘূর্ণিঝড় রোয়ানুতে পটুয়াখালীতে ৮৫৬টি কাঁচা বাড়িঘর বিধ্বস্ত হয়েছে। রাঙ্গাবালি ও কলাপাড়া উপজেলার ১৩টি বেড়িবাঁধের ৯ কিলোমিটার বিধ্বস্ত হয়েছে। ভেসে গেছে, দুই হাজার ৩০২টি মাছের ঘের এবং পুকুর। এ ছাড়াও ১০৮টি কাঁকড়ার ঘের প্লাবিত হয়েছে। সব মিলিয়ে প্রায় সাত কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ড. মো: আবুল হাসানাত বলেন, ‘ক্ষয়ক্ষতির বিষয়টি আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেছি। ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্য দেয়া হবে কি না এ ব্যাপারে মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত দেবে।’

এ ছাড়াও জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, জেলায় কৃষকদের ব্যাপক ক্ষতিসাধন হয়েছে। এর মধ্যে এক হাজার ২৭৩ হেক্টর জমির মরিচ ফসল নষ্ট হয়েছে, ৪৩০ হেক্টর জমির তিল, ৭৩ হেক্টর জমির চিনা বাদাম, এক হাজার ৩২২ হেক্টর জমির গ্রীষ্মকালীন সবজি, ৪৬ হেক্টর জমিন পান বরজ ও ১৯৬ হেক্টর জমির আউশের বীজতলা নষ্ট হয়েছে।

কক্সবাজার সংবাদদাতা জানান, রোয়ানুর আঘাতে আবার সব অর্জন শেষ উপকূলের মানুষের। উপকূলীয় এলাকা ঘুরে দেখা গেছে এমনই দুর্দশার চিত্র। ভিটার চিহ্ন আছে, বাড়িঘর নেই। প্রতিদিন জোয়ার-ভাটার কারণে সেই ভিটেও আশ্রয় নিতে পারছেন না মানুষ। কেউবা আশ্রয়কেন্দ্রে আবার কেউ বা দূরে কোথাও আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে। ঘূর্ণিঝড়ের তিন দিন পরও নেই কোনো সাহায্য। অনাহারে অর্ধাহারে সময় কাটছে ধুরুং, আলী আকবর ডেইল, মাতারবাড়ি ও ধলঘাটার মানুষের। মানবেতরভাবে সময় কাটালেও মানুষের মুখে মুখে প্রথমেই উচ্চারিত হচ্ছে টেকসই বেড়িবঁাঁধের কথা। রোয়ানুর আঘাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা কুতুবদিয়ার উত্তর ধুরুং ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আ স ম শাহরিয়ার চৌধুরী জানান, প্রতিটি ঘূর্ণিঝড়ের পর বেড়িবাঁধে কাজের ধরন হয় জরুরি মেরামত। মাটি ও বালুর বস্তা দিয়ে জরুরি মেরামত তথা বাঁধ দিয়েই দায়িত্ব শেষ। আর খবর থাকে না। স্বাভাবিক পূর্ণিমার জোয়ারের পানিও এই বেড়িবাঁধ দিয়ে রক্ষা করা যায় না। পাঁচ হাজার ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়েছে। ১২ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে গেছে। সবেচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ইউনিয়ন দ্বীপ এলাকা ধলঘাটা। ১৮ কিলোমিটার বেড়িবাঁধই বিধ্বস্ত হয়েছে। ইউনিয়ন চেয়ারম্যান কামরুল হাসান জানান, ১৫ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ সম্পূর্ণরূপে বিলীন হয়েছে।

মাতারবাড়ি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মাস্টার মোহাম্মদ উল্লাহ জানান, তার এলাকায় ১০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়েছে। প্রায় চার হাজার পরিবার সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত। জরুরিভাবে বেড়িবাঁধ নির্মাণ করতে প্রশাসনের কাছে লিখিত দাবি জানিয়েছি।

এ দিকে কক্সবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো: সবিবুর রহমান জানান, প্রাথমিকভাবে প্রাপ্ত হিসাব মতে, ১৪ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ সম্পূর্ণ বিলীন হয়েছে এবং ৩১ কিলোমিটার আংশিক বিধ্বস্ত হয়েছে।

এ দিকে কুতুবদিয়ার ধুরুংয়ে নিখোঁজ শিশু শিফা আক্তারের (৭) লাশ পাওয়া গেছে গত রোববার। আশ্রয়কেন্দ্রে আসার পথে সে মা-বাবার হাত থেকে ছুটে গিয়ে নিখোঁজ ছিল। শিফা আক্তার বাবা স্থানীয় ফয়জানিরপাড়ার আবদুল কাদের জানান, তিন দিনেও তার খোঁজখবর কেউ নেননি।

কাউখালী (পিরোজপুর) সংবাদদাতা জানান, কাউখালীর পাঙ্গাশিয়া-ফলইবুনিয়া-জোলাগাতি প্রায় ৭ কিলোমিটার বেরিবাঁধের বিভিন্ন স্থান ভেঙে গেছে। ফলে জোয়ারের পানি ঢুকে ফসলি জমির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। জোয়ারের পানিতে তলিয়ে গেছে বাড়িঘর।

সোমবার বিকেলে গেলে দেখা যায়, পাঙ্গাশিয়া খালের মোহনায় দুই পাড়ের অনেক অংশ, ফলইবুনিয়া হাতেম আলী সিকদারের বাড়ি এলাকায় এবং সাপলেজা, জোলাগাতি এলাকায় বেশির ভাগ বাঁধ ভেঙে গেছে। ফলইবুনিয়া এলাকার ইউপি সদস্য মাহমুদ হোসেন ভাঙনকবলিত এলাকা দেখিয়ে জানান, বাঁধটি দীর্ঘ দিন ধরে ভাঙনের কবলে। স্থানীয়ভাবে কয়েকবার বিভিন্ন অংশে মেরামত করা হয়। ফলইবুনিয়া এলাকার সাইদুল আলম জানান, সাপলেজা, জোলাগাতী, ভিটাবাড়িয়ার এলাকার লোকজন বেরিবাঁধ দিয়ে কাউখালী, পিরোজপুর বরিশাল যাতায়াতের মাধ্যম হিসেবেই ব্যবহার করত। বাঁধটি বিধ্বস্ত হওয়ায় তারা বিপর্যস্ত। বাঁধটি ভেঙে যাওয়ায় এলাকার পাঁচ সহস্রাধিক মানুষ আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। বিশেষ করে পাঙ্গাশিয়া বাজার নিয়ে ব্যবসায়ীরা চিন্তিত।

রাঙ্গাবালী (পটুয়াখালী) সংবাদদাতা জানান, রাঙ্গাবালী উপজেলায় ক্ষতিগ্রস্ত ২৫ শ’ পরিবারের মাঝে গত রোববার চাল বিতরণ করা হয়েছে।

উপজেলা প্রকল্প বাস্তাবয়ন কর্মকর্তার দেয়া প্রাথমিক তথ্য মতে, উপজেলার পাঁচটি ইউনিয়নে ২১৮৮ পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ১৫৭টি ঘরবাড়ি আংশিক বিধ্বস্ত হয়েছে। বন্যা নিয়ন্ত্রণ বেড়িবাঁধ, সেতু ও কালভার্টসহ তিন কিলোমিটার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, গাছপালা, গবাদিপশু, রাস্তাঘাট ও ফসলের তালিকা তৈরি করা হচ্ছে।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *